মঙ্গলবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৭, ১১:৩৪:১৩

বাংলা ভাইয়ের হাতেই অস্ত্রের হাতেখড়ি গুলশানে হামলার মূল হোতা গান্ধীর

বাংলা ভাইয়ের হাতেই অস্ত্রের হাতেখড়ি গুলশানে হামলার মূল হোতা গান্ধীর

রেজোয়ান বিশ্বাস ও অমিতাভ দাশ হিমুন, ঢাকা: গুলশানে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী গ্রেপ্তারকৃত জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীর জঙ্গিবাদে হাতেখড়ি হয়েছিল মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া শীর্ষ জঙ্গি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইয়ের হাতে। রাজীব ও বাংলা ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি একই এলাকায় হওয়ায় দুজনের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়।

পরে বাংলা ভাইয়ের হাতেই সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিল সে। বাংলা ভাইয়ের মৃত্যুদণ্ডের পর জেএমবির নেতৃত্ব নিতেও রাজীব গান্ধী ছিল মরিয়া। এমনকি নেতৃত্ব নিতে সে তার সংগঠনের এক নেতাকে খুনও করেছিল। রাজীব গান্ধী এ পর্যন্ত ২৫ জনকে হত্যার পাশাপাশি অসংখ্য জঙ্গি হামলার ঘটনায় জড়িত ছিল।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য দিয়েছে রিমান্ডে থাকা রাজীব গান্ধী। গতকাল সোমবার ছিল রিমান্ডের দ্বিতীয় দিন। এখন পর্যন্ত সিটিটিসি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে। গত শুক্রবার রাতে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে গ্রেপ্তারের পর আট দিনের রিমান্ডে নিয়ে সিটিটিসিতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

অন্যদিকে জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীকে নিয়ে তার এলাকা গাইবান্ধার সাঘাটা ও গোবিন্দগঞ্জে চলছে নানা আলোচনা। গতকাল সাঘাটার বোনারপাড়া ইউনিয়নের রাঘবপুর ভূতমারা গ্রামে গিয়ে পাওয়া গেছে তার সম্পর্কে নানা তথ্য। এলাকাবাসীও নিশ্চিত করে, জাহাঙ্গীর একসময় শীর্ষ জেএমবি নেতা বাংলা ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল। বাংলা ভাইয়ের হাত ধরেই সে জেএমবিতে যোগ দেয়। তার বাবা মাওলানা ওসমান গনি পার্শ্ববর্তী চকদাতেয়া এলাকার হাই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন।  

তদন্তসংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জাহাঙ্গীর নব্য জেএমবির উত্তরাঞ্চলের অপারেশনাল কমান্ডারের দায়িত্ব পাওয়ার আগে ছিল পুরনো জেএমবির একসময়ের সেকেন্ড ইন কমান্ড বাংলা ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও কিলিং গ্রুপের প্রধান।

গতকাল গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গোবিন্দগঞ্জে বাংলা ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি। বাংলা ভাইয়ের স্ত্রী ফাহিমার বাড়ি আর রাজীব গান্ধীর বাড়ি পাশাপাশি। ২০০৫ সালে জেএমবি সারা দেশে সিরিজ বোমা হামলার আগে গাইবান্ধার চর এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেয়। সেই থেকে রাজীব গান্ধীর জেএমবিতে পথচলা শুরু হয়। এরপর সময়-সুযোগ মতো সে একেক সময় একেক নেতা ধরে ওপরে ওঠার চেষ্টা করেছে।

সূত্রগুলো জানায়, বাংলা ভাইয়ের মৃত্যুর পর সে নতুন নেতা খুঁজতে থাকে। একসময় পুরনো জেএমবি নেতা আব্দুল আওয়ালের পাচক হিসেবে কাজ করত। সে সময় থেকেই দলের শীর্ষ পর্যায়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে সে।

২০১৩ সালে জেএমবির আমির হওয়ার স্বপ্ন দেখে রাজীব গান্ধী। সে জেএমবি নেতা নজরুল ও কারাবন্দি তাসনিম ওরফে নাহিদের সঙ্গে যোগ দেয়। তবে নজরুল জেএমবির আমির হতে চাইলে তার সঙ্গে বিরোধের সৃষ্টি হয়। সে তাসনিমের দলে যোগ দেয়। একপর্যায়ের সংগঠনের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে নজরুলকে সে খুন করে। এর পরও সে পুরনো জেএমবির আমির হতে পারেনি।

কারণ তত দিনে তার মতো আরো অনেক নেতা পুরনো জেএমবির আমির হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। জেএমবির আমির হতে না পারলেও সে থেমে থাকেনি। সে একের পর এক টার্গেট কিলিংয়ের পরিকল্পনা করে নিজের শক্তির জানান দিতে শুরু করে। এরপর কানাডাপ্রবাসী তামিম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ হলে সে নতুন ধারার জেএমবিতে যোগ দিয়ে উত্তরাঞ্চলের দায়িত্ব পালন করতে থাকে।

তামিমের নির্দেশনায় সে ২০১৪ সালের শেষ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ২৪টি হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ নেয়। পরে তাকে উত্তরাঞ্চলের সামরিক কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর তার আসল নাম জাহাঙ্গীর হলেও রাজীব গান্ধী, সুভাষ, শান্ত, টাইগার, আদিল ও জাহিদ অর্থাৎ ছয়টি ছদ্মনামে নব্য জেএমবিতে সক্রিয় ছিল।

নব্য জেএমবির উত্তরাঞ্চলের কমান্ডারের দায়িত্ব পেয়ে দুর্ধর্ষ জঙ্গি রাজীব গান্ধী রংপুরের জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিসহ ২২টি হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি ২০১৬ সালে গাইবান্ধায় আরো দুটি হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়। সে গোবিন্দগঞ্জের জুতা ব্যবসায়ী দেবেশ চন্দ্র প্রামাণিক ও তরুণ দত্তকে হত্যা করে। এরপর সে নব্য জেএমবির উত্তরাঞ্চলের কিলিং স্কোয়াডের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। তারপর গুলশান হামলার পরিকল্পনায় তামিমের সঙ্গে যুক্ত হয় সে।

সরেজমিন : রাজীব গান্ধীর বাড়ি সাঘাটার পশ্চিম রাঘবপুর ভূতমারাঘাটে (চকদাতেয়া) খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১০ বছর আগে বিয়ে করার পর স্ত্রী মাহমুদাকে সঙ্গে নিয়ে পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যায় রাজীব গান্ধী। এরপর সাঘাটার মূল বাড়ির সঙ্গে অর্থাৎ মা ও দুই ভাইয়ের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ ছিল না। সাঘাটার বাড়িতে গেলে রাজীবের ছোট বোন রেজওয়ানা জানান, তাঁর ভাইয়ের আসল নাম জাহাঙ্গীর। অনেক দিন আগে ঢাকায় গার্মেন্টে চাকরি নিয়েছিল জাহাঙ্গীর। একপর্যায়ে চাকরি ছেড়ে বাড়ি ফিরে গোবিন্দগঞ্জের শংকরঘাটের মাহমুদাকে বিয়ে করে। এরপর জাহাঙ্গীর গোবিন্দগঞ্জে শ্বশুরবাড়ির পাশে আলাদা একটি বাড়ি করে।

প্রতিবেশী এক মহিলা জানান, প্রায়ই বেশ রাতে জোব্বা পরা লোকজন ওই বাড়িতে আসত। পুলিশের কাছে এ ধরনের খবর পৌঁছলে তারা আত্মগোপনে চলে যায়। তবে মাঝে মাঝে গোপনে তারা সেখানে আসত। ২০১৬ সালের ৯ জুন ওই বাড়িতে গোপন বৈঠক করার সময় ডিবি পুলিশ অভিযান চালালে জাহাঙ্গীরসহ অন্যরা পালিয়ে যায়। এ ঘটনার পর তার ভাই মোহাম্মদ আলী বেড়া ভেঙে নিয়ে যাওয়ার পর এখন শুধু ঘরের চালাটি পড়ে আছে।

ভূতমারা গ্রামে গিয়ে জাহাঙ্গীরের ছেলে ওয়াসিফের সঙ্গে কথা হলে সে জানায়, এক বছর আগে তার বাবা তাকে জুমারবাড়ি এলাকার ডাকবাংলো মাদরাসায় ভর্তি করে দেয়। এর পর থেকে বাবা-মা তার কোনো খবর নেয়নি। নানি তাকে দেখাশোনা করে। সাত-আট মাস আগে পুলিশ তাকে বাবা সম্পর্কে প্রশ্ন করে। এ খবর প্রচার হয়ে গেলে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তাকে আর ক্লাস করতে দেয়নি। এখন সে স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে।

জাহাঙ্গীরের মা রাহেলা বেগম ছেলের শোকে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তাঁর ছেলে কী করে তা তিনি জানেন না। তবে সে যদি অন্যায় করে থাকে তবে আল্লাহ নিশ্চয় তার শাস্তির ব্যবস্থা করবে। রাহেলা বেগম বলেন, দীর্ঘদিন জাহাঙ্গীরের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই।
১৭ জানুয়ারি ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/হাবিব/এইচআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে