বুধবার, ০২ নভেম্বর, ২০১৬, ০১:৫৫:৪০

বিএনপিতে সমন্বয়হীনতা প্রকট, বিব্রত হাইকমান্ড

বিএনপিতে সমন্বয়হীনতা প্রকট, বিব্রত হাইকমান্ড

নিউজ ডেস্ক : বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, অনেক ক্ষেত্রেই জ্যেষ্ঠ নেতাদের তোয়াক্কা করেন না কনিষ্ঠরা। আবার কনিষ্ঠদের প্রতিও জ্যেষ্ঠদের মনোভাব ইতিবাচক নয়। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত ছাড়াই দলীয় ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে যে যার মতো মন্তব্য করছেন।

এমনকি গুলশান কার্যালয়ে চেয়ারপারসনের দুই প্রভাবশালী কর্মকর্তার দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বের বিরূপ প্রভাব পড়ছে দলে। এসব নেতা ও কর্মকর্তার এ ধরনের আচরণে ভঙ্গ হচ্ছে দলের শৃংখলা। পাশাপাশি বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে হাইকমান্ডকে। এই সমন্বয়হীনতা দূর করতে বিষয়টি আগামী স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উত্থাপন করা হবে বলে আভাস দিয়েছেন বিএনপির কয়েকজন নীতিনির্ধারক।

জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য প্রায় একই ধরনের তথ্য দিয়ে মঙ্গলবার বলেন, কমিটি গঠনের পর থেকে নানা ইস্যুতে দলের মধ্যে অস্থিরতা চলছে। কমিটি নিয়ে সৃষ্ট এ সংকট যখন প্রায় কাটিয়ে উঠেছে ঠিক তখনি আবার কয়েকটি ইস্যুতে দলের মধ্যে শুরু হয়েছে নানা গুঞ্জন। নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে অস্থিরতা। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে যাওয়া না-যাওয়া নিয়ে এক নেতার বক্তব্য এবং দল ও নেতাদের নিয়ে চেয়ারপারসনের এক কর্মকর্তার মন্তব্যে বিব্রত হাইকমান্ড।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, শৃংখলাবদ্ধ এক নেতার হাত ধরেই এ দলের যাত্রা। জিয়াউর রহমান তার নিজস্ব দর্শন ও চিন্তাচেতনা দিয়ে এ দলটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। আজ নানা ইস্যুতে দলের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শৃংখলাও মানা হচ্ছে না। এটা দুঃখজনক। যেহেতু দলে এখনও পুনর্গঠনের কাজ চলছে। এগুলো হয়ে গেলে দলে কোনো সমন্বয়হীনতা বা বিশৃংখলা থাকবে না বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

গত ২১ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে দলের যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আসেনি তাতে কী হয়েছে আমরা তাদের কাউন্সিলে যাব।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাউন্সিলে যায়নি দলটি। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, হাইকমান্ডের কোনো সম্মতি ছাড়াই তিনি এমন মন্তব্য করেছেন। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আগ বাড়িয়ে তার কথা বলা ঠিক হয়নি। এতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগকে কথা বলার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। কাউন্সিলে না যাওয়ায় উল্টো তারা বিএনপির ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে। ক্ষমতাসীনরা বলছে, বিএনপি আসার কথা বলেও আসেনি। আসলে দলটি চায় না ঐক্য হোক।

দলীয় সূত্র জানায়, কাউন্সিলে যাওয়া না-যাওয়া নিয়ে ধোঁয়াশায় ছিলেন নেতাকর্মী এমনকি গণমাধ্যমের কর্মীরাও। কাউন্সিলের একদিন আগ থেকে দলের শীর্ষ নেতারা এ নিয়ে মুখে কুলুপ আঁটেন। সেই অন্ধকারের মধ্যেই ঢিল ছোড়েন আলাল। পরে তিনি হাইকমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করেও এ ব্যাপারে কোনো সাড়া পাননি। দলের একটি অংশ মনে করে, কাউন্সিলে যাওয়া না-যাওয়া নিয়ে দলের অবস্থান স্পষ্ট করা উচিত ছিল। এ নিয়ে লুকোচুরি করে মূলত দলের ইমেজেই ক্ষুণ্ণ হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নিতে হাইকমান্ডকে আরও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হবে।

আরও জানা গেছে, আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের পর গুলশান কার্যালয়ে দলের চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করেন আলাল। এ সময় খালেদা জিয়া তার কাছে জানতে চান- ‘আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে যাব এটা তোমাকে কে বলেছে।’ গত বুধবার রাতে যুবদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয় এ্যালবার্ট পি কস্তাকে। হাইকমান্ডের এমন সিদ্ধান্তকে অনেকে আলালের আগ বাড়িয়ে কথা বলার সঙ্গে যোগসূত্র দেখছেন।

দলের মধ্যে এমন অস্থিরতা শেষ হতে না হতেই বিএনপির চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খানের এক বক্তব্যে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। শনিবার তার ফেসবুক পেজে বিএনপির অভ্যন্তরীণ নানা বিষয় নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেন তিনি। পরদিন কয়েকটি জাতীয় দৈনিক ও বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টালে তা প্রকাশিত হওয়ার পর দলের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। দলের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব এমন মন্তব্য করতে পারেন কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তার এ লেখার পেছনে কারও ইঙ্গিত আছে কিনা তা খতিয়ে দেখার দাবি জানান কেউ কেউ। বিশেষ করে বিএনপিতে সাহসী নেতার অভাব রয়েছে তার এমন মন্তব্যে অনেকেই কড়া সমালোচনা করেন। তার বক্তব্যের সুর ধরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিএনপিকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বক্তব্য দেয়ার সুযোগ পেয়েছেন বলে দলের অনেক নেতা মনে করছেন। এতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও মন্তব্য তাদের।

‘দলে রাজনৈতিক দর্শন ও মতাদর্শগত অনুশীলন ও সংগ্রাম খুবই কম’ সোহেলের এমন মন্তব্যে দলের বড় একটি অংশ ক্ষুব্ধ। তারা মনে করেন, এর মাধ্যমে নেতাদের আদর্শ নিয়েই তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। এ ছাড়া তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘বিপদ মোকাবেলায় দলে সাহসী নেতাকর্মীদের অভাব দেখা দিয়েছে’। এ মন্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি নেতাকর্মীদের জীবনবাজি রেখে দীর্ঘদিন করা সংগ্রামকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন। বিএনপির নীতিনির্ধারকদের অনেকেই মনে করছেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে কয়েকশ’

নেতাকর্মীর মৃত্যু, হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে মামলা, অনেকে গুম হয়েছেন- এতসবের পরও চেয়ারপারসনের একজন কর্মকর্তা কী করে নেতাদের আদর্শ ও সাহস নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এর আগে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠকে গুলশান কার্যালয়ে এক কর্মকর্তার উপস্থিতি নিয়ে দলের মধ্যে নানা সমালোচনা হয়।

বিএনপির সিনিয়র এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি চেয়ারপারসনের সঙ্গে আলাপ করবেন। সোহেল তার অবস্থান থেকে এমন বক্তব্য দিতে পারে কিনা। ‘মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী জীবন সায়াহ্নে এসে তার আদর্শের পতাকা শহীদ জিয়ার হাতে তুলে দিয়ে যান’ সোহেলের এমন বক্তব্যের ব্যাখ্যা চাইবেন ওই নেতা। তিনি আরও বলেন, ‘আমি চেয়ারপারসনের কাছে জানতে চাইব আমরা কি ভাসানীর দল করি না জিয়াউর রহমানের আদর্শের দল করি। আমি তো জিয়ার আদর্শে দল করি। ভাসানীর দল করতে আসিনি। যদি বিএনপি ভাসানীর দলই হয় তাহলে আমি আর বিএনপিতে নেই বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেব।’

সূত্র জানায়, শুধু এ দুটি ঘটনাই নয় দলে এমন অসংখ্য সমন্বয়হীনতা ও শৃংখলা পরিপন্থী কাজ চলে আসছে। দলের ভাবমূর্তির পরিবর্তে নিজেদের ভাবমূর্তি নিয়েই ব্যস্ত তারা। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যে যার মতো করে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করার পরও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একই ইস্যুতে আবার বিবৃতিও পাঠানো হয়। এ নিয়ে গণমাধ্যমের কর্মীদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে। যাকে যখনি মৌখিকভাবে দলের মুখপাত্রের দায়িত্ব দেয়া হয়, তখন তিনি তার মতো করে বক্তব্য দেয়া শুরু করেন।

জানা গেছে, এমন সমন্বয়হীনতার কারণে দলের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এই সমন্বয়হীনতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আ স ম হান্নান শাহর মতো দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা যেদিন মারা যান, সেদিনই মহিলা দলের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এ নিয়ে দলের মধ্যে সমালোচনার ঝড় ওঠে। দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ এবং কোন্দল সৃষ্টির লক্ষ্যেই ওইদিন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে বলে অভিযোগ বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের। যুগান্তর
০২ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি‌

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে