রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৬, ১০:২৭:১২

শুভ জন্মদিন হ‌ুমায়ূন আহমেদ, ‘স্যার বললেন, শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বেঁচে আছি’

শুভ জন্মদিন হ‌ুমায়ূন আহমেদ, ‘স্যার বললেন, শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বেঁচে আছি’

বিনোদন ডেস্ক : (আজ ১৩ নভেম্বর নন্দিত কথাসাহিত্যিক-নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। তাকে ঘিরে দিনভর টিভিতে-মঞ্চে-চত্বরে-অন্দরে অনেক আয়োজন-স্মৃতিচারণ। যেমনটা হয় প্রতিবছরই। তবে বাংলা ট্রিবিউন নন্দিত এই মানুষটির এবারের জন্মদিনকে ঘিরে খুঁজেছে নতুন কিছু। যার খোঁজ মিলেছে ওয়াহিদ ইবনে রেজার কাছে।

    হুমায়ূন আহমেদের ‘হিমু’র হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে যাকে প্রথম দেখা গিয়েছিল ২০০৭ সালে একুশে গ্রন্থমেলায়। হিমু চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদের ‘চন্দ্রকারিগর’ নাটকসহ আরও কয়েকটিতে। ‘হিমু’ চরিত্রের সূত্র ধরে পারিবারিকভাবে তাদের সম্পর্ক ছিলো খুব গভীরে। হুমায়ূন আহমেদ তাকে ডাকতেন বাপ্পি (ডাকনাম) নামে। এখন তিনি কানাডা প্রবাসী। সেখানে কাজ করছেন বিখ্যাত মেথড স্টুডিও’র প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে।

    তার স্মৃতিকাতর জবানিতে পড়ুন, হুমায়ূন আহমেদের জীবদ্দশায় শেষ জন্মদিনের কথোপকথন ও চোখ টলমল করা স্মৃতিকথা।)

হ‌ুমায়ূন স্যারের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ২০১১ সালে সিঙ্গাপুরে। আমার আম্মু তখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। আমি হাসপাতাল ডিউটিতে আছি। স্যার ফ্যামিলি নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। একই হাসপাতালে এসেছেন ডাক্তার দেখাতে। ওনার ভাষায়, ‘আসলামই যখন ভাবলাম এখানকার ডাক্তারদের একটু টাকা পয়সা দিয়েই যাই!’   

তিনি আর শাওন আপু মিলে আমার আম্মুকে দেখতে আসলেন কেবিনে। বললেন-
- কী, বাপ্পি সেবা করছে আপনাকে ঠিকঠাকমতোন?
আম্মু খুবই খুশি খুশি গলায় বললেন-
- নাহ নাহ, বাপ্পি অনেক করতাসে। খাওয়ায় দেয়, পা টিপে দেয়...
স্যার আমার দিকে তাকিয়ে এক গাল হাসি দিয়ে বললেন-
- বাহ্, তাহলে তো তোমার বেহেস্ত কনফার্ম!   

সেদিন রাতে সমুদ্রের পাড়ে এক বারবিকিউতে স্যারের দাওয়াত। আমাকেও যেতে বললেন। রাতে সেই সমুদ্রের পাড়ে প্রচণ্ড বাতাস। আমরা ঘাসে বসে গল্প করছি। আয়োজকরা কিছুটা বিপদে আছেন। বারবিকিউ মেশিনে আগুন ধরানো যাচ্ছে না। আয়োজক খোকন (আমি ওনাকে মামা ডাকি)। তিনি এসে আমাদের তরমুজ দিয়ে গেলেন। আমি গলা নামিয়ে স্যারকে বললাম-
- বারবিকিউ পার্টিতে মাংস খেতে এসে তরমুজ খেতে দিচ্ছে! লক্ষণ তো সুবিধার না স্যার। চলেন ঐ যে ম্যাকডোনাল্ডস দেখা যায়, দুইটা বার্গার খেয়ে ফেলি।
স্যার কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বললেন-
- ধুর মিয়া, তুমি মাথায় বার্গার ঢুকায়া দিলা!
তারপর শাওন আপুকে আবদার করে বললেন-
- কুসুম আমাদের জন্য দুইটা বার্গার নিয়ে আসো না, প্লিজ।
শাওন আপু বার্গার আনলেন, আমরা খেলাম। এরমধ্যে আগুন ধরে গেছে বারবিকিউ মেশিনে। আমরাও নড়েচড়ে বসলাম। পেটের বার্গার সরিয়ে জায়গা করতে হবে তো।
স্যারের পরদিন সকালে ডাক্তারের  অ্যাপোয়েন্টমেন্ট। আমি যেহেতু হাসপাতালেই, গেলাম দেখা করতে। তিনি কিছুটা কাতর গলায় বললেন-
- এক গ্যালোনের মতো রক্ত নিল। কেন বুঝলাম না।

অবশ্য সেটা নিয়ে তখন আর মাথা ঘামালেন না স্যার। পরদিন নিনিতের প্রথম জন্মদিন। সে তখন পুতুলের মতো সারাবাড়ি হামাগুড়ি দেয়। এমন একজনকে সঙ্গে নিয়ে কি জীবনের বাইরে অন্য কিছু চিন্তা করা যায়?
পরদিন আমি নিনিতের জন্মদিন উপলক্ষে কেক সাইজের একটা বিশাল বিস্কুট কিনে স্যার যেখানে উঠেছেন সেখানে যাব। ভাবলাম যাওয়ার আগে একটা ফোন দেই। ফোন করলাম। শাওন আপু খুবই চিন্তিত গলায় ফোনে বললেন-
- বাপ্পি, ব্লাড টেস্টের রেজাল্ট খুবই খারাপ এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে ক্যানসার।
আমি হতভম্ব গলায় বললাম-
- কী বলেন আপু!
- হ্যাঁ, কালকে আরেকটা টেস্ট করবে নিশ্চিত হবার জন্য।
আমি তারপরও কেক সাইজের বিস্কুট নিয়ে যন্ত্রের মতো হাজির হলাম। বাসার পরিস্থিতি স্বাভাবিক ভাবেই খুব থমথমে। একমাত্র স্যারই রসিকতা করছেন। উন্মাদের ভাষায় তিনি নাকি, ‘শ্যাষ!’ রসিকতা করছেন আর তার পাশাপাশি ক্যানসার নিয়ে পড়াশোনা করছেন। হঠাৎ কী জানি হলো। বমি চলে আসলো ওনার। শাওন আপু দুহাতে তা ধরলেন। মাটিতে পড়তে দিলেন না। আমি একটু পরেই উঠে চলে আসলাম। ওনাকে এমনভাবে দেখা ছিল আমার জন্য খুব কষ্টকর।
পরদিন টেস্ট হলো। আমি ছিলাম সেখানে। টেস্টের ফলাফল ক্যানসারই। ওই ফলাফল আসার আগেই এই বিশেষ ক্যানসার নিয়ে অনেকটুকু পড়ে ফেললেন স্যার। সিদ্ধান্ত হলো- নিউ ইয়র্কে যাবেন চিকিৎসা করাতে। পরের দিন ঢাকায় গেলেন, যার একদিন পরই খুব সম্ভবত নিউ ইয়র্কে যাত্রা। এদিকে আমার ইউনিভার্সিটির এক ঝামেলায় চলে আসতে হলো ভ্যাঙ্কুভারে একদিনের নোটিশে। ঢাকায় এসে আর তাই দেখা করতে পারলাম না স্যারের সঙ্গে।

স্যার যখন নিউ ইয়র্কে ছিলেন, প্রথম প্রথম কথা হতো ফোনে। পরে বুঝতে পারতাম, বেশ কষ্ট হচ্ছে তার কথা বলতে। আমি ওনার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম। মাঝেমাঝে ফোন দেই। শাওন আপুর সঙ্গে কথা হয়। উনি নিউ ইয়র্কে যেতে বলেন। বলেন-
- বাপ্পি, আস, ঘুরে যাও। আমি এখন স্টেক বানাতে পারি। বানিয়ে খাওয়াবো।
আমি বলি-
- আসবো, আসবো।
স্যারের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয় ওনার জন্মদিনে (১৩ নভেম্বর ২০১১)। সেদিন আমি বললাম-
- স্যার, কেমন আছেন?
তিনি ওনার স্বভাবসুলভ প্রাণোচ্ছ্বল ভঙ্গিতে বললেন-  
- শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বেঁচে আছি!
আমি হাসতে হাসতে বললাম-
- টাইট করে ধরে কোনওমতে এই বছরটা পার করেন। বছরটা খারাপ যাচ্ছে। পার করলেই নিশ্চিত।
উনি বললেন-
- সত্যি, তুমি বলছো?
আমি খুবই কনফিডেন্টলি বললাম-
- হ্যাঁ, স্যার বলছি।
উনি একটা হাসি দিয়ে বললেন-
- যাক, তাহলে তো নিশ্চিত!

আজকে (১৩ নভেম্বর ২১০৬) স্যারের জন্মদিন। তাই এই লেখাটি লেখা। স্যারকে নিয়ে কেউ আমার কাছে স্মৃতিচারণমূলক লেখা চাইলে আমি একটু বিভ্রান্ত হয়ে যাই। যে মানুষ আমার কাছে এখনও নক্ষত্রের মতো জীবন্ত, তাকে স্মৃতির পাতায় ফেলা আমার জন্য খুব মুশকিল হয়ে যায়। আরেকটা বিপদ হয়, যখন পত্রপত্রিকা ওনার সঙ্গে আমার ছবি ছাপায়। উনি একবার আমাকে বলেছিলেন, নিজের ছবি তুলতে উনি খুবই অপছন্দ করেন। তারপরও বাধ্য হয়ে ছবি তোলেন। আমি ওনাকে বলেছিলাম, আপনাকে তো কোনও কিছু দেওয়া সম্ভব না, আমি আপনাকে এই শান্তিটুকু দেব। আপনার সঙ্গে আমি কোনও দিনই জোর করে ছবি তুলবো না। আমার সঙ্গে তাই ওনার তেমন কোনও আনুষ্ঠানিক ছবি নেই। তবে এই গল্পগুলো আছে। চোখ বন্ধ করলেই আমি ওনার কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। ওনার মুচকি হাসি, মাথা নেড়ে নেড়ে কথা বলার ভঙ্গি, আমি দেখতে পাই।

এর বেশি আমার আর কিছুর প্রয়োজনও নেই। -বাংলা ট্রিবিউন।
১৩ নভেম্বর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে