বুধবার, ০৫ অক্টোবর, ২০১৬, ১০:২৬:৪১

এক মাসে প্রতিমা ভাঙচুর ৩০টির ওপর মন্দিরে, ঝুঁকিপূর্ণ ১১৭টি মণ্ডপ

এক মাসে প্রতিমা ভাঙচুর ৩০টির ওপর মন্দিরে, ঝুঁকিপূর্ণ ১১৭টি মণ্ডপ

সিধু বসু : আর একদিন পরেই শুরু হতে যাচ্ছে সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পুজা। বাংলাদেশ পুজা উদযাপন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে এবার ২৯ হাজার ৩৯৫টি মণ্ডপে দূর্গাপুজা অনুষ্ঠিত হবে। তবে এই দুর্গা পুজাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া গেছে।

ইত্যিমধ্যে প্রায় ৩০টির ওপর মন্দিরে হামলা ও প্রতিমার ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্মিত প্রতিমা ভাঙচুরের পাশাপাশি পত্র যোগে পুজা না করারও হুমকি দেওয়া হয়েছে।

গাইবান্ধা জেলার সাদুল্যাপুর উপজেলায় সার্বজনীন মন্দিরে থাকা একটি দুর্গা প্রতিমার ডান হাত ভেঙে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। পাশাপাশি মন্দিরে দুর্বৃত্তরা হাতে লেখা হুমকিসংবলিত একটি চিঠি রেখে গেছে। সাদুল্যাপুর উপজেলার কামারপাড়া ইউনিয়নের পূর্ব কেশালীডাঙ্গা (ঠাকুরবাড়ী) সার্বজনীন মন্দিরে গত ২২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার দিবাগত গভীর রাতে এ ঘটনা ঘটে।

ঠাকুরবাড়ী সার্বজনীন মন্দিরের সভাপতি ত্রিপদ চক্রবর্তী জানান, রাত দেড়টার দিকে মোটরসাইকেলে করে কয়েকজন দুর্বৃত্ত মন্দিরে আসে। এ সময় তারা মন্দিরের গেট ভাঙার চেষ্টা করে। কিন্তু গেট ভাঙতে না পেরে একটি লোহার রড দিয়ে মন্দিরে থাকা দুর্গা প্রতিমার ডান হাত ভেঙে ফেলে। মন্দিরে শব্দ পেয়ে আশপাশের লোকজন ছুটে এলে হাতে লেখা হুমকিসংবলিত একটি চিঠি ফেলে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

সাদুল্যাপুর উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি প্রভাত চন্দ্র অধিকারী জানান, ফেলে রাখা চিঠিতে প্রথমে আরবি হরফ লেখা ছিল। তারপর লেখা ছিল তোমরা মূতি পূজা অর্চনা করনা, মূতি পূজা অর্চনা করা শিরক, তোমাদের কেউ রক্ষা করতে পারবে না, আমাদের নির্দেশ মোতাবেক তোমাদের চলতে হবে।

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার আগ বেথইর এলাকায় শত বছরের পুরনো কালী মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর করেছে দূর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় ঐ এলাকায় সংখ্যালঘুসহ এলাকাবাসীদের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে। গত (২৯ সেপ্টেম্বর) রাতের কোন এক সময় দুর্বৃত্তরা এ মন্দিরে প্রতিমা ভাংচুর করে।

এছাড়াও একদল দুর্বৃত্ত কর্তৃক হবিগঞ্জের উপজেলা নবীগঞ্জের পল্লী ফুটারমাটিতে একাধিক দুর্গা প্রতিমা ভাংচুর সহ ব্যাপক ক্ষতিসাধন করার অভিযোগ উঠেছে। ২৭ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার মধ্য রাতে সংঘটিত এই ঘটনায় দুই যুবককে আটক করেছে পুলিশ। আটককৃতরা হলো, সংশ্লিস্ট উপজেলাধীন কুর্শি ইউনিয়নভূক্ত ফুটারমাটি গ্রামের বাসিন্দা উকিল মিয়ার পুত্র আবু তাহের ও একই গ্রামের তাহির আলীর পুত্র জাবেদ মিয়া।

পুলিশ জানায়, আসন্ন দুর্গা পূঁজা উপলক্ষে ওই রাতে সংশ্লিস্ট গ্রামের বাসিন্দা ফনিভূষন সূত্র ধরের বাড়ীতে প্রতিমা তৈরীর কাজ চলছিল। এসময় নাকি উক্ত যুবকরা উচ্চস্বরে গান-বাজনায় লিপ্ত ছিল। এতে ক্ষুব্ধ হন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত এই পরিবারের সদস্য ও কারিগররা। এক পর্যায়ে তারা গান-বাজনায় বাঁধা দিলে যুবকরা ক্ষিপ্ত হয়ে বাকবিন্ডায় জড়িয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, এ সময় যুবকরা বেশ কয়েকটি প্রতিমা ভাংচুর করে।

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় একটি দুর্গামণ্ডপের গণেশ প্রতিমা ভাঙচুর করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে কে বা কারা এ কাজ করেছে, তা বলতে পারেনি পূজা আয়োজনকারীরা। আয়োজকদের পক্ষ থেকে প্রশাসনের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।

ঈশ্বরগঞ্জ পৌরসভার ধামদী রেলওয়ে স্টেশন পূজামণ্ডপে গত ২৫ সেপ্টেমবর রোববার ভোরে এ ঘটনা ঘটে। মণ্ডপে সভাপতি নিখিল গৌড় বলেন, রোববার ভোর সাড়ে চারটা পর্যন্ত তিনি ও আরও কয়েকজন মণ্ডপের পাহারায় ছিলেন। এরপর দিনের আলো ফুটলে তারা মণ্ডপ থেকে চলে যান। পরে ছয়টার দিকে তিনি খবর পান মণ্ডপের ভেতরে থাকা গণেশ মূর্তিটি উল্টে পড়ে আছে। তিনি মণ্ডপে গিয়ে দেখেন, মূর্তিটির হাত ভেঙে গেছে। পরে কারিগরকে খবর দিয়ে এনে মূর্তিটি মেরামত করা হয়েছে।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার শুখানপুকুরী ইউনিয়নে রাতের আধারে দূর্গা মন্দিরে ঢুকে প্রতিমা ভাঙচুর করেছে দূর্বৃত্তরা। শুক্রবার(১৬ সেপ্টেম্বর) ভোররাতে ঐ ইউনিয়নের লাউথুতি গ্রামের মাষ্টার পাড়ায় সার্বজনীন দূর্গা মন্ডপে এ ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি ঘটায় দূর্বৃত্তরা।

সরেজমিনে মাষ্টার পাড়া দূর্গা মন্ডপে গিয়ে দেখা যায়, আসন্ন দূর্গা পুজা উপলক্ষে মন্দিরে নির্মিতব্য প্রতিমাগুলোর দেহাবশেষ ভাঙ্গা অবস্থায় মন্দিরের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। এ সময় উপস্থিত হিন্দুধর্মালম্বীদের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছায়া দেখা গেছে।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান জানান, বিষয়টি জানার পর সাথে সাথে আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি মন্দিরের প্রতিমাগুলো ভাঙ্গা রয়েছে। আমার ধারণা জামায়াত-শিবিরের লোকজন এটা ঘটিয়েছে। বিষয়টি পুলিশ প্রশাসনকে গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় নেয়ার দাবি জানাই।

ঝুঁকিপূর্ণ ১১৭টি মন্দির

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলায় আসন্ন দুর্গাপূজায় ২৬৮টি মণ্ডপের মধ্যে অন্তত ১৭২টি মণ্ডপ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ৯১টি ঝুঁকিপূর্ণ ও ৮১টিকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ দেখানো হয়েছে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ মণ্ডপগুলোতে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানান হয়েছে।

বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ কোটালীপাড়া উপজেলা শাখা সাধারণ সম্পাদক নারায়ণ চন্দ্র দাস বলছেন, যেহেতু পুলিশ ঝুঁকিপূর্ণ মন্দিরের তালিকা তৈরি করেছে সেহেতু দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই তালিকা সঠিক। স্থানীয় দেবগ্রামের সমাজসেবক দেব দুলাল বসু পল্টু জানান, গত কয়েকদিন আগে রাতে আমার এলাকার দুর্গামন্দিরে কে বা কারা ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটিয়েছে। এ ঘটনার পরে আমরা আসন্ন দুর্গাপূজা নিয়ে আশঙ্কায় আছি। সেই অনুযায়ী এ উপজেলায় অনেক মন্দিরই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

এদিকে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান হাজরা বলেন, কোটালীপাড়ায় প্রতি বছর সকল ধর্মের লোক মিলেমিশে দুর্গা উত্সব পালন করে। পুলিশ প্রশাসন থেকে ঝুঁকিপূর্ণ মণ্ডপের যে তালিকা করা হয়েছে তা সঠিক নয়।

নড়াইলের লোহাগড়া পৌরসভাসহ উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের ১৬০টি মন্ডপে দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে ৩৬টি মন্ডপকে 'ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উৎসবকে কেন্দ্র করে ব্যস্ত সময় পার করছেন লোহাগড়ার প্রতিমা শিল্পীরা।

লোহাগড়া উপজেলা পূজা উদযাপন পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক সুবোধ কুন্ডু জানান, এ বছর পৌরসভাসহ উপজেলার ১৬০টি মন্ডপে শারদীয় দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হবে। জঙ্গি তৎপরতার কারণে প্রথম দিকে পুরোহিতরা পূজা-অর্চনা করতে অপারগতা প্রকাশ করলেও পূজা উদযাপন পর্ষদের নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত পুরোহিতরা পূজা-অর্চনা করতে রাজি হন। জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার এ উৎসব। সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বজায় রেখে সবাইকে এই সার্বজনীন এ উৎসবে অংশ গ্রহন করার জন্য আহ্বান জানান তিনি।

লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, দুর্গাপূজাকে নির্বিঘ্ন করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব সহযোগিতা করা হবে। লোহাগড়া থানার অফিসার ইনচার্জ জাহাঙ্গীর আলম জানান, দুর্গাপূজা উপলক্ষে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ঝুঁকিপূর্ণ মন্ডপগুলোতে বিশেষ নিরাপত্তা দেয়া হবে এবং পুলিশি টহল জোরদার করা হবে।

এদিকে, পুজামন্ডপে কোন জঙ্গি হামলার হুমকি নেই বলে জানান ডিএমপি কমিশনার। আজ বুধবার রাজধানীর ঢাকেশ্বরী পূজামণ্ডপ পরিদর্শনে এসে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজায় মণ্ডপগুলোতে পূজার প্রস্তুতি দেখে আমি সন্তুষ্ট। রাজধানীর প্রতিটি পূজামণ্ডপ ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। এছাড়া হুমকি না থাকলেও পূজামণ্ডপগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। রাজধানীর ২২৬টি পূজামণ্ডপের মধ্যে ৮৮টিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্নিত করে বিশেষ নিরাপত্তা দেবে ডিএমপি। এ সময় তিনি বলেন, মণ্ডপে কোনো ধরনের ব্যাগ বহন থেকে পুণ্যার্থীদের বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।

এর আগে, গত ২৭ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে দুর্গাপূজায় ৩ স্তরের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। প্রতিমা তৈরি, স্থাপন এবং বিসর্জন পর্যন্ত নিরাপত্তা জোরদার করা হবে বলেও জানান তিনি।

নিরাপত্তার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আনসার ও পুলিশ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকার পাশাপাশি পূজা উদযাপন কমিটির প্রস্তুতকৃত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী কাজ করবে।

বিজিবি প্রস্তুত থাকবে, প্রয়োজনে তাদেরকেও ব্যবহার করা হবে। আমরা আশা করি, দুর্গাপূজা শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপন হবে। তিনি বলেন, উৎসবে যেন রাস্তায় যানজট সৃষ্টি না হয় সে জন্য ট্রাফিক পুলিশ কাজ করবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘পূজা আয়োজকরা এবার রেকর্ড সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করবেন। তারা সব সময় স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। এজন্য স্বেচ্ছাসেবকদের পুলিশের নম্বর সরবরাহ করা হয়েছে।’

৪ অক্টোবর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে