রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৬, ০১:৪৯:০০

কোন্দলের উত্তাপে আওয়ামী লীগে অস্থিরতা

কোন্দলের উত্তাপে আওয়ামী লীগে অস্থিরতা

হাবীব রহমান : স্বার্থের কোন্দলে জড়াচ্ছে আওয়ামী লীগের তৃণমূল। এ কোন্দলের রেশ পড়েছে জাতীয় রাজনীতিতে। নিজেদের এ কোন্দলে দেশে-বিদেশে চাপের মুখে পড়েছে সদ্য দলের জাতীয় সম্মেলন শেষ করে নবযাত্রার প্রাক্কালে থাকা শাসক দল।

সংখ্যালঘু নির্যাতন থেকে মুক্তিযোদ্ধা নির্যাতন আঘাত করছে আওয়ামী লীগের আদর্শিক রাজনীতির ভিতে। এর পেছনে রয়েছে স্বার্থগত দ্বন্দ্ব ও প্রভাব বিস্তারের মোহ। ঢাকায় এক সাংবাদিককে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার সময়ও অবৈধ পলিথিন উত্পাদনকারীরা ব্যবহার করেছে আওয়ামী লীগের নাম। সর্বশেষ গাইবান্ধায় সাঁওতাল হত্যায়ও রয়েছে দলীয় কোন্দল ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব।

ধারাবাহিক এসব ঘটনার চাপ পড়েছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ওপর। প্রতিনিধি দল যাচ্ছে তৃণমূলে। রাজধানীজুড়ে হচ্ছে সভা-সমাবেশ। আতঙ্ক আর ক্ষোভ ছড়াচ্ছে জাতীয় রাজনীতিতে। বাড়তি চাপ পড়ছে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারক নেতাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, এসব কোন্দল তৃণমূল নেতাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাতে গিয়ে আগামী দিনগুলোতে এ কোন্দল আরো মাথাচাড়া দিতে পারে। এজন্য দলটি অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষ প্রয়োজনীয় কঠোরতাও দেখাচ্ছে।

তবে এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের আরেকটি মত হচ্ছে, দলীয় কোন্দলের পাশাপাশি এসব ঘটনায় সরকারবিরোধী মহলের সূক্ষ্ম অথবা পরোক্ষ ইন্ধন থাকতে পারে। এর যুক্তি হিসেবে দলের এক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বলেন, এসব কোন্দলের ফলাফলে যা ঘটছে তা আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলে কুঠারাঘাত করছে। এর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে, দেশের জাতীয় রাজনীতির বিশেষ একটি পর্যায়কেও সামনে নিয়ে আসেন ওই নেতা।

তিনি বলেন, বিএনপি যে ‘ভ্রান্ত নীতি’র ওপর এতদিন রাজনীতি করেছে, মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের হত্যার দিনে (৭ নভেম্বর), সংহতি দিবস পালন করে আসছে। এবার তা করতে পারেনি। তাই আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলে কুঠারাঘাতে দলীয় কোন্দলের সঙ্গে বিভিন্ন মহলেরও ইন্ধন থাকতে পারে। এজন্য আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে একাধিকবার নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।

আরো সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় নেতারা বলেন, টানা ক্ষমতায় থাকার পর দলীয় পদ-পদবি প্রত্যাশী নেতার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হওয়ায় নেতাদের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়েছে। অনেকেই জেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, প্রতিযোগীকে ঘায়েল করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে গিয়ে উল্টো দলকেই চাপে ফেলে দিচ্ছেন।

এরপর ভবিষ্যতে অন্যান্য নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাওয়ার জন্য নিজ দলের অন্য নেতাদের চাপে ফেলার ছক কষছেন। অনেক এমপি ও বড় নেতাও এসব ঘটনায় মদত দিচ্ছেন। এ ছাড়া মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের গুঞ্জনে শ’খানেক এমপি আছেন ‘মন্ত্রীদৌড়ে’। নিজের সম্ভাব্য প্রতিযোগীকে চাপে ফেলতে গিয়ে বিভিন্ন কোন্দলের জন্ম দিয়ে উল্টো পুরো দলকেই ফেলে দিচ্ছে বেকায়দায়।

দলের উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, সাংগঠনিক জটিলতার এসব বিষয় মাথায় রেখেই প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকদেরও বিভাগওয়ারি দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন। আট বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন চার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। আগে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তিনজন থাকলেও এবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের একটি পদ বাড়ানো হয়েছে।

এ ছাড়া কোন্দল ও বলয় সৃষ্টির আশঙ্কা থেকে সাংগঠনিক সম্পাদকদের আগে দায়িত্ব পালন করা নিজস্ব বিভাগ পরিবর্তন করে অন্য বিভাগে দায়িত্ব দিয়েছে দলের হাইকমান্ড। ২০০৯ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করা সাংগঠনিক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকদের এজন্য এবারো পরিবর্তন করা হয়নি। যেন দল সাংগঠনিক সুবিধা পায়।

এত পূর্বপ্রস্তুতির পাশাপাশি দলের ভেতরের এসব কোন্দলে কোনো ছাড় দিতেও নারাজ দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব ঘটনায় জড়িতদের পক্ষে কেউ কোনো সুপারিশ নিয়েও প্রধানমন্ত্রীর সামনে যাওয়ার সাহস করছেন না। কোনো নেতাকর্মী অন্যায়-অনিয়মের সঙ্গে জড়িত হলে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছে আওয়ামী লীগ। পাশপাশি এখন থেকে কারো ব্যক্তিগত দায়ভার আর দল নেবে না বলেও সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন নীতি-নির্ধারকরা। কেন্দ্র থেকে শিগগিরই এমন বার্তা সংগঠনের সর্বস্তরে পৌঁছে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন দলের শীর্ষ স্থানীয়রা।  

ইতিমধ্যেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে ফুটপাত মুক্তকরণ কাজে হকারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করার অপরাধে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ (দক্ষিণ) সাধারণ সম্পাদক সাব্বির আহমেদকে বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে দলের হাইকমান্ডের কঠোর অবস্থানের কথাই জানিয়েছে শাসক দল। ইতিমধ্যে এ ঘটনায় মামলাও দায়ের করা হয়েছে।

এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের তিন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি র আ ম ওবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর ওপরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া কক্সবাজারের বিতর্কিত এমপি আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলায় সাজা হওয়ার ঘটনাকেও আওয়ামী লীগের কঠোরতার ইঙ্গিত বলে মনে করছেন অনেকে।
 
আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এই পদক্ষেপগুলোকে আওয়ামী লীগের কঠোর অবস্থান হিসেবেই দেখছেন। তারা বলছেন, যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে দল ও সরকারের কঠোর অবস্থান সংগঠনের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে জানিয়ে দেয়া হবে। এজন্য কেন্দ্র থেকে লিখিত বা মৌখিক সতর্ক বার্তাও পাঠানো হবে। তারা বলেন, কোনো অবস্থাতেই দলের ও সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারীদের রেহাই দেয়া হবে না।

হঠাত্ অস্থিরতা: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা ও আগুন সারাদেশে ছড়িয়ে যাওয়ার আগেই তা নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও দলীয় কোন্দলের রেশ কাটেনি। ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার পর অন্তত আরো ছয়টি হামলার ঘটনা ঘটে সারাদেশে। এ ছাড়া নাসিরনগরেই ৩০ অক্টোবরের হামলার পর আরো দু’দফা হামলার ঘটনা ঘটে।

সেই হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে নাসিরনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-প্রচার সম্পাদক আবুল হাসেম, হরিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক আহমেদ ও চাপৈরতলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরুজ আলীকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।

এ ঘটনার রেশ না কাটতেই ঝিনাইদহে ৬৫ বছরের এক মুক্তিযোদ্ধাকে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ঘটনা যদিও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার পূর্বের। তা দেশব্যাপী ভাইরাল হয়েছে অনেক পরে। দল-মত নির্বিশেষে সবার মনে দাগ কেটেছে সে ভিডিও। ওই মুক্তিযোদ্ধাকে নির্যাতনের অভিযোগও স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধার নাম মোক্তার আহমেদ মৃধা।

ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার আবাইপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান তিনি। জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। ১৮ অক্টোবর সন্ধ্যার দিকে শৈলকুপার কবিরপুরে একটি ওষুধের দোকানের সামনে প্রথমে তার ছেলে খোরশেদ মৃধাকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে জখম করা হয়। এরপর ভেতরে বসা মুক্তার আহমেদ মৃধাকে নির্মম নির্যাতন করা হয়। তারা এখন ঢাকায় চিকিত্সাধীন আছেন।

আহত মুক্তিযোদ্ধা মোক্তার আহমেদ মৃধা জানান, আওয়ামী লীগ নেতা ও স্থানীয় এমপি আবদুল হাইয়ের ক্যাডাররা আমার ওপর হামলা চালায়। আমার অপরাধ আমি টেন্ডার জমা দিয়েছিলাম। তিনি জানান, এখন হামলাকারীরা সবাই আদালত থেকে জামিন নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনি আক্ষেপ করে আরো বলেন, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই নির্যাতনের শিকার হওয়ার আগে আমার মরে যাওয়া ভালো ছিল।

এর মধ্যে নতুন অঘটন ঘটেছে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে। ৬ ও ৭ নভেম্বর গাইবান্ধা জেলার সাহেবগঞ্জ ও বাগদা ফার্ম এলাকায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ ও বাঙালি কৃষকদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়। পুলিশের উপস্থিতিতে সেখানকার চিনিকল মালিকের সন্ত্রাসীরা তাদের বাড়িঘরে আগুন দেয়। গুলিতে চারজন সাঁওতাল নিহত হন।

তারা হলেন— শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মার্ডি, রমেশ টুডু এবং একজন আদিবাসী নারী, যার নাম জানা যায়নি। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ ও নাগরিক সমাজের ব্যানারে এর যথাযথ বিচার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন হয়েছে। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগ অতি দ্রুত তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এখানেও দলীয় কোন্দল ও দলীয় ইন্ধন রয়েছে বলে জানা গেছে। -মানবকণ্ঠ

১৩ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে