সোমবার, ০২ জানুয়ারী, ২০১৭, ০২:১১:৪৪

ভয়ঙ্কর তথ্য: রোহিঙ্গা গণহত্যার ধরন পাল্টিয়েছে মিয়ানমার, দীর্ঘ মেয়াদি জেল

ভয়ঙ্কর তথ্য: রোহিঙ্গা গণহত্যার ধরন পাল্টিয়েছে মিয়ানমার, দীর্ঘ মেয়াদি জেল

গোলাম আজম খান, কক্সবাজার : আরকান রাজ্যে মংডুতে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন ও আটক ক্রমাগত বেড়েই চলছে। মিয়ানমার বৈশ্বিক চাপে মংডুতে রোহিঙ্গা গণহত্যার ধরন পাল্টিয়েছে। ঘরবাড়িতে আগুন দেয়ার বদলে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। গুলি করে হত্যার বদলে বিনাবিচারে দীর্ঘ মেয়াদি সাজা দিয়ে করারুদ্ধ করছে। অন্য দিকে গুম করছে গণহারে।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, জিজ্ঞাবাদের সময় আটককৃতদের পৈশাচিক নির্যাতন করা হচ্ছে। আটক ব্যক্তিদের নখ ও দাড়ি কেটে ফেলা হচ্ছে। তাদের শরীরে বিভিন্ন ক্ষত ও কাটা দাগ রয়েছে। তারা বলছেন, অজ্ঞাত অভিযোগে তাদের ২০ বছরের জেল দেয়া হয়েছে।
বর্মী বাহিনীর চলমান ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ অভিযানে রোহিঙ্গা যুবকরা ঝোপ-জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে জীবন রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ওখানে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। দেখামাত্র গুলিতে মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে খাদ্য ও চিকিৎসা সঙ্কট। দ্রুত চিকিৎসা ও খাদ্যের ব্যবস্থা করা না গেলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা অনাহার ও বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন বলে জানিয়েছেন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। জাতিগত নিধন ও মানবতার বিরুদ্ধে সংগঠিত সীমাহীন অপরাধে আরকানে মানবীয় বিপর্যয় বিস্তৃতি লাভ করছে। গত দুই মাসে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আরাকান রাজ্যে সামরিক আগ্রাসনে শত শত রোহিঙ্গা নাগরিককে হত্যার পাশাপশি বিনাবিচারে দীর্ঘ মেয়াদে জেল দিচ্ছে। ইতোমধ্যে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ এর ফলে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ৫০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু এখনো যারা আরাকান রাজ্যে অবস্থানরত তারা, বিশেষ করে পুরুষরা, কেউ বাড়িতে বসবাস করতে পারছেন না। কারণ বর্মী সশস্ত্রবাহিনী রোহিঙ্গা পুরুষদের পেলেই মারধরসহ অমানবিকভাবে হত্যা করছে কিংবা আটক করে বিনাবিচারে জেল দিচ্ছে। এ কারণে পুরুষেরা বাধ্য হয়ে উপকূলীয় পেরাবন, নদীর ধারে কিংবা বন জঙ্গলে ফেরারি জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। খাবার না পেয়ে গাছের লতা পাতা খেয়ে তাদের দিন কাটাতে হচ্ছে। সেনাবাহিনী বাড়ি বাড়ি ঢুকে ১০ বছরের শিশু থেকে শুরু করে সব পুরুষদের প্রহার করতে করতে একটি জায়গায় জড়ো করে বসিয়ে পৈশাচিক নির্যাতন চালাচ্ছে। সম্প্রতি আরাকান রাজ্যে অনেক গণকবরের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে এভাবে অমানবিক নির্যাতনের পর তাদের হত্যা করে গণকবর দেয়া হচ্ছে।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং মংডুর জেলা কোর্টের রায়ে দীর্ঘ মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হচ্ছে। ‘অভিযুক্তরা’ জানতেই পারছেন না তাদের কি অপরাধ, কেনইবা তাদের দীর্ঘ মেয়াদি সাজা দেয়া হচ্ছে।

ন্যায় বিচার পাওয়া অথবা আইনজীবী নিয়োগ করা দূরের ব্যাপার। আটককৃতদের একটি বদ্ধ ভ্যানে মংডুর জেলা কোর্টের সামনে রাখা হচ্ছে। তারা জানতেই পারছেন না কারা আইনজীবী অথবা কোন বিচারক তাদের বিচার করছেন। তারা শুধু জানতে পারেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য বিচারকের সাথে দেখা করতে যায়। আর বিচারক দ্রুত দীর্ঘ মেয়াদি কারাদণ্ডের রায় দিয়ে বুচিদং কারাগারে কারারুদ্ধ করে রাখছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, বুচিদং কারাগারে পাঠানোর আগেই তাদের আটক করে কিয়াকানপিয়ান বিজিপি হেডকোয়ার্টারে নির্মম অত্যাচার করা হয়েছে।

ডিসেম্বরের ১৬ থেকে ২২ তারিখের মধ্যে প্রায় ৬০০ জনের মধ্যে ২০০ এর অধিক ব্যক্তিকে ২০ থেকে ২৫ বছরের জেল দেয়া হয়েছে।

তবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বা নৃশংসতাকারীরা ছাড়া কারোরই জানা নেই প্রকৃতপক্ষে প্রতিদিন কত ব্যক্তিকে দীর্ঘ মেয়াদি সাজা দেয়া হচ্ছে। তথাকথিত আদালতের কার্যক্রম যেদিন পরিচালিত হয় সেদিন বিজিপি আদালতে যাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ করে রাখে। ফলে কেউ তথ্যের জন্য আদালতে যেতে পারেন না।

রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, বর্মী বাহিনীর অভিযানে যেসব রোহিঙ্গা দেখামাত্রই গুলিতে মারা গেছে তারা এক অর্থে ভাগ্যবান। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা ও ভয়াবহতা দেখে কেউ সহ্য করতে পারবে না। জিজ্ঞাবাদের সময় তাদের পৈশাচিক নির্যাতন করা হচ্ছে। আটক ব্যক্তিদের নখ ও দাড়ি কেটে ফেলা হচ্ছে। শরীরের বিভিন্ন স্থান ক্ষত-বিক্ষত করা হচ্ছে।

এ দিকে, উখিয়া-টেকনাফের সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টাকালে ২৪০টি নৌকায় এক হাজার ১১৬ জন রোহিঙ্গাকে ডিসেম্বর মাসে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উলাহ সরকার জানিয়েছেন, শনিবার সকালে উখিয়ার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ১৭ জন নারী পুরুষ ও শিশুকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছেন বিজিবির সদস্যরা। চলতি ডিসেম্বর মাসে উখিয়ার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ৪৩৬ জন রোহিঙ্গাকে স্বদেশে ফেরত পাঠিয়েছেন তারা। তারা প্রত্যেকেই সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করছিল।

টেকনাফে বিজিবির ২ নম্বর ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ জানান, শনিবার ভোরে টেকনাফের নাফ নদীর তিনটি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাবাহী আটটি নৌকা প্রবেশের চেষ্টা করে। এ সময় পানিসীমার শূন্য রেখায় তাদের ফেরত পাঠানো হয়। প্রতিটি নৌকায় ১০ থেকে ১২ জন রোহিঙ্গা ছিল।
০২ জানুয়ারী, ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে