সোমবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১১:৩৪:২৫

‘বাবাকে ফিরিয়ে দিন, বাবাকে ছাড়া বাসায় ফিরে যাব না’, গুম হওয়া বাবার ছবি বুকে নিয়ে বলছে এই শিশু

‘বাবাকে ফিরিয়ে দিন, বাবাকে ছাড়া বাসায় ফিরে যাব না’, গুম হওয়া বাবার ছবি বুকে নিয়ে বলছে এই শিশু

নিউজ ডেস্ক : ‘বাবাকে ছাড়া ভালো লাগে না। মা বলে, বাবা বিদেশে গেছে। ফিরে আসবে, আমাকে স্কুলে নিয়ে যাবে। বন্ধুরা সবাই তার বাবাকে নিয়ে ক্লাস পার্টিতে যায়। আমিও বাবার সঙ্গে স্কুলে যেতে চাই। আপনারা আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন। আমি বাবাকে ছাড়া বাসায় ফিরে যাব না।’ এভাবেই বাবাকে ফিরে পাওয়ায় আকুতি জানায় মোহাম্মদ সোহেল ওরফে চঞ্চলের একমাত্র ছেলে আবদুল আহাদ। তার কান্নায় সম্মেলন কক্ষের পরিবেশও ভারি হয়ে উঠে। হলভর্তি স্বজনরাও কেঁদে উঠেন ছোট্ট শিশু আহাদের সঙ্গে। শুধু আহাদ নয়, বাবার সন্ধানে পরিবারের সঙ্গে এ অনুষ্ঠানে এসেছিল নিখোঁজ কাওসারের মেয়ে লামিয়া আক্তার মিম ও এমএ আদনান চৌধুরীর ছেলে আরিয়াম।

চঞ্চলের মা হাজেরা বেগম জানান, তিন বছর আগে রাজধানীর পুরান ঢাকার বংশালের বাসা থেকে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় চঞ্চলকে। শুধু চঞ্চল নয়, তিন বছর আগে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ২০ জনকে পুলিশ, র‌্যাব পরিচয়ে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা তাদের স্বজনদের ফিরে পেতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

তিন বছর আগে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে একরাতে র‌্যাব পরিচয়ে চারজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের একজন আবদুল কাদের ভূঁইয়া মাসুদ। মাসুদের মা আয়েশা আক্তার বলেন, তিতুমীর কলেজের তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করত ছেলে। র‌্যাব পরিচয়ে ছেলেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় বলা হয়, আমরা প্রশাসনের লোক, আপনার ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছি। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব। তিন বছর হয়ে গেলেও আজও ফিরল না মাসুদ। মাসুদের অপরাধ, সে ছাত্রদলের রাজনীতি করত। এ রাজনীতি করার কারণেই গুম করা হয় তাকে।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে এ মা বলেন, তার বিরুদ্ধে থানায় কোনো অভিযোগ নেই। কোনো অভিযোগ থাকলেও দেশে আইন, আদালত আছে। সে কোনো অপরাধ করে থাকলে শাস্তি হোক। কিন্তু এভাবে বছরের পর বছর ছেলেকে ছাড়া মা হিসেবে কীভাবে বেঁচে আছি বোঝাতে পারব না।

২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকায় ২৫নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনসহ গুম হন আটজন। একই বছর বিভিন্ন এলাকা থেকে গুম হন আরও ১২ জন। গুম হওয়া ২০ পরিবারের মা-বাবা, ভাই-বোন ও স্ত্রী তাদের স্বজনদের ফিরে পেতে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আসেন। তাদের দাবি, প্রধানমন্ত্রী নিজেও একজন মা। তিনি স্বজন হারিয়েছেন। তিনি স্বজনহারাদের মনের কষ্ট বুঝেন। তাই গুম হওয়া পরিবারগুলোর দিকে তাকিয়ে তাদের জীবিত ফিরিয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।

সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা খাতুন বলেন, আমরা আর কত দাবি জানাব। কত অপেক্ষা করলে ছেলেকে ফিরে পাব। আর কত কাঁদলে তাদের মন নরম হবে, ছেলেকে ফিরিয়ে দেবে। সুমনের বোন আফরোজা ইসলাম আঁখি জানান, নিখোঁজ ভাইকে ফিরে পেতে র‌্যাব, পুলিশের দ্বারে দ্বারে তিন বছর ধরে ঘুরছি। প্রথম দিকে অনেকে পাশে থাকলেও আজ নেই। আস্তে আস্তে আপনারও পাশ থেকে চলে যাবেন। এভাবে হয়তো একদিন এই গুম হওয়া ২০ ভাইকে ভুলেই যাবেন আপনারা। কিন্তু আমাদের পরিবারগুলো এ কষ্ট বুকে নিয়েই বেঁচে থাকবে। তিনি বলেন, ২০ ভাইকে ফিরে পেতে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ, র‌্যাব এমনকি জাতিসংঘেও দাবি জানিয়েছি। তারপরও কোনো লাভ হচ্ছে না।

ছাত্রদলের নেতা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আশাদুজ্জামানের বড় বোন মিনারা বেগম বলেন, রংপুর থেকে ভাইকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলাম। পরিবারের স্বপ্ন ছিল সে পড়াশোনা করে পরিবারের হাল ধরবে। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করে চাকরি খুঁজছিলেন ভাই। এ সময় তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তিন বছর ভাইয়ের সন্ধান পেলাম না। কিছুদিন আগে স্বামীও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আর কত অপেক্ষা করব। এ মাসে বাসা ছেড়ে দিয়েছি, গ্রামে চলে যাব। গ্রামে ফিরে গেলেও আশায় থাকব ভাই ফিরবে।

সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি সোলেমান রেজাকেও সেই সময় তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তার বাবা সোলেমান রেজা বলেন, আমরা আর অপেক্ষা করতে পারছি না। ছেলেকে জীবিত ফিরে পেতে চাই। আর যদি মেরে ফেলা হয়, তাহলে ছেলের কবরের মাটি দেখতে চাই।

অনুষ্ঠানে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের কর্মকর্তা মোহাম্মদ রানা জানান, তিন বছরে সারা দেশে ৩ শতাধিক লোক বন্ধুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এটা চলতে পারে না। গুম বন্ধ করতে হবে। কেউ অপরাধী হলে দেশের প্রচলিত আইনে তার বিচার করার সুযোগ রয়েছে।

গুম হওয়া ২০ জন : সাহেদুল ইসলাম সুমন, জাহিদুল করিম তানভীর, আবদুল কাদের ভূঁইয়া, মাজহারুল ইসলাম, আশাদুজ্জামান, আল আমিন, এমএ আদনান চৌধুরী, কাওসার আহমেদ, সেলিম রেজা পিন্টু, খালিদ হাসান সোহেল, সম্রাট মোলআর, জহিরুল ইসলাম, পারভেজ হোসেন, মো. সোহেল, সোহেল ওরফে চঞ্চল, নিজাম উদ্দিন মুন্না, তরিকুল ইসলাম, মাহবুব হাসান সুজন, কাজী ফরহাদ ও তরিকুল ইসলাম। -যুগান্তর।
০৫ ডিসেম্বর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে