বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৫, ০১:৪২:৫৭

স্থানীয় নির্বাচনে বহুবিধ চ্যালেঞ্জ

স্থানীয় নির্বাচনে বহুবিধ চ্যালেঞ্জ

তাওহীদুল ইসলাম : জাতীয় নির্বাচনের মতো দলীয়ভাবেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানে আইন সংশোধনের অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এক্ষেত্রে উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর। তবে রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, কাজটি এত সহজ হবে না। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন, প্রথমত এতে তৃণমূলে নির্দলীয় যোগ্য প্রার্থীদের বাদ পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোয় মনোনয়ন নিয়ে অন্তর্কোন্দল বাড়তে পারে। ফলে বাড়বে নির্বাচনকেন্দ্রিক মামলার সংখ্যা। প্রার্থিতা অযোগ্য ঘোষণা এবং আবার বহাল এসব বিষয় তো রয়েছেই। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক চাপের ঊর্ধ্বে থেকে নির্বাচন স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করা। এছাড়া কঠিন হচ্ছে অতিরিক্ত ব্যালট পেপার মুদ্রণ। পরিবর্তন আনতে হবে আচরণবিধি ও নির্বাচন পরিচালনা বিধিতেও।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, গত সোমবার স্থানীয় সরকারগুলোর আইন সংশোধন হলেও আগে থেকেই এসব নির্বাচন একরকম দলীয়ভাবেই হতো। রাজনৈতিক দলগুলো পছন্দের প্রার্থীদের সমর্থন দিত, তাদের পক্ষে মিছিল-মিটিং করত। শুধু ব্যালট পেপারে দলের প্রতীক থাকত না। এখন আইন সংশোধনের পর বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা দলীয় প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করতে পারবেন। অবশ্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আপাতত সে সুযোগ পাবে না। কারণ হাইকোর্ট একটি রিটের রায়ে গত আগস্টে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ঘোষণা করেন। তবে জামায়াতের প্রার্থীরা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। একমাত্র বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে এ আইন সংশোধনে আপত্তি জানালেও অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নতুন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা জানান, এখন স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানই ইসির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে এ উদ্যোগ। তবে বিভিন্ন সংগঠন এর বিরোধিতা করে বলছে, এতে নির্দলীয় যোগ্য ব্যক্তিরা সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিতে নিরুৎসাহিত হবেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক বিরোধের কারণে স্থানীয় নির্বাচনেও মারামারি-কাটাকাটি বাড়বে।

জানা গেছে, প্রার্থী হতে খোদ সরকারদলীয়দের মধ্যে প্রতিযোগিতা সামাল দেওয়া কঠিন হতে পারে। সেক্ষেত্রে সংসদ নির্বাচনের মতো স্থানীয় নির্বাচনের জন্য নির্বাচন বোর্ড করে দেওয়া হবে। ওই বোর্ডে একজন করে কেন্দ্রীয় নেতা থাকবেন। বোর্ডই প্রার্থী ঠিক করবে। বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকাতে ১ শতাংশ সমর্থক ভোটারের তালিকা রাখা হতে পারে।

দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে মঙ্গলবার স্থানীয় সরকার, সমবায় ও পল্লি উন্নয়নমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সরকার সৎ উদ্দেশ্যেই দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মূলত গণতন্ত্রকে তৃণমূল পর্যায়ে শক্তিশালী করতে আইন সংশোধন করে দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

তৃণমূলে সহিংসতার আশঙ্কা প্রসঙ্গে তিনি বলেন,  দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে তৃণমূল পর্যায়ে ভোটের উৎসব হবে। মারামারির তো কোনো স্কোপই নেই, বরং গাছে একটা ফুলও থাকবে না, সব ফুলের মালা মানুষে দেবে। মন্ত্রী আরও বলেন, নির্দলীয় প্রার্থীদের ইনকারেজ করছি। তারা নির্বাচন করতে চাইলে কোথাও কোনো বাধা নেই। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, দলীয় পরিচয়ে নির্বাচনের কথা বললেও দেখবেন গ্রাসরুট লেভেলে নিরপেক্ষ প্রার্থীর সংখ্যাই বেশি হবে।

এদিকে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, বিশ্বের অন্য দেশেও স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবেই হয়। বাংলাদেশে নির্দলীয় বলা হলেও মূলত রাজনৈতিক ব্যানারেই হয়। এখন নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করা বড় বিষয়। এজন্য কাঠামোর পরিবর্তন জরুরি।

সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এর ফলে তৃণমূলে হানাহানি, সহিংসতা বাড়বে। নির্দলীয় দক্ষ ও যোগ্যরা নিরুৎসাহী হবেন। একদলীয় প্রার্থী বেড়ে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। আর গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কারচুপির কারণে নির্বাচন কমিশন কতটা পক্ষপাতদুষ্টু তা প্রমাণিত। এ অবস্থায় দলীয় নির্বাচন ‘প্রভাবমুক্ত’ ও ‘গ্রহণযোগ্য’ করা সম্ভব নয়।

স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্র জানায়, আইন সংশোধনের ফলে শুধু নিবন্ধিত দলগুলোর মনোনীত এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবেন। ওই আলোকে নির্বাচনী প্রচারপত্রে দলীয় প্রধান ও রাজনৈতিক ব্যক্তির ছবি সংযুক্তি-সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে বিধিমালায় সংশোধনী আনতে হবে। বর্তমানে স্থানীয় সরকার নির্বাচনী প্রচারপত্রে দলীয় পরিচয় ও রাজনৈতিক ব্যক্তির ছবি সংযুক্ত করা যায় না। জাতীয় সংসদের মতো স্থানীয় নির্বাচনেও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ১ শতাংশ সমর্থক ভোটারের তালিকা দিতে হবে কিনা তা স্পষ্ট নয়।

এ প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, অধ্যাদেশ বা সংসদে আইন পাস হওয়ার পর বিধিমালা সংশোধনের সময় বিষয়টি ঠিক করবে নির্বাচন কমিশন। তবে অন্য একটি সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচনের মতো পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচনেও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এক পার্সেন্ট ভোটারের সমর্থন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। ফলে দলের মনোনয়ন না পেয়ে কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না।

জানা গেছে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদে জনগণের সরাসরি ভোটে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিক বিবেচনায় নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়ায় নতুন ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন।

সূত্রমতে, রাজনৈতিক প্রার্থীরা এখন থেকে স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করবেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য থাকবে আলাদা প্রতীক। পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদের মতো তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় প্রতীক ও প্রার্থীদের নাম উল্লেখ করে প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য আলাদাভাবে বিপুলসংখ্যক ব্যালট পেপার ছাপানো একটা বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

দেশে মোট পৌরসভার সংখ্যা ৩২৩টি। এর মধ্যে নির্বাচন উপযোগী ২৭৮টি। আগামী ডিসেম্বরে ২৪৫টি পৌরসভায় নির্বাচন হবে।  এছাড়া ৪ হাজার ৫৫৩টি ইউনিয়ন পরিষদ, ৪৮৮টি উপজেলা, ১১টি সিটি করপোরেশন এবং ৬৪টি জেলা পরিষদ নির্বাচন দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনকেন্দ্রিক মামলার কারণে ভোটগ্রহণের আগমুহূর্ত পর্যন্ত প্রার্থীর সংখ্যা বাড়তে/কমতে থাকে। প্রার্থী পরিবর্তন হলেই নতুন করে ওই আসনের জন্য ব্যালট ছাপতে হবে। দলীয় প্রার্থিতার ক্ষেত্রে এ ঘটনা বেশি থাকে।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচন মিলিয়ে ২৫ কোটিরও বেশি ব্যালট পেপার ছাপাতে হবে। এছাড়া পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদগুলোর ওয়ার্ড সংখ্যা বেশি হওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যে আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নির্বাচন পরিচালনা বিধি ও প্রার্থীদের জন্য আচরণবিধি তৈরি করা কঠিন। আগে ভোট গ্রহণের কয়েক মাস আগ থেকেই ব্যালট পেপার ছাপানো যেত; কিন্তু এখন দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে প্রার্থিতা প্রত্যাহার ও প্রতীক বরাদ্দের পর ছাপার কাজ শুরু করতে হবে। সেক্ষেত্রে সাধারণত সময় পাওয়া যাবে ১৮ থেকে ২১ দিন।

জাতীয় সংসদের তিনশ আসন ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শুধু প্রার্থীর নাম ও প্রতীকসহ ব্যালট ছাপানো হয়। উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতি পদের বিপরীতে কম প্রার্থী থাকলেও ১২টি প্রতীকের ব্যালট পেপার ছাপিয়ে রাখে নির্বাচন কমিশন। তবে যেখানে প্রার্থী ১২ জনের বেশি হবে সেখানে অতিরিক্ত প্রতীক যোগ করে ব্যালট পেপার ছাপানো হয়। পৌরসভায় একজন ভোটারের জন্য মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে তিন ধরনের এবং ইউপিতে চেয়ারম্যান, সদস্য ও সংরক্ষিত নারী সদস্য তিন ধরনের ব্যালট ছাপানো হতো; কিন্তু দলীয়ভাবে হলে নির্বাচন উপযোগী ২৪৫ পৌরসভার ৭৫ লাখ ভোটারের জন্য প্রায় সাড়ে তিন হাজার ধরনের দুই কোটি ২৫ লাখ ব্যালট ছাপাতে হবে। একইভাবে সাড়ে চার হাজার ইউপির জন্য ৬০ লাখ ধরনের ২৫  কোটি ব্যালট ছাপাতে হবে।

সূত্র আরও জানায়, বিদ্যমান আচরণ বিধিমালায় মন্ত্রী ও সরকারি সুবিধাভোগীরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রচারণা চালাতে পারেন না। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা প্রচারণা চালাতে পারেন। বিধিমালা সংশোধনে মন্ত্রী ও সমমর্যাদার ব্যক্তিদের নির্বাচনে প্রচারণা সুযোগ দেওয়া হবে কিনা- সে বিষয়টি এখনো স্পষ্ট হয়নি। কারণ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোয় রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অংশ নিতে পারবেন।-আমাদেরসময়
১৪ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে