বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৫, ১২:৪৭:২৩

ডিসেম্বরে মুখোমুখি দুই দল

ডিসেম্বরে মুখোমুখি দুই দল

মাহমুদ আজহার ও গোলাম রাব্বানী : দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে তৃণমূল রাজনীতির পালে হাওয়া বইছে। ডিসেম্বরে পৌরসভা নির্বাচন ও মার্চে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ বড় দলগুলোর মধ্যে নতুন করে রাজনৈতিক আবহ সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় প্রথমবারের মতো প্রভাবমুক্ত থেকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অগি্নপরীক্ষায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অতীতের বিতর্কিত নির্বাচনের 'কলঙ্কমুক্ত' করার চ্যালেঞ্জেও ইসি।

অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে পারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের নতুন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে আওয়ামী লীগকে। এ কারণে অগোছালো মাঠ নিয়ে দুশ্চিন্তায় দলের নীতিনির্ধারকরা। মাঠপর্যায়ে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড বাদ দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের ঝোঁকও বিপদের কারণ হতে পারে দলটির। অন্যদিকে মামলার পাহাড়ে থাকা বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সামনেও কঠিন পরীক্ষা।

একইভাবে মাঠপর্যায়ে 'অগোছালো সংগঠন' নিয়েও দুশ্চিন্তায় দলের হাইকমান্ড। নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত না এলেও তৃণমূলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা ইতিমধ্যেই মাঠে নেমে গেছেন। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও নির্বাচন মোটামুটিভাবে সুষ্ঠু হলে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী দলের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ থাকার অনুরোধ দলের নেতা-কর্মীদের।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হলে মনোনয়ন নিয়ে অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে। এটা বন্ধ করাই রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ নির্বাচনের ফলে তৃণমূল পর্যায়েও কালো টাকার ছড়াছড়ি বাড়বে। 'নন পলিটিক্যাল' ভালো মানুষেরও নির্বাচনে আসার সম্ভাবনাও কমে যাবে। নির্বাচন কমিশনকেও পক্ষপাতমুক্ত থাকতে কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে।

এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন পৃথিবীর অনেক দেশেই হচ্ছে। ইতিবাচক দিক হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোকে স্থানীয় পর্যায়ে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার দিকে নজর দিতে হবে। ক্ষমতাসীন দলকেও ক্ষমতার মেয়াদের মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে জনপ্রিয়তার পরীক্ষা দিতে হবে। তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ের নেতৃত্ব তৈরি হওয়ারও সুযোগ সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা অনুপস্থিত। নির্বাচনে নতুন করে মনোনয়নবাণিজ্য হতে পারে। এই নেতিবাচক দিকগুলো একেবারে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এটা গণতন্ত্রের জন্য খারাপ ফল বয়ে আনবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'বাঙালিরা দলাদলি করতে পারে, দল গড়তে পারে না'-কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ কথার মতোই বলতে হয়, আমরা মারামারি কাটাকাটি করছি, কিন্তু প্রকৃত অর্থে দল গড়ে তুলতে পারিনি। কোনো দলেই নেই গণতন্ত্র। নেই কোনো জবাবদিহিতা। এ অবস্থায় স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভিত্তিতে হলে গণতন্ত্র আরও হুমকিতে পড়বে। মনোনয়ন বাণিজ্য নিয়ে মাঠপর্যায়ে মারামারি হবে। স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সরকারি দলের পক্ষে কাজ করবে। নির্বাচন কমিশন আরও পক্ষপাতদুষ্ট হবে।

এ অবস্থায় দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন না হওয়াই ভালো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হলে মনোনয়ন নিয়ে অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে। টাকার খেলা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সম্পৃক্ততাও বাড়বে। অরাজনৈতিক ভালো মানুষেরও নির্বাচনে নিরুৎসাহিত হবে। এ নির্বাচনেও দলীয়ভাবে টাকার ছড়াছড়ি বাড়বে। এটা শুধু অসুস্থ প্রতিযোগিতা বাড়বে।

অগি্নপরীক্ষায় ইসি : প্রথম বারের মতো পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচন দলীয়ভাবে করা নির্বাচন কমিশনের জন্য অগি্নপরীক্ষা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। নির্বাচন কমিশনও বলছে, স্বল্প সময়ে এভাবে ভোট করা তাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। বাস্তবে স্থানীয় নির্বাচন কম সময়ে করা জগাখিচুড়ি ছাড়া কিছুই হবে না বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা। এদিকে দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে রাজনৈতিক দলের সরাসরি প্রভাব নিয়ন্ত্রণ, জালভোট, কারচুপি বন্ধসহ দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলতে বাধ্য করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন অনেকে।

ইসির কর্মকর্তারা বলেছেন, সংসদ নির্বাচনে এক ব্যালট পেপারে ভোট হয়, স্থানীয় নির্বাচনে মেয়র, সংরক্ষিত ও সাধারণ কাউন্সিলর পদে বিভিন্ন ধরনের ব্যালট পেপার লাগবে। বিদ্যমান আইনে কম প্রার্থী থাকলেও ১২টি প্রতীকের ব্যালট পেপার ছাপিয়ে রাখে নির্বাচন কমিশন। তবে যেখানে প্রার্থী ১২ জনের বেশি হবে সেখানে অতিরিক্ত প্রতীক যোগ করে ব্যালট পেপার ছাপানো হয়। নির্দলীয় এ নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হলে প্রতিটি ওয়ার্ডে আলাদা আলাদা ব্যালট পেপার ছাপাতে হবে মেয়র ও কাউন্সিলর পদের জন্য। বর্তমানে ৪০টি নিবন্ধিত দল রয়েছে।

নির্বাচন কমিশন জানায়, ডিসেম্বরে পৌরসভা ও মার্চে ইউপি নির্বাচন করতে হলে ইসির হাতে তফসিল দেওয়ার সময় কম। আইন সংশোধন হলে সে আলোকে বিধিমালা ও আচরণবিধি সংশোধন করা হয়তো কম সময়ে সম্ভব। দেশের তিন শতাধিক পৌরসভায় দলীয়ভাবে ভোট করা হবে বেশ 'ঝুঁকিপূর্ণ'।

এ ছাড়া নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের বিষয়ও সময় সাপেক্ষ। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, স্বল্প সময়ে প্রথমবারের মতো দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা তো চ্যালেঞ্জেরই হবে। দলভিত্তিক ভোট হলে প্রান্তিক পর্যায়েও গণতান্ত্রিক বিকাশ ঘটবে-এ জন্যে সরকার আইনগুলো সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ পরিবর্তনের জন্য দলভিত্তিক নির্বাচন আয়োজন প্রথমবারের মতো চ্যালেঞ্জ হলেও আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না আশা করি।

চট্টগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক মুহাম্মদ সেলিম জানান, দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীক নিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আইনমন্ত্রী সভায় অনুমোদন হওয়ায় চট্টগ্রামে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সরকারদলীয় জনপ্রতিনিধিরা এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানালেও বিএনপিসহ অন্যান্য দল ও নির্দলীয় জনপ্রতিনিধিরা দেখিয়েছেন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। তাদের মতে-দলীয় প্রতীক ও মনোনয়ন নিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ফলে বাড়বে সংঘাত এবং নির্বাচনে বেড়ে যাবে দলীয় প্রভাব বিস্তার।

বাংলাদেশ উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাসোসিয়েশন চট্টগ্রাম বিভাগের সাধারণ সম্পাদক ও রাউজান উপজেলা চেয়ারম্যান এহসান হায়দার চৌধুরী বাবুল বলেন, দলীয় প্রতীক নিয়ে স্থানীয় নির্বাচন হলে নির্বাচনকালীন সংঘাত কমে আসবে। চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সোলায়মান মঞ্জু বলেন, দেশবাসীর দৃষ্টি এখন জাতীয় সংসদের মধ্যবর্তী নির্বাচনের দিকে। জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরাতে এটি সরকারের অপকৌশল মাত্র।

মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ১৪ নম্বর হাইতকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, এটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। আগে নির্দলীয়ভাবে নির্বাচন হলেও পর্দার আড়ালে থেকে রাজনৈতিক দলের নেতারা কলকাঠি নাড়ত। এখন তা ওপেন হয়ে গেছে। দলীয়ভাবে প্রতীক নিয়ে নির্বাচন হলে হানাহানি, মারামারি, অন্তঃকোন্দল কমবে। উত্তর জেলা মহিলা লীগের নেত্রী ও মিরসরাই উপজেলার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ইয়াছমিন আক্তার কাকলী বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তৃণমূল পর্যায়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সময় এখনো আসেনি।-বিডিপ্রতিদিন
১৪ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে