রবিবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৫, ০৪:২০:৫৩

নিরাপত্তা নিয়ে অতি উদ্বেগ সন্দেহজনক

নিরাপত্তা নিয়ে অতি উদ্বেগ সন্দেহজনক

মেহেদী হাসান : শুধু বাংলাদেশে নয়, ব্রিটিশরা নিরাপদ নয় নিজ দেশেও। যুক্তরাজ্য সরকারের ওয়েবসাইটে শনিবার যাঁরা ঢুকেছেন তাঁরা দেখে থাকবেন, সে দেশেই সন্ত্রাসী হামলার প্রবল ঝুঁকি রয়েছে। দেশটির নিরাপত্তা সংস্থা- এমআইফাইভ তাদের জনগণকে সর্বদা সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়ে রেখেছে ওয়েবসাইটে। তবে বিশ্বের সর্বত্রই নিরাপত্তা নিয়ে পশ্চিমারা সতর্কতা অবলম্বন করছে এবং এ-সংক্রান্ত আলোচনায় এখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গই বেশি আসছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশের বাংলাদেশে নিরাপত্তা নিয়ে অতি উদ্বেগ ও সতর্কতায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাই শুধু নন, ঢাকায় বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরাও।

তাঁদের মতে, বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশই সন্ত্রাসের ঝুঁকিমুক্ত নয়। আবার হত্যাকাণ্ড, অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা নেই, এমন দেশও বর্তমানে বিরল। এরই মধ্যে নিরাপত্তাঝুঁকির প্রশ্ন তুলে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর বাতিলসহ পরবর্তী সময়ে ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গির উপস্থিতি নিয়ে কয়েকজন রাষ্ট্রদূতের অতি উৎসাহী ভূমিকা ও আগ্রহে তাঁদের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।

নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ভূ-রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, প্রভাবশালী পশ্চিমা দূতরা অস্বাভাবিক মাত্রায় উদ্বেগ দেখাচ্ছেন। এর সম্ভাব্য কারণগুলো হলো- দেশে কথিত আইএস বা অন্য জঙ্গি উত্থান ঠেকানোর সরকারি উদ্যোগে পশ্চিমাদের অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া, সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আইএসবিরোধী সামরিক জোটে অংশ নিতে বাধ্য করা ইত্যাদি।

কারো কারো মতে, এটি ভূ-রাজনীতির অংশ। অতীতে পশ্চিমা দেশগুলো জঙ্গি-সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দমন ও গণতন্ত্রায়নের নামে বিভিন্ন দেশে অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে নাক গলিয়েছে। পশ্চিমা ওই দেশগুলো এ দেশে অভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও অতি আগ্রহী। বিশেষ করে যে দেশগুলো এখন নিরাপত্তা নিয়ে অতি তৎপরতা দেখাচ্ছে, তারা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে কার্যত ব্যর্থ হয়েছিল। তারা এখন আবার সেই উদ্যোগ নতুন করে চালাচ্ছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা উচিত বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মত।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এ কে এম মোহাম্মদ আলী শিকদার প্রতিবেদককে বলেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর অতি উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে। ভূ-রাজনৈতিক ও করপোরেট স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের মতো কিছু দেশ বাংলাদেশে আইএস খুঁজছে। বাংলাদেশকে আইএসবিরোধী সামরিক জোটে ভেড়ানোর চেষ্টা চলছে। অতীতে তারা এমন স্বার্থ থেকেই ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, সোমালিয়াকে অস্থিতিশীল করেছে। কোনো কিছুই তাদের স্বার্থের বাইরে নয়।

তিনি বলেন, ত্রিমুখী আক্রমণে সিরিয়ায় আইএস যখন কোণঠাসা অবস্থায় আছে, তখন বাংলাদেশের মতো মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ব্যক্তি বিশেষের ওপর আইএসের হামলা চালানোর দায় স্বীকার বিশ্বাসযোগ্য নয়। আইএসের হামলা ও দায় স্বীকারের পদ্ধতির সঙ্গেও এর মিল নেই। আইএসের মতো গোষ্ঠী ব্যক্তি বিশেষের ওপর হামলা করে না; জিম্মি করে নানা শর্ত দেয়।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো যখন নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলে, এ দেশে আইএস আবিষ্কারের চেষ্টা করে, তখন আমাদের উদ্বিগ্ন না হয়ে কোনো উপায় নেই। কারণ এ দেশগুলো নিরাপত্তা ইস্যুকে ভিত্তি করে নানা ধরনের চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করে থাকে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ এই প্রতিবেদককে বলেন, নিরাপত্তা বিষয়ে কয়েকজন পশ্চিমা দূতের অতিকথন অত্যন্ত উদ্বেগের। খুব সম্ভবত তাঁরা দেশের ও বাইরের রাজনীতির স্বার্থে এ ইস্যুটি ব্যবহার করতে চাচ্ছেন। সিরিয়ায় আইএস ও আসাদবিরোধী পশ্চিমা সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর সম্ভাব্য পরিণতি এবং ভূরাজনীতির নতুন সমীকরণ এতে প্রভাব ফেলছে।

তিনি বলেন, পশ্চিমা যে দেশগুলো এখন নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলছে, তারাই কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরব ও তৎপর ছিল। দুই বিদেশি হত্যার ঘটনা ও নতুন হামলার আশঙ্কার কথা তুলে ধরে তারা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। তাই আমরা বলছি, হত্যা দুটির নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদেরও চিহ্নিত করা প্রয়োজন।

আবার পূর্ব দিকের একটি বৃহৎ দেশের একজন কূটনীতিক বলেন, বাংলাদেশে নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ, ইতালির নাগরিক হত্যা, অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর বাতিল, জাপানের নাগরিক হত্যা, পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের দৌড়ঝাঁপ- সব মিলে আবারও এখানে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের আভাস মিলছে।

তিনি বলেন, তিনি যত দূর জানেন, পশ্চিমা কয়েকটি দেশ বিশ্বের সর্বত্রই তাদের নাগরিকদের ওপর হামলার আশঙ্কা করেছিল। সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের নাম ছিল না। ঝুঁকি যদি থাকে তবে পুরো অঞ্চলেই আছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কেন আলাদাভাবে তুলে ধরা হচ্ছে তা অত্যন্ত প্রশ্নসাপেক্ষ। তাঁর মতে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রভাব পড়তে পারে এ দেশের সঙ্গে পশ্চিমাদের যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে।

এদিকে নিরাপত্তা-উদ্বেগ নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো যতটা সরব, ঠিক ততটাই নীরব অন্য দেশগুলো। পশ্চিমাদের কথিত নিরাপত্তা-ঝুঁকির মধ্যেও অন্য দেশগুলোর দূতাবাসগুলোতে স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে। এশিয়ার একটি দেশের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কূটনীতিক প্রতিবেদককে বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো এ ধরনের নিরাপত্তা পরামর্শ প্রায়ই দিয়ে থাকে। কিন্তু এগুলো এ দেশে যতটা প্রচার ও গুরুত্ব পাচ্ছে তা বিস্ময়কর। বাংলাদেশে যে ধরনের ঝুঁকির কথা পশ্চিমা কয়েকটি দেশ বলছে এবং অতি সম্প্রতি একটি দেশ বলছে, এমন ঝুঁকির কথা তারা আরো অনেক দেশে বলে থাকে। কিন্তু এটি নিয়ে সেসব দেশে এত ডামাডোল দেখা যায় না।

এ মাসের শুরুতেই ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত মা মিং ছিয়াং বলেছেন, বাংলাদেশ নিয়ে ভ্রমণ সতর্কতা জারির কোনো প্রয়োজন তাঁরা দেখছেন না।

নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়ে পশ্চিমা দূতাবাসগুলোর অবস্থানের সঙ্গে একমত নয় ঢাকায় আরব ও এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোও। বাংলাদেশে নিরাপদ বোধ করছেন কি না জানতে চাইলে ফিলিস্তিনের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ইউসেফ এস ওয়াই রামাদান প্রতিবেদককে বলেছেন, 'হ্যাঁ, আমি নিরাপদ। বাংলাদেশও নিরাপদ। তাই আমি এখানে আছি।'

গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেছেন, নাগরিকদের সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দিলেও তাঁরা তাঁদের নাগরিকদের বাংলাদেশে আসতে নিষেধ করেননি বা বাংলাদেশ ছেড়ে যেতেও বলেননি।

ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর গত শুক্রবার তাদের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ ভ্রমণ বিষয়ে হালনাগাদ তথ্যে সন্ত্রাসের প্রবল ঝুঁকি থাকার কথা উল্লেখ করে পশ্চিমাদের ওপর আবারও হামলার আশঙ্কা করেছে। সেই ওয়েবসাইটেই বেশ কয়েকটি দেশ ও অঞ্চলে উচ্চমাত্রার সন্ত্রাসের ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও সন্ত্রাসের ঝুঁকি আছে বলে মনে করে যুক্তরাজ্য।

যুক্তরাজ্য সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশটি অল্প, মাঝারি, জোরালো, প্রবল ও গুরুতর- এ পাঁচটি ক্যাটাগরিতে নিজ দেশে হামলার ঝুঁকি প্রকাশ করে। যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তা সংস্থা এমআইফাইভের ওয়েবসাইটে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায়ও যুক্তরাজ্যের ওপর আন্তর্জাতিক হামলার ঝুঁকি 'প্রবল' বলে উল্লেখ করে জনগণকে সর্বদা সাবধান থাকার পরামর্শ ছিল।

ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলোর মতে, এ ধরনের সাবধানতার পরামর্শ দেওয়া পশ্চিমা দেশগুলোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়গুলোর দৈনন্দিন কাজেরই অংশ। তবে বাংলাদেশে সম্প্রতি দুই বিদেশি হত্যার পর জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের নাম জড়িয়ে যাওয়া বিষয়টিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। বিশেষ করে কয়েকটি পশ্চিমা দেশের অতি সাবধানতা তাদের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আরেকজন অধ্যাপক ও ভূরাজনীতি বিশ্লেষক ড. দেলোয়ার হোসেনের মতে, পশ্চিমা যেসব দেশ অন্য দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে অনেক বেশি প্রতিক্রিয়াশীল, তাদের সঙ্গে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সরকারের কিছুটা দূরত্ব রয়েছে। দুই বিদেশি হত্যার পর তারা নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল নিয়ে থাকতে পারে।

ড. দেলোয়ার হোসেন আরো বলেন, বাংলাদেশে এমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি যে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটদলের সফর বাতিল করতে হবে। পশ্চিমা দেশগুলো সব সময় এক ধরনের 'ক্রিটিক্যাল অ্যাপ্রোচ' নিয়ে থাকে। সুশাসনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ওই দেশগুলোর সঙ্গে সরকারের মতপার্থক্য রয়েছে। নিরাপত্তা ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলো অনেক বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব হেমায়েতউদ্দিন এই প্রতিবেদককে বলেন, কোনো দেশই সন্ত্রাস, উগ্রবাদমুক্ত নয়। যে ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে, তা বিশ্বের অনেক দেশে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও ঘটে থাকে। তার ওপর বাংলাদেশে এ ধরনের প্রবণতা কম। এ দেশে বিদেশিদের সব সময় স্বাগত জানানো হয় এবং বিদেশিরাও নিশ্চিন্তে যাতায়াত করে।

হেমায়েত উদ্দিন আরো বলেন, দুজন বিদেশি হত্যার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক ও নিন্দনীয়। বিদেশি দূতাবাসগুলোরও অনুধাবন করা উচিত যে বাংলাদেশের জনগণ এসব হত্যাকে সমর্থন করে না। বিদেশিদের কাছে ওই হত্যাগুলোর বিষয়ে কোনো তথ্য থাকলে তা সরকারকে জানানো উচিত। কিন্তু বাংলাদেশ নিরাপদ নয়, ঝুঁকিপূর্ণ- এ ধরনের তথ্য দিয়ে রাষ্ট্রের মধ্যে ভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা দুঃখজনক ও অপ্রত্যাশিত।

ভূরাজনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মো. শাহীদুজ্জামান প্রতিবেদককে বলেন, 'নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের মূল্যায়নের সঙ্গে পশ্চিমা কয়েকটি দেশের মূল্যায়ন মিলছে না। বর্তমানে তাদের সঙ্গে আমাদের বৈরী কোনো সম্পর্ক নেই। হয়তো তারা এমন কোনো সূচক ব্যবহার করছে, যেটি আমরা করছি না।

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া এত কড়া না হলেও চলত। এ ধরনের পরিস্থিতি বিশ্বের অনেক স্থানে রয়েছে।

তৌহিদ হোসেন আরো বলেন, আমাদের অর্থনীতি, শ্রমবাজারে বহির্বিশ্বের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে বিদেশি ক্রেতাদের সফর বাতিল করা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। আমাদের নিজের কাছে স্বচ্ছ থাকতে হবে।-কালের কণ্ঠ
১১ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে