শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ০১:৪৬:৫৫

দুর্বল প্রার্থী, ভঙ্গুর দলে বিএনপির ভরাডুবি

দুর্বল প্রার্থী, ভঙ্গুর দলে বিএনপির ভরাডুবি

মাহমুদ আজহার : স্থানীয় নেতা-কর্মীদের চোখে দল মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান ছিলেন ‘দুর্বল’ প্রার্থী। সেখানকার সাংগঠনিক কাঠামোও ‘অত্যন্ত দুর্বল’। মহানগর, জেলা, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিটি পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়। কেন্দ্রীয় নেতারা টের পেয়েছেন প্রচার চালাতে গিয়ে।

যতক্ষণ কেন্দ্রীয় নেতারা প্রচারে ছিলেন, স্থানীয় নেতাদের ততক্ষণই দেখা গেছে। এর মধ্যে আবার নারায়ণগঞ্জে বিএনপির দুই সাবেক এমপি আবুল কালাম ও গিয়াসউদ্দিনের ব্যস্ততা ছিল দুই ছেলের কাউন্সিলর নির্বাচন নিয়ে। প্রভাবশালী নেতা অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের ছিল ‘রহস্যময়’ ভূমিকা। তার ভাইও নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে জয়ী হন।

সাধারণ মানুষ থেকে স্থানীয় নেতাদের বিচ্ছিন্নতা আর অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রার্থীর কারণেই বিএনপির ভরাডুবি বলে মনে করা হচ্ছে। তবে নির্বাচনে পরাজয়ের ‘নেপথ্যের’ কারণ খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। দলীয় নেতাদের কোনো গাফিলতি প্রমাণ হলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানা গেছে। তবে নির্বাচনের ফলাফলে বিএনপির হাইকমান্ড খুবই হতাশ ও বিস্মিত বলে জানা গেছে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬১১ ভোট। তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী সাখাওয়াতের ধানের শীষ পেয়েছে ৯৬ হাজার ৪৪ ভোট। প্রায় ৮০ হাজার ভোটের ব্যবধানে আইভীর কাছে পরাজিত হন সাখাওয়াত। সূত্রে জানা যায়, এ ফলাফলে বিস্মিত ও হতাশ বিএনপির হাইকমান্ড। দলের নীতিনির্ধারকরা এমন ফলাফলের প্রত্যাশায় ছিলেন না।

এত প্রচারণা ও জনগণের এত সমর্থন থাকার পরও বিশাল ব্যবধানে পরাজয়ের কারণ খুঁজছে দলটি। এখন দলটি আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়েও নানা ধরনের বিশ্লেষণ করছে। তবে এ নির্বাচনে বড় ধরনের কোনো কারসাজি হয়েছে কিনা, তা নিয়েও নানা শঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা। এজন্যই পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান করতে সংশ্লিষ্ট নেতাদের দায়িত্ব দিয়েছেন বিএনপিপ্রধান। খুব শিগগিরই দলের একটি প্রতিনিধি দল নারায়ণগঞ্জে যাবে। সেখানে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে একটি প্রতিবেদন জমা দেবেন বেগম জিয়ার কাছে।

জানা যায়, বিএনপির মহানগর কমিটি হয়েছিল ২০০৯ সালে। এরপর মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই চলছে। একই অবস্থা জেলারও। অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকে সভাপতি ও কাজী মনিরুজ্জামান মনিরকে সাধারণ সম্পাদক করে পাঁচ সদস্যের কমিটি হয় একই সময়ে। থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিটিও নামকাওয়াস্তে। এখন আবার চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদে চলে যান তৈমূর আলম খন্দকার। জেলার প্রধান না থাকায় নেতৃত্বশূন্যতাও চলছে। নির্বাচনে স্থানীয় নেতৃত্বশূন্যতাকেও ছোট করে দেখা হচ্ছে।

এদিকে নারায়ণগঞ্জে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, তাদের কাছে সাখাওয়াত হোসেন খানের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। মেয়র হিসেবে যখন তাকে প্রার্থী করা হয়, তখন স্থানীয় নেতাদের বড় অংশই বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু কেন্দ্র থেকে সাখাওয়াতের পক্ষেই কাজ করতে বলা হয়। এ ব্যাপারে জেলার নেতা জানান, বিএনপির মতো এত বড় দলের দুর্ভাগ্য এমন একজন প্রার্থী বাছাই করা। মেয়র প্রার্থী হওয়ার যে যোগ্যতা তা ছিল না সাখাওয়াতের।

জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার সাংগঠনিক দুর্বলতাকে মানতে নারাজ। তিনি বলছেন, ‘সাংগঠনিক দুর্বলতা থাকলে সাখাওয়াত ৯৬ হাজার ভোট পান কী করে? তবে প্রার্থী বাছাইয়ে আমাদের ভুল ছিল। তিনি অনেকটাই অপরিচিত। স্থানীয় অধিবাসীও নন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি কোনো ভোট টানতে পারেননি। তা ছাড়া বিগত সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে তার কোনো ভূমিকা ছিল না। ’

তিনি আরও বলেন, ‘সাত খুন মামলার আলোচিত আইনজীবীর তকমাও কাজে লাগেনি। যার কারণে মামলার বাদীর স্ত্রী পরাজিত হয়েছেন আসামির কাছে। এটাও জনগণ খায়নি। প্রতীক নিয়ে কলাগাছ দাঁড়ালেও বিজয়ী হয়, এ ধারণাও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ’ তবে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলছেন অন্য কথা।

তার মতে, ‘দৃশ্যত গতকালের (বৃহস্পতিবার) নির্বাচনটা ফেয়ার, ফলাফলটা আনফেয়ার। এই ফলাফল অপ্রত্যাশিত এবং বিশ্বাসযোগ্য নয়। নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকবেই। ভোটের ফলাফলের যে ব্যবধানটা এটা অত্যন্ত অবিশ্বাস্য। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আজকের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এরশাদ মিডিয়া ক্যু করছেন। আমি উনার সুর ধরেই বলতে চাই, এই ফলাফলটাও মিডিয়া ক্যু। একটা প্রবাদ আছে, চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা, যদি না পড়ে ধরা। আমাকে এ আলামতই খুঁজতে হবে, এই ফলাফলটা কীভাবে তৈরি হলো ও ফলাফলটা কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা (গণমাধ্যম) প্রচার করল, প্রকাশ করল। এখন আমার একটা দায়িত্ব যেহেতু আমার জবাবদিহিতার ব্যাপার আছে— এটা বের করার। ’

নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত ফলাফল মানছেন কিনা— জানতে চাইলে নাসিক নির্বাচনের সমন্বয়ক বলেন, ‘ওই যে বলে না, ফুল ফুটুক বা নাই ফুটুক— আজ বসন্ত। আমরা মানি বা না মানি আইভী মেয়র। কিন্তু আমাদের যে প্রশ্নগুলো তা থেকেই যাবে। ’ তবে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ‘সূক্ষ্ম’ কারচুপির অভিযোগ তুলেছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান।

তিনি বলেছেন, ‘ভোটের হিসাবটুকু শুধু উল্টো করে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে দিনদুপুর সাড়ে ৩টায় মাত্র ২০-২৫ পার্সেন্ট ভোট কাস্ট হয়েছে দেখলাম। কিন্তু তখনই দেখলাম ভোট কাস্ট হয়ে গেছে ৬২ পার্সেন্ট। এ ছাড়া ১৪৪টি কেন্দ্রে আমার পোলিং এজেন্টকে কোনো রেজাল্ট শিট বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। ’ এদিকে দলের মেয়র প্রার্থীর কোনো সংবাদ সম্মেলন না হলেও সাবেক এমপি আবুল কালামের কাউন্সিলর প্রার্থী ছেলে পরাজয়ের জন্য সংবাদ সম্মেলন করেছেন।

কারসাজির অভিযোগ তুলে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবে আশা অভিযোগ করেন, বাহ্যিক দৃষ্টিতে নির্বাচনটি সুন্দর হয়েছে। অভিযোগ করার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু স্ট্রাইকিং ফোর্স ভোট কেন্দ্রের বাইরে কাউকেই দাঁড়াতে দেয়নি। এই সুযোগে কেন্দ্রের ভিতরে কারসাজি হয়েছে। আশা আরও অভিযোগ করেন, অতীতে কেন্দ্র দখল করে সিল মারা হতো। এখন কেন্দ্রের বাইরে বিজিবি ও র‌্যাবকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে রেখে ভিতরে অন্য কিছু করা হয়। বিডি প্রতিদিন

২৪ ডিসেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে