আমীর খসরু : সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের কয়েকটি দেশে চলমান যুদ্ধের পরিস্থিতিতে ওই সব দেশের সাধারণ মানুষ নিদারুণভাবে আক্রান্ত, তাদের জীবন বিপর্যস্ত, ভবিষ্যৎ বিপন্ন। যুদ্ধপীড়িত সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান, ইয়ামেনসহ কয়েকটি দেশ আছে যাতে ওই সব যুদ্ধের আসল কুশীলবরা বহিঃদেশীয়।
যে কোনো যুদ্ধই সাধারণ মানুষকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে; এখন ওই সব দেশেও তাই ঘটছে। এ কথাটি বলা যেতে পারে যে, গণতন্ত্রের দীর্ঘকালীন অনুপস্থিতি এবং জনগণকে পরিপূর্ণভাবে উপেক্ষা করার কারণে এসব যুদ্ধ ত্বরান্বিত হয়েছে। এ কথাও ঠিক, অন্যদের যুদ্ধ হচ্ছে ওই সব দেশের মাটিতে; আর সাধারণ মানুষ হচ্ছে এর অনিবার্য একমাত্র ভিকটিম।
পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারেও একটি ‘যুদ্ধ’ চালানো হচ্ছে একপক্ষীয়ভাবে; তবে সে যুদ্ধটি প্রথাগত বা ট্রাডিশনাল ধারণা থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। ওই দেশের শাসকরা নিজ দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চলমান এই যুদ্ধের নাম দিয়েছে ‘শত্রু নিধন’। বিশ্বের অন্যান্য স্থানে যা ঘটছে তার সঙ্গে এই হত্যাযজ্ঞটিকে পুরোপুরি এক এবং অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের বা চরিত্রের তা কখনোই বলা যাবে না। মিয়ানমারে যা চলছে তা হচ্ছে, ঠাণ্ডা মাথায় গণহত্যা।
একটি জাতিসত্তার বিরুদ্ধে, জাতিটিকে নির্মূল করার একপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ চলছে। অসংখ্য মানুষ নিহত হচ্ছেন; গ্রাম-নগর-জনপদ পুড়ছে, লুট হচ্ছে; মানুষ দেশান্তরী হচ্ছেন। খ্রিস্টপূর্ব তিনশ বছর আগে দার্শনিক পণ্ডিত চাণক্য বলেছিলেন, ‘যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী এবং শিশু’। এর ভয়াবহ দিকটা আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রতিনিয়ত।
মিয়ানমারের এই চলমান গণহত্যা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে একটি বিষয় উল্লেখ করতেই হবে, এই গণহত্যাটি যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার জন্য বিচ্ছিন্নভাবে চালানো হচ্ছে তা নয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তেই গণহত্যাযজ্ঞের বাস্তবায়ন কাজটি চালাচ্ছে সে দেশটি নানা পন্থায়।
শুধু একজন অতিকট্টর সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধভিক্ষুর ইন্ধনেই এবং নেতৃত্বে বৌদ্ধভিক্ষুরা ও বৌদ্ধ মৌলবাদী কিছু লোকজন এই হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে-এমন প্রচারণা কেউ কেউ করতে চাইলেও এটা সত্য নয়। বরং বাস্তব হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এমনটা যে কোনোক্রমেই সম্ভব নয় তা স্পষ্ট। এক্ষেত্রে দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর বেসামরিক নেত্রী অং সান সু চির ভূমিকা যে রীতিমতো ভয়ঙ্কর এবং নিকৃষ্ট তা স্পষ্ট হয়ে গেছে।
এককালের মিয়ানমার এবং হালের মিয়ানমারে এই ধরনের গণহত্যা সব সময়ই কম বেশি চলেছে। ৭০ এবং ৯০-এর দশকে লাখ লাখ মানুষ বাস্তচ্যুত হয়েছে মূলত আরাকান এলাকা থেকে। ২০১২ সালেও এমনটা ঘটেছে। ২০১৪ সাল থেকে এই পর্যন্ত দফায় দফায় গণহত্যা চলছে। জাতিসংঘ, আসিয়ান এবং এর ভুক্ত দেশগুলোসহ পশ্চিমি দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা এর প্রতিবাদ করলেও তা যে জোরালো ও সোচ্চার নয় তা বোঝাই যাচ্ছে।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অনেকেরই ধারণা, বিশেষ করে পশ্চিমি দুনিয়ার দেশগুলো যতটা না নিজ স্বার্থ আদায়ের জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে ‘নতুন গণতন্ত্র’প্রাপ্ত মিয়ানমারে অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ আর অর্থনৈতিক লোভের কারণে; ঠিক তেমনভাবে তারা সোচ্চার নয় মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। তাদের কাছে তাহলে কি মানবাধিকারের চেয়েও নিজ স্বার্থ বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে সাম্প্রতিক এবং অতীতের অনেক ঘটনাবলির মতোই।
এ কথাটি সত্য যে, বিভিন্ন দেশে যেমন উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক উত্থান এবং ফলশ্রুতিতে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটেছে, মিয়ানমারকে সে অবস্থা থেকে এখন আর মোটেই আলাদা করা যাবে না। মিয়ানমার অচিরেই এসব কারণে অনিবার্যভাবে বিপন্ন, বিপর্যস্ত হবে এটাও নিশ্চিত। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মিয়ানমারের ‘নব্য গণতন্ত্র’।
মিয়ানমারের চলমান ঘটনাবলিতে ধর্মের মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব ও সাম্প্রদায়িকতার জোশ মিয়ানমারের সমাজে ইতিমধ্যে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তারী ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে। ওই সাম্প্রদায়িকতার ছোঁয়া ইতিমধ্যে বাংলাদেশে লেগেছে এবং বর্তমানে যা ঘটছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে আরও ঘটবে তাতে সন্দেহ নেই। এটা মনে রাখতে হবে, ১৯৬২ থেকে মিয়ানমারে সামরিক শাসন চলেছে। সামরিক শাসনোত্তর বেসামরিক শাসকদের সময়ে এহেন গণহত্যা এবং সংখ্যালঘু নিধন চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ওই দেশটিতে বেসামরিক শাসন আবারও বিপন্ন হবে।
আরেকটি বিষয়ও আলোচনার দাবি রাখে। উগ্র জাতীয়তাবাদীদের উত্থান পুরো আঞ্চলিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভারসাম্যকে বিপদাপন্ন করবে। এর সুযোগ মিয়ানমারের বর্তমানের বন্ধু ও সহযোগী হিসেবে কাজ করা পশ্চিমা শক্তিও যে নেবে তাও অচিরেই স্পষ্ট হবে।
এক্ষেত্রে মাও সেতুং ১৯৩৮ সালের মে মাসে যুদ্ধ সম্পর্কে বলেন, ‘যুদ্ধ হচ্ছে রাজনীতির ধারাবাহিক রূপ, এই অর্থে যুদ্ধই হচ্ছে রাজনীতি এবং যুদ্ধ নিজেই রাজনৈতিক প্রকৃতির কার্যকলাপ। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে এমন একটা যুদ্ধও ঘটেনি, যার কোনো রাজনৈতিক প্রকৃতি ছিল না...। ’’ (রেড বুক, র্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন, কলকাতা ১৯৯৭)।
দুই.
মিয়ানমারে যে গণহত্যা চলছে তার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নানামাত্রিকভাবে পড়েছে প্রতিবেশী বাংলাদেশের ওপরে। ১৯৭৮ সালে দলে দলে মিয়ানমারের শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সরকারি হিসাবের চেয়ে বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা অনেক বেশি। ওই সময় এবং পরবর্তীকালে আড়াই থেকে পাঁচ লাখ বর্মি রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
পরে ওআইসিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলাদেশ দেনদরবার শুরু করলেও তেমন কোনো কাজই হয়নি। বরং দিনে দিনে এই সংখ্যা বেড়েছে এবং বাড়ছে। গত কয়েক দিনেই জাতিসংঘের হিসাবে কমসেকম ১০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী নানা বাধা সত্ত্বেও বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এ দেশে যেসব রোহিঙ্গা এসেছে তাদের একটি অংশ সরকার পরিচালিত ক্যাম্পে না থেকে মিশে গেছে বাংলাদেশিদের মধ্যে।
জঙ্গি এবং উগ্র মৌলবাদী কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার নজিরও তাদের কেউ কেউ স্থাপন করেছে। তাছাড়া বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছে বিশাল অংশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এখানে আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার যুদ্ধে পাকিস্তানের পেশোয়ারসহ বিভিন্ন স্থানে আফগান শরণার্থীরা যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল ওই সময়ে এবং পরবর্তীকালে, সে কথাটি বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকদের স্মরণে রাখা উচিত।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি বড় ধরনের দুর্বলতা হচ্ছে : বাংলাদেশ যতটা প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ করে থাকে, দুই দেশের মধ্যকার যোগাযোগ ও নৈকট্য যতটা গাঢ় ও দৃঢ়— মিয়ানমার অপর প্রতিবেশী দেশ হওয়া সত্ত্বেও সম্পর্কের দূরত্ব অনেক অনেক দূরের। এই দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে রয়েছে যোজন যোজন ফারাক।
বাংলাদেশের দিক থেকে যেভাবে সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী হয়ে উদ্যোগী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা ছিল— তা বাংলাদেশ কখনোই করেনি। বিভিন্ন সময়ে এমন প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলেও ঢাকা বরাবর নিশ্চুপ থেকেছে অথবা এড়িয়ে গেছে। ১৯৭৮ সালে এবং পরবর্তী কয়েকটি সময়ে মিয়ানমারের সঙ্গে চলনসহ সম্পর্ক রক্ষার জন্য বাংলাদেশ চীনের শরণাপন্ন হলেও, সরাসরি মিয়ানমারের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্কটুকু গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বাংলাদেশ থেকে যোজন যোজন দূরত্বের একটি দেশ মিয়ানমার থাইল্যান্ড থেকে জাপানসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের যত সুসম্পর্ক গড়ার চেষ্টা রয়েছে, মিয়ানমারের সঙ্গে তার ছিটেফোঁটাও নেই। অথচ বাংলাদেশ ‘লুক ইস্ট পলিসি’ গ্রহণ করলেও মিয়ানমার যেন রয়ে গেছে অতিদূরত্বের কোনো একটি দেশ হিসেবে।
এ কথাটিও স্মরণ করা জরুরি যে, মিয়ানমার চীনের প্রভাব বলয়ে থাকার পরও ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল সপ্তম দেশ হিসেবে। ১৯৭২ সালেই বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেঙ্গুন সফর করে সম্পর্কোন্নয়নের আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল বাণিজ্য চুক্তি।
২০১১ সালের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমার সফর করেন এবং সে সময় সম্পর্কোন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল। ২০০১ সালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও মিয়ানমার সফর করেছিলেন। এর আগে পরে নামকাওয়াস্তে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাংলাদেশের শাসকদের মনোজগতে, মনস্তত্ত্বে রয়ে গেছে অনেক অনেক দূরত্ব সৃষ্টির একটি প্রয়াস।
অথচ ভারতের কথিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া সংক্রান্ত ঘটনায় দিল্লি-রেঙ্গুন সম্পর্কে দীর্ঘ টানাপড়েন ও দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল। এখন ভারতের উদ্যোগেই মিয়ানমার এবং ভারতের সম্পর্ক অতিমাত্রায় চমৎকার ও উন্নততর। এক্ষেত্রে ভারতই তাদের ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর স্বার্থে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ নিয়ে সফলও হয়েছে।
ভারত এই সম্পর্কোন্নয়ন প্রচেষ্টায় নিঃসন্দেহে নানামুখী সাফল্য অর্জন করেছে, তা স্বীকার করতেই হবে। চীন মিয়ানমারের বঙ্গোপসাগরীয় পোর্ট সিতওয়ে পাবে এমন প্রত্যাশায় অর্থ ব্যয় করলেও শেষ পর্যন্ত ভারত ওই সমুদ্র বন্দরটি পেয়ে যায়; যদিও এটি একটি ছোট উদাহরণ মাত্র। তাছাড়া বর্তমানে ভারত এবং মিয়ানমারের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের নানা দিক নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে ও অগ্রগতিও সন্তোষজনক বলে বিশ্লেষকরা বলছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কোথায় দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ?
কূটনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য বয়ান রয়েছে; আর তা হচ্ছে- ‘কে প্রতিবেশী হবে তা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। কোন রাষ্ট্র বন্ধু হবে তা নির্ধারণ করা গেলেও, প্রতিবেশী নির্ধারণ করা যায় না। ’ বাংলাদেশকে এই বিবেচনায় পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করতে হবে এবং চালাতে হবে কূটনৈতিক উদ্যোগ। কিন্তু সীমাহীন দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এখানেই রয়েছে বাংলাদেশের বিশাল ঘাটতি। বিডি প্রতিদিন
১১ ডিসেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস