সোমবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৬, ০৩:৩৮:৪৯

‘দরজার ফাঁক দিয়ে দেখি গেস্টরা ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছেন’

‘দরজার ফাঁক দিয়ে দেখি গেস্টরা ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছেন’

নিউজ ডেস্ক: ‘হামলা শুরুর পর কিচেনের দরজার ফাঁক দিয়ে দেখি, গেস্টরা ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। কেউ টেবিলের নিচে মাথা ঢুকিয়ে লুকানোর চেষ্টা করছেন। আমরা কয়েকজন পালানোর চেষ্টা করি। কিন্তু পেছন দিয়ে পালাতে গিয়ে দেখি, একই চেষ্টা করতে গিয়ে কয়েকজন ফেরৎ আসছেন। জঙ্গিরা ওই পথেও আক্রমণ করেছে।পরে সেখান থেকে ফিরে এসে আমরা ৯ জন একসঙ্গে একটি বাথরুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেই।’

গত ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানে হলি আটির্জান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে এসব বলেন শিশির বৈরাগী। সেদিন অন্যদের সঙ্গে তিনিও সেখানে জিম্মি হয়েছিলেন। তিনি হলি আর্টিজানে রান্নার কাজ করতেন।

শিশির বৈরাগী বলেন, ‘রাত ৩টার দিকে জঙ্গিরা এসে দরজা খোলার জন্য ধমকাতে থাকে; জানতে চায় কোনও বিদেশি আছেন কিনা। নেই জানানোর পরও তারা দরজা খুলতে বলে। না খুললে বোমা মারার হুমকি দেয় জঙ্গিরা। এরপর দরজা খুললে জঙ্গিরা মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসার নির্দেশ দেয়। কয়েক মিনিট পর আবার বাথরুমে ঢুকিয়ে বাইরে দিয়ে তালা লাগিয়ে দেয় তারা।’

তিনি বলেন, ‘শুক্র ও শনিবার রেস্টুরেন্ট খোলা হতো সকাল ৮টায়, অন্যদিন সকাল ১০টায়। ঘটনার দিন আমরা যাই  ৮টার দিকে। গেস্টরা আসেন ৯টার দিকে। সকালের শিফট ভালোভাবেই গেলো। বিকালের শিফট চালু হয় সাড়ে ৫টায়। আনুমানিক রাত পৌনে ৯টার দিকে জঙ্গিরা ব্যাগে অস্ত্র নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকেই সরাসরি হামলা চালায় বিদেশিদের ওপর। আমরা তখন কিচেনে রান্নায় ব্যস্ত ছিলাম।’

শিশির বৈরাগী বলেন, ‘রান্না ঘর থেকে শব্দ পাচ্ছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, প্লেট কিংবা গ্লাস পড়ার আওয়াজ। কিন্তু অনবরত শব্দ হচ্ছিল। এমন সময় আমাদের এক বিদেশি বাবুর্চি আমার পাশ দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি তখন ক্যাপসিক্যাম কাটছিলাম। তার সঙ্গে ধাক্কা লাগায় হাতে থাকা ছুরিতে আমার পেট একটু কেটে যায়। আমিও এগিয়ে যাই তার দৌড়ানোর কারণ বোঝার জন্য। কারণ, তিনি মাঝেমধ্যে ওয়াশারদের কাছ থেকে প্লেট আনতে ওইভাবে দৌড়াতেন। কিন্তু ওইদিন যে দৌড়ে গেলেন,আর ফিরে আসেননি।’

শিশির বৈরাগী বলেন, ‘‘টয়লেটে ঢুকেই রেস্টুরেন্ট মালিককে ফোন দিয়ে বলি যে, অফিসে সন্ত্রাসী ঢুকেছে; পুলিশ পাঠান। মালিকও প্রথমে ধারণা করতে পারেননি যে, সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। কিছু সময় পর আবারও তাকে ফোন করি। দ্বিতীয় দফায় ফোন পেয়ে তিনি বলেন, কী বলিস! এরপর তিনি বলেন, ‘আমি পুলিশ পাঠাচ্ছি।’ তখন তিনি পুলিশকে বিষয়টি জানান। সারারাত ওই বাথরুমের মধ্যে আটকা পড়ে আমাদের নয়জনের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। ১০ মিনিট পর আমাদের ওপর দিয়ে কয়েকজনের পালানোর শব্দ পাই। আমরা মনে করেছিলাম, পুলিশের শব্দ পেয়ে সন্ত্রাসীরা পালাচ্ছে। কিন্তু পরে জানতে পারি, আমাদের স্টাফদের কয়েকজন সেখান দিয়ে পালিয়েছেন। সারারাত জঙ্গিরা গোলাগুলি করেছে। আমাদের স্টাফদের দিয়ে রান্না করিয়ে সেহরি খেয়েছে। সবাইকে নামাজ-রোজা করার পরামর্শ দিয়েছে। শিশির নামের আরেক হিন্দু কর্মচারীকে সুরা পড়িয়েছে।’

শিশির বৈরাগী বলেন, ‘‘জঙ্গিদের হুমকির মুখে রাত তিনটার দিকে টয়লেট থেকে বের হয়ে দেখি একজনের গলায় অস্ত্র ঝুলানো। আরেকজনের হাতে রামদার মতো চাপাতি। পেছনে আরেকজনের হাতেও অস্ত্র। তারা যখন দেখল আমাদের মধ্যে কোনও বিদেশি নেই, তখন তারা আমাদের টয়লেটের ভেতরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয়। অক্সিজেনের অভাবে আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছিল। তখন আমরা মালিককে ফোনে বলি, আমরা তো অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছি। আপনি পারলে পাশের বাড়ির দেওয়াল ভেঙে আমাদের বের করার ব্যবস্থা করুন।  সকালে আমরা বাথরুমের দরজার কিছু অংশ ভেঙে জঙ্গিদের বলেছি, আমরা গরিব মানুষ। আমাদের মেরে ফেলেন। নইলে আল্লাহর ওয়াস্তে বাঁচান। আমরা দুজন হিন্দু ছিলাম। যারা মুসলমান ছিল তাদের চেয়ে আমরা আল্লাহকে বেশি ডেকেছি। তাদের লক্ষ্যই ছিল বিদেশি ও বিধর্মী।’

শিশির বৈরাগী বলেন, ‘সকালে যৌথবাহিনীর অভিযানের মিনিট দশেক আগে সবুজ নামে আমাদের এক স্টাফকে জঙ্গিরা বলে, বাথরুমের ভেতর থেকে সবাইকে নিয়ে আয়। পরে সবুজ এসে আমাদের টয়লেটের দরজা খুলে দেয়। বের হওয়ার পর পাঁচজন তাদের কাছে যায়। আমরা বাকি চারজন তাদের কাছে না গিয়ে দোতলায় উঠে পালানোর চেষ্টা করি। পাশের বাড়ির চালের ওপর লাফিয়ে পড়ি। তখন  যৌথবাহিনী আমাদের ধরে ফেলে। তারা আমাদের চড়-থাপ্পড়ও দেয়। পরে তারা আমাদের ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পুলিশ আমাদের ছেড়ে দেয়। তারা আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছে। ঘটনার পর দুমাস রাজধানীর ফুটপাতে হকারি করেছি। বর্তমানে ব্র্যাকে কুক হিসেবে চাকরি করছি।’

হলি আর্টিজানের শেফ সাইফুল চৌকিদারের বিষয়ে শিশির বৈরাগী বলেন, ‘সাইফুল ভাই ভালো লোক ছিলেন। একসঙ্গে কাজ করেছি প্রায় দেড় বছর। উনি আমার থেকে প্রায় ১০ বছরের বড়। কিন্তু কখনও খারাপ ব্যবহার করেননি। আমাদের সম্মান দিয়েছেন। আমরাও তাকে সম্মান দিয়েছি। শুনেছি, সাইফুল ভাই মারা গেছেন। কিন্তু তার লাশটা দেখতে পারিনি।’

শিশির বৈরাগীর বাড়ি বরিশালের আগৈলঝাড়ার জোবারপাড় গ্রামে। তার বাবার নাম অশোক বৈরাগী। শান্ত নামে সাত বছরের একটি ছেলে রয়েছে তার। -বাংলা ট্রিবিউন।
১০ অক্টোবর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে