বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৫, ১২:২৩:৩০

কেন্দ্রের নির্দেশনা লঙ্ঘিত বিএনপির তৃণমূলে

কেন্দ্রের নির্দেশনা লঙ্ঘিত বিএনপির তৃণমূলে

কাফি কামাল/কাজী সুমন : দল পুনর্গঠনে কেন্দ্রের নির্দেশনা লঙ্ঘন করছেন বিএনপির জেলা নেতারা। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসের আন্দোলনের পর সাংগঠনিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে পুনর্গঠনের প্রস্তাব আসে দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে কিছু নির্দেশনাসহ পুনর্গঠন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ৯ই আগস্ট কেন্দ্র থেকে জেলা নেতাদের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়। এ কাজের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয় ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। সে চিঠি এবং সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে কয়েকটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে দলের সকল পর্যায়ে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি পুনর্গঠনের তাগিদ দেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

কিন্তু তৃণমূলে কাউন্সিল করতে গিয়ে প্রথমেই প্রশাসনের বাধার মুখে পড়ে দলটি। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকবে সে প্রতিবন্ধকতা। কখনও অনুমতি জটিলতা, কখনও সম্মেলনস্থলে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। ভোলাসহ কয়েক জায়গায় সম্মেলন বা সম্মেলনের প্রস্তুতিকালে একাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এতে বাধাগ্রস্ত হয় পুনর্গঠন কার্যক্রম।

এদিকে পুলিশি বাধার পাশাপাশি দলের অভ্যন্তরেও প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে বিএনপির পুনর্গঠন উদ্যোগ। নানামুখী বাধার ভেতর দিয়ে কিছু কিছু জেলা-উপজেলায় নেতাকর্মীরা কাউন্সিল সম্পন্ন করতে পারলেও জেলার শীর্ষ নেতাদের ইচ্ছার কাছে চাপা পড়ছে কাউন্সিলের মতামত।

দলের ৩৭তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর আলোচনা সভায় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে বলেছিলেন, আপনারা যার যার এলাকায় গিয়ে নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। দয়া করে ঢাকায় বসে পকেট কমিটি করবেন না। পকেট কমিটি করলেও আমি বিশ্বাস করবো না। কিন্তু বাস্তবে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের এমন নির্দেশকেও আমলে নেননি সংশ্লিষ্টরা। উল্টো কাউন্সিলে ওঠে আসা মতামতের ভিত্তিতে কমিটি গঠনের চেষ্টা করলেই বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন জেলার শীর্ষ নেতারা। তারা চাইছেন, আগের কমিটির নেতৃত্ব ঠিক রেখে নতুন কয়েকজনের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে পুনর্গঠন। আন্দোলন-সংগ্রামে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে ও দলে প্রভাব বলয় ধরে রাখতেই অনুগতদের দিয়ে কমিটি গঠনের এ চেষ্টা করছেন তারা।

অভিযোগ ওঠেছে, তৃণমূল কমিটি পুনর্গঠনের সুযোগে রমরমা বাণিজ্যে নেমেছেন জেলা বিএনপি নেতারা। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কড়া হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে পকেট কমিটি দিচ্ছেন তারা। দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে সরাসরি কমিটি বেচাকেনার অভিযোগ তুলেছেন তৃণমূল নেতারা। মারামারির ঘটনাও ঘটেছে কয়েক জায়গায়। ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পুনর্গঠন সম্ভব হয়নি কোন জেলায়। নতুন করে সময়ের আবেদন করলেও কার্যত জোরদার হয়নি কার্যক্রম। কোন কোন ক্ষেত্রে পকেট কমিটি গঠনে জেলা নেতারা সুযোগ নিচ্ছেন প্রশাসনের প্রতিবন্ধকতার। তৃণমূল নেতাকর্মীদের অন্ধকারে রেখে রাজধানীতে বসেই এসব কমিটি দেয়া হচ্ছে। এতে কেন্দ্রের নির্দেশনা লঙ্ঘিত হওয়ার পাশাপাশি ব্যাহত হচ্ছে পুনর্গঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

গাজীপুর জেলা বিএনপির কয়েকজন নেতা জানান, প্রতিকূলতার মধ্যেও কয়েকটি উপজেলায় কাউন্সিল অনুষ্ঠান করেছে তৃণমূল বিএনপি। সেখানে নতুন নেতৃত্বের নাম ওঠে এলেও জেলা বিএনপির সভাপতি সম্মেলনের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত কমিটিকে অনুমোদন দিচ্ছেন না। একজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলন দলের একজন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে চাইছেন, বর্তমান কমিটি অক্ষুণ্ন রেখে নতুন কয়েকজনের নাম অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে পুনর্গঠন। কারণ সম্মেলনের মতামতকে গুরুত্ব দিলে নেতৃত্ব যাবে নতুনদের হাতে।

তার প্রতিবন্ধকতার কারণে সম্মেলনের পরও আটকে আছে কয়েকটি উপজেলা বিএনপির নতুন কমিটি অনুমোদন।

বিএনপির পুনর্গঠন নিয়ে তৃণমূলের অভিযোগ প্রসঙ্গে দলের স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, এ ধরনের অভিযোগ আমার কাছেও এসেছে। বিষয়টি অভিযোগ আকারে দলের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকেও অবহিত করা হয়েছে বলে জেনেছি। আমি সংশ্লিষ্টদের বলেছি- কেন্দ্র থেকে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সে অনুযায়ীই কাজ করতে হবে। সংগঠনের ৮০-৯০ ভাগ নেতা যেভাবে চান সেভাবেই পুনর্গঠন হওয়া উচিত এবং সেখানে তথাকথিত কেন্দ্রীয় বা সিনিয়র নেতাদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা উচিত হবে না। হান্নান শাহ বলেন, সংশ্লিষ্টরা নিজেদের ইচ্ছাকেই বেশি গুরুত্ব দিলে দলের চেয়ারপারসন দেশে ফেরার পর নিশ্চয়ই এব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।

একইরকম পরিস্থিতি সিরাজগঞ্জ, ফরিদপুর, নরসিংদী, নোয়াখালী, রংপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বেশির ভাগ জেলায়। সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র নুর-ই-আলম হেলাল বলেন, সম্মেলন তো দূরের কথা সিরাজগঞ্জে পুনর্গঠনের কোন কার্যক্রমই পরিচালিত হয়নি। আমি জেলা ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, জেলা বিএনপির দুইবারের সাংগঠনিক সম্পাদক ও দুইবারের পৌর মেয়র ছিলাম। আমাকে ডাকা হয়নি।

কেবল আমিই নই, জাতীয় নির্বাহী কমিটি সদস্য মেজর (অব.) হানিফ, তাঁতীদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি হুমায়ুন ইসলাম খান, জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও জিয়া পরিষদের সভাপতি রহমতুল্লাহ আইয়ুব, প্রয়াত এমপি মির্জা মুরাদুজ্জামানের ছেলে জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মোস্তফা জামান, সিরাজগঞ্জ কলেজের সাবেক জিএস শফিউল আলম ডলার, জেলা শ্রমিক দলের সম্পাদক নিয়ামুল হাকিম সাজু, জেলা কৃষক দল সম্পাদক ও আইনজীবী পরিষদের সম্পাদক এডভোকেট মোস্তফাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাই কমিটি গঠনের ব্যাপারে জানেন না।

আমরা জানতে পেরেছি- জেলা সভাপতি ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু তার অনুগতদের নিজেদের মতো করে নতুন কয়েকজনকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে কমিটি তৈরি করতে বলেছেন। হেলাল বলেন, বিগত দিনের আন্দোলনে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সিরাজগঞ্জেই আসেননি, আর এখন যারা আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিল তাদের বাদ দিচ্ছেন গণহারে। দলের নেতৃত্বে আসছে তার অনুগত কিছু বিত্তশালী। নুর-ই-আলম হেলালের এমন অভিযোগের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন জেলা বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা।

এদিকে গত ১২ই সেপ্টেম্বর পকেট কমিটি গঠনের অভিযোগ করে বোয়ালমারীর সাতৈর বাজারে তার নিজস্ব কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক এমপি খন্দকার নাসিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের বাদ দিয়ে একজন নেতার ইচ্ছায় এ কমিটি করা হচ্ছে। কারও সঙ্গে কোন আলোচনা না করেই ঘরে বসে এ কমিটি করা হচ্ছে। পকেট কমিটি গঠনের অভিযোগ তুলে জেলার বোয়ালমারী, আলফাডাঙ্গা ও মধুখালী উপজেলার ঘোষিত কমিটি বাতিলের দাবি জানান তিনি।

ওদিকে ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা বিএনপির একাংশের ‘পকেট কমিটি’ গঠনের অভিযোগে গত ১০ই সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মোকলেছুর রহমান খান। তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের নির্দেশ উপেক্ষা করে উপজেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম রব্বানী ও সাধারণ সম্পাদক কাজী বদরুজ্জামান তাদের অনুগত, অযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে গোপনে বিভিন্ন ওয়ার্ড, ইউনিয়ন কমিটির নামে পকেট কমিটি গঠন করছেন।

ওদিকে চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলা ও পৌর বিএনপির ঘোষিত কমিটি প্রত্যাখ্যান করে সংবাদ সম্মেলন করেন তৃণমূল বিএনপি নেতাকর্মীরা।

সংবাদ সম্মেলনে উপজেলা বিএনপির সভাপতি ছিদ্দিকুর রহমান অভিযোগ করেন, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক এড. সেলিমুল হক তৃণমূল বিএনপির  মতামত  উপেক্ষা করে অসাংগঠনিক পন্থায় উপজেলা ও পৌর বিএনপির ‘পকেট কমিটি’ গঠন করেছেন। আমরা ওই কমিটি প্রত্যাখ্যান করছি। এদিকে ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে অর্থের বিনিময়ে পকেট কমিটি গঠনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। গফরগাঁও উপজেলা যুবদলের কমিটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মো. আলী বাবুল অভিযোগ করেন, মোটা অঙ্কের টাকার মাধ্যমে উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন যুবদলের কমিটি ঘোষণা করে উপজেলার আহ্বায়ক সরদার মো. খুররম।

এ নিয়ে মারামারি ও মানববন্ধনের ঘটনা ঘটে সেখানে। ওদিকে বরিশালের গৌরনদী পৌর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শরীফ জহির সাজ্জাদ হান্নান অভিযোগ করেন, বরিশাল উত্তর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান এলাকায় না গিয়ে গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া উপজেলা বিএনপিতে তার পছন্দের কতিপয় নেতাকে নিয়ে ঢাকার ফকিরাপুলের এশিয়া হোটেলে গোপন বৈঠক করেছেন। সেখানে বর্তমান কমিটিতে দুই একটি পরিবর্তন এনে তা বহাল রাখার জন্য পকেট কমিটি গঠন করেছেন।

এছাড়া, রংপুরের কাউনিয়া উপজেলা বিএনপির কমিটি গঠনে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। পীরগাছার ইটাকুমারী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি সাইফুল ইসলাম অভিযোগ করেন, জেলা বিএনপির সভাপতি এমদাদুল হক ভরসার হারাগাছের বাসভবনে অনুগত কয়েকজনকে নিয়ে গোপন বৈঠককে কাউন্সিল দেখিয়ে পকেট কমিটি গঠন করা হয়েছে। একইভাবে রংপুর সদর, পীরগাছা, মিঠাপুকুর, গঙ্গাচড়া, তারাগঞ্জ উপজেলা কমিটিগুলোও অনুগতদের নিয়ে বিভিন্ন স্পটে গোপন বৈঠকের মাধ্যমে গঠন করা হয়েছে।

একই অভিযোগ ওঠেছে বরগুনা জেলা বিএনপির কমিটি গঠনেও। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সম্মেলন হলেও সেখানে অনুগতদের নিয়ে পকেট কমিটি গঠনের অভিযোগ করেছেন তৃণমূল নেতারা। অন্যান্য জেলার মতো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কেন্দ্রীয় নেতাদের চাপ না থাকলেও নিজেদের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা।

এর আগে গত ১৩ই সেপ্টেম্বর গুলশান বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ের সামনে পকেট কমিটি গঠনের প্রতিবাদে মানববন্ধন করে সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির তৃণমূল নেতারা। এদিকে ৮ই অক্টোবর কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে আয়োজিত সম্মেলনে গোপন ভোটাভুটির মাধ্যমে রাঙ্গামাটি জেলা বিএনপির নতুন কমিটি গঠিত হলেও সম্মেলনে ভোটাভুটি শুরুর পরপরই সভাপতি পদের এক প্রার্থী দীপেন দেওয়ান আরেক প্রার্থী শাহ আলমকে আওয়ামী লীগের এজেন্ট দাবি করে নির্বাচন বর্জন করেন।-এমজমিন
১৪ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে