শুক্রবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৬, ০৯:০৬:১৩

‘ঢাকার মানুষের মনে ভালোবাসা কম’

‘ঢাকার মানুষের মনে ভালোবাসা কম’

নিউজ ডেস্ক: ‘ঢাকাত আসিয়া সবই ভালো নাগছে। যা দেখিবার মন চায় দেখিছি ঘুরি বেড়াইছি। কিন্তু ভাই একটা কথা, ঢাকার মানুষের মনে ভালোবাসা কম।’
বললাম, কেন?
‘হামার দ্যাশত যদি কারও বাড়িত গিয়া হাজির হন, তাঁই আপনাক না খাওয়াইয়া ছাড়িবে না। একনা মুড়ি হইলেও দিবে। ঢাকাত সব কিনা খাওয়া নাগে; ভুকে (ক্ষুধায়) মইরবার নাগিলেও কেউ ফিরা চাহিবে না।’

লঞ্চের ছাদে অন্ধকার। ভালো করে মুখ দেখা যায় না। বয়স ১৮-১৯। হ্যাংলা-পাতলা শরীর। চেহারায় মোঙ্গলয়েড ধাঁচ। সম্ভবত আদিতে কোচ বা রাজবংশী ছিল। ওর সঙ্গীর বয়স একটু বেশি, শ্রমজীবী বাঙালি চেহারা।

নদীপথে যাত্রীরা খুব একটা বাতচিত করে না। নদী মানুষকে হয়তো আনমনা করে। সবাই কেমন উদাস হয়ে জলরাশির দিকে, তীরের দিকে কিংবা অন্য কোনো জলযানের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর ভাবে। নদী সম্ভবত মনের তলার কথা মনে করায়।


আমাদের এই ছোট লঞ্চটা ছেড়েছে রাত সাড়ে আটটায়। মুন্সিগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার এটাই শেষ লঞ্চ। সঙ্গী ছিলেন নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক সংগঠক এবং মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজের ইংরেজির শিক্ষক অসিত বরণ সাহা। বসেছি লঞ্চের পেছন দিকটার ছাদে। নদীর হিমেল হাওয়া গায়ে লাগছে। জায়গাটায় আরও কয়েকজন বসা। লঞ্চ চলেছে শীতলক্ষ্যার বুক চিরে। নদীর তীরের সিমেন্ট কারখানার ছাই কুয়াশার মতো উড়ছে। নিশ্বাসে চাপ লাগে।

অন্ধকারের মধ্যেই ভাড়া নেওয়ার লোকটাকে এগিয়ে আসতে দেখলাম।

পাশ থেকে একজন বলল, ‘ভাই, নারায়ণগঞ্জ কত?’

বললাম, এই ধরেন আরও ৩০-৪০ মিনিট।

‘না না, নারায়ণগঞ্জের ভাড়া কত দেওয়া নাগবে?’

সেটা তো আমিও জানি না। পাশ থেকে আরেক যাত্রী বললেন, ‘২০ টাকা।’

১০০ টাকার একটা নোট বের করে আঙুল দিয়ে ভাঁজ ভেঙে আদায়কারীর দিকে এগিয়ে দিল ছেলেটা। এবার তাকালাম। পাশাপাশি দুটি তরুণ। সামনে দুটি সস্তা ট্রাভেল ব্যাগ। একজনের বয়স ১৮-১৯ হবে, ফরসা, পাতলা গড়ন। অন্যজন কালো; ২২-২৪ মতো বয়স। ভাড়ার প্রশ্নটা শুনেই বোঝা গিয়েছিল, এই নদীতে যাতায়াত নেই তেমন। ‘কই যাবেন’ কথা দিয়েই আলাপ শুরু।

‘ঢাকায় যাব, ভাই।’

এখানে কই আসছিলেন?

জবাব দিল বড়জন, ‘বেড়াবার আসছিলাম। দ্যাশ দেখিতে ভালো লাগে তো!’

তা কই কই বেড়ালেন?

ছোটজনের আচমকা উত্তর, ‘আমরা রিকশা চালাইতে এইখানে আসছি, ভাই।’

বড়জন অস্বস্তিতে পড়ে গেল মনে হয়। ‘জি, মানে রিকশা চালাইছি আর দ্যাশ দেখছি। বেড়াইতে টাকা লাগে না?’

রিকশাচালকেরা সচরাচর পেশা লুকান না। কিন্তু এরা লুকাচ্ছে। জিজ্ঞেস করি, এখানে কই ছিলেন?

‘মেসে থাকছি। কিন্তু বুঝলেন ভাই, এই এলাকার মানুষ ভালো কিন্তু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না। মেসে রেগুলার তরকারির মধ্যে চুল পাইতাম। এক খালা পাকাইত। তাঁক কী করি বলি যে পাক পরিষ্কার না। যাইবার সম বললাম, খালা আর তো দেখা হইবে না, চলিলাম। আপনি ভালো থাকিয়েন। এই বলি চলি আসিলাম। এখন যাইছি ঢাকায়।’

ওহো, নামই জানা হয়নি এতক্ষণ। জিজ্ঞেস করায় উত্তর দিল ছোটজন—ওই যে পরে যে বলবে, ঢাকার মানুষের ভালোবাসা কম থাকার কথা।

‘আমার নাম বীশু রায় আর অয় জাহাঙ্গীর। মুই হিন্দু অয় মুসলমান হইলে কী হইবে, হামাকের বাড়ি একই গাঁওত, একসঙ্গে খেলাইছি, একসঙ্গে ঢাকাত চাকরি কইরবার আসছি। কেউ বলবার পাইরবে না যে হামাকের মধ্যে কোনো দিন কাজিয়া হইসো। হিন্দুর বাড়িত মুসলমান আসিয়া খায়, মুসলমানের বাড়িত হিন্দু বসিয়া খায়। যার যেইটা খাওয়া নিষেধ, সেইটা ছাড়া সব চলে। গরিব হইলে কী হইবে, খুব মিলমিশ হামাকের। কিন্তু ঢাকাত আসিয়া বড় দুঃখ পাইলাম।’

যারা এজমালি বা যৌথ জীবনযাপন করেছে গ্রামে, অনেক পরিবার যেখানে এক উঠান ঘিরে বাস করে, তাদের পক্ষে রাজধানীর হালচাল মানা কঠিন। ওরা দুজনই কাজ করত ঢাকার উত্তরার এক নামকরা কাবাবের রেস্তোরাঁয়। ভোর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত। বাড়ি নীলফামারীর ডোমারে। তো এই দুজন সেই রেস্টুরেন্টে  এক গোপন তৎপরতা শুরু করে। প্রতিদিনের বেঁচে যাওয়া খাবার ফেলে দিতে তাদের খারাপ লাগত। তাই লুকিয়ে রাস্তার ভাসমান মানুষদের খাওয়াত। সমস্যা বাধল সেটা নিয়েই। এবার কথা বলল জাহাঙ্গীর—

‘একদিন মালিক দেখি ফালাইল। তারপর সে কী নাগ (রাগ), চোটপাট। মেলা গালি দিল। ক্যান খাবার বাইরের মানুষেক দিছি। ভাই আপনিই বলেন, এই খাবার তো নষ্ট হইত, পচি যাইত, ফালায়া দেওয়া নাইগত। তাই মাইনষেক দিছি। অন্যায়টা কী করছি...এরপর থাকি আর ভালো নাগিত না। মানুষের মনে দয়া-মায়া থাকা নাগিবে না? তাই বীশুটাক বলিলাম, চল থাকিম না, নতুন দ্যাশে যাই।’ হঠাৎ করে চা–শ্রমিকদের নিয়ে গানটা মনে পড়ে গেল, ‘চল মিনি আসাম যাব, দ্যাশে বড় দুঃখ রে!’ সময় বদলায়, বীশু আর জাহাঙ্গীররা জীবিকার টানে যাযাবর হয়।

ওই মাসের কাজ শেষে ওরা চাকরি ছেড়ে চলে আসে মুন্সিগঞ্জে। কিন্তু মেসের পরিবেশ ভালো না লাগায় আবার বেরিয়ে পড়েছে পথে। ঢাকায় তো কাজ নাই, তাহলে থাকা হবে কোথায়?

বীশুর উত্তর, ‘দ্যাশের মেলা মানুষ ঢাকায় কাজ করে। উত্তরায় যেইখানে থাকতাম, তারা অনেক সম্মান করে। গিয়া উঠিলে খুশিই হইবে। তবে এইবার বেশি থাকিম না। সামনেই কালীপূজা। নীলফামারীত দুর্গাপূজার থাকিয়া কালীপূজার আনন্দ বেশি। সাত দিন মেলা হয়। পূজায় বাড়ি যাইম।’

জাহাঙ্গীরও ঢাকায় থাকতে চায় না। তবে ধান কাটা হয়ে গেলে কিংবা এলাকায় কাজ না থাকলে বেরিয়ে ওদের পড়তেই হয়। উন্নয়নের হাত নীলফামারীতে পৌঁছায়নি। জেলার মোট আয়ের ৬৮ দশমিক ৫১ শতাংশ আসে কৃষি থেকে, অকৃষি শ্রমিক মাত্র ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। কলকারখানা নাই বললেই চলে। বাংলাদেশে যাযাবর শ্রমিকদের বেশির ভাগই এই এলাকার যুবক-তরুণ। শহরে এসে ওরা দুঃখ পায়, তবু আসতে হয়।

ততক্ষণে নারায়ণগঞ্জ ঘাট চলে এসেছে। আমরা আমাদের পথে, ওরা ওদের পথে চলে গেল। লঞ্চঘাটের বাইরেটা একটু অন্ধকার, কোন দিকে ওরা গেল আর দেখা হলো না! উভয়েরই গন্তব্য ঢাকায়—যে শহরে অচেনা মানুষেরা এভাবে বসে গল্প করে না। নদী কাছে টানে, আর শহর ঠেলে দূরে।-প্রথম আলো।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
২৮ অক্টোবর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে