রবিবার, ০২ এপ্রিল, ২০১৭, ০১:৪১:৫৭

সীতাকুণ্ড থেকে সিলেট : ১৬ দিনে নিহত ১৮

সীতাকুণ্ড থেকে সিলেট : ১৬ দিনে নিহত ১৮

মির্জা মেহেদী তমাল : চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে শুরু। সিলেট, কুমিল্লার পর মৌলভীবাজারে শেষ। মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে সন্ধান পাওয়া সাতটি জঙ্গি আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহত হয়েছে ১৮ জঙ্গি সদস্য। ‘অপারেশন অ্যাসল্ট সিক্সটিন’ দিয়ে শুরু হওয়া জঙ্গি ডেরা তছনছ করার এই অভিযানের শেষটি হয় ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’ এর মধ্যদিয়ে গতকাল।

সাঁজোয়া যান থেকে শুরু করে ড্রোন পর্যন্ত ব্যবহার করতে হয়েছে এসব অভিযানে। আর এই সাত অভিযানে জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছেন র‌্যাব ও পুলিশের তিন কর্মকর্তা। নিহত হয়েছেন তিনজন সাধারণ মানুষ। জঙ্গিদের বোমা হামলায় আহত হয়েছেন অন্তত ৫০ ব্যক্তি। নিহতদের মধ্যে র‌্যাবের চৌকস কর্মকর্তা গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদও রয়েছেন। সিলেট শিববাড়ীর আতিয়া মহলের জঙ্গিদের পরাস্ত করতে সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডোদেরও অভিযান চালাতে হয়।

বাংলাদেশের ইতিহাসে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের মধ্যে আতিয়া ভবনে পাঁচ দিনের এই অভিযানটি সবচেয়ে শ্বাসরুদ্ধকর ছিল বলে মনে করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। প্যারা কমান্ডোরা জিম্মি হয়ে থাকা ভবনের ৭৮ জন বাসিন্দাকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে সব জঙ্গিকে নিশ্চিহ্ন করতে সফল হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, জঙ্গিরা ছোট ছোট শহরে আস্তানা গড়ে তুলেছে। বড় ধরনের হামলার প্রস্তুতি নিয়েই রাজধানী ছেড়ে তারা তৃণমূলে ছড়িয়ে পড়ে। আস্তানাগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়ায় বড় ধরনের নাশকতা থেকে রক্ষা পাওয়া গেল বলে মনে করছেন তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ৭ মার্চ কুমিল্লার চান্দিনা থেকে গ্রেফতার হওয়া আহমেদ আজওয়াদ ইমতিয়াজ তালুকদার ওরফে অমি পুলিশি জেরায় তথ্য দিয়েছিল বিভিন্ন আস্তানার। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভাগীয় এবং জেলা শহরে তাদের একাধিক আস্তানা রয়েছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য দিয়েছে। তার দেওয়া তথ্যেই মিলে যায় সীতাকুণ্ডের আস্তানাটি। একটির সূত্রে আরেকটি এমন চেইনের মাধ্যমেই পাওয়া যায় সাত আস্তানার খবর। গোয়েন্দাদের আশঙ্কার এমন আরও অনেক আস্তানা হয়তো রয়েছে বিভিন্ন জেলায়।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের প্রেমতলায় ‘ছায়ানীড়’ ও ‘সাধনকুটির’ নামের কাছাকাছি দুটি বাড়িতে দুটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ। পরে পুলিশের বিশেষায়িত টিমের অভিযানে চার জঙ্গি নিহত হয়। এ ছাড়া উদ্ধার হয় এক শিশুর লাশ। ১৫ মার্চ বিকাল থেকে সীতাকুণ্ডের প্রেমতলায় ‘ছায়ানীড়’ নামের একটি বাড়িতে তিন জঙ্গিকে অবরুদ্ধ করে রাখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওইদিন বিকালে ঢাকা থেকে রওনা দেয় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সোয়াত টিম। দলটি ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর তাদের নেতৃত্বে ভোর সোয়া ৬টা থেকে শুরু হয় ‘অপারেশন অ্যাসল্ট সিক্সটিন’।

তাদের সঙ্গে অভিযানে অংশ নেন চট্টগ্রাম সোয়াত, স্থানীয় র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরা। প্রায় সোয়া এক ঘণ্টার অভিযানে নিহত হয় নব্য জেএমবির এক নারী ও তিন পুরুষ জঙ্গি। অভিযান শুরু হলে আত্মঘাতী হামলা চালায় জঙ্গিরা। এতে আহত হন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চার সদস্য। পরদিন ওই আস্তানা থেকে একটি শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। অভিযানে জঙ্গি আস্তানায় জিম্মি হয়ে পড়া ২০ জনকে উদ্ধার করা হয়। সারা দেশে এ নিয়ে আতঙ্ক দেখা দেয়। ‘সাধনকুটির’ থেকে জঙ্গি দম্পতিকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত ২৩ মার্চ সিলেটের শিববাড়ীর আতিয়া মহলে আরও একটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ। এ আস্তানায় জঙ্গিরা বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে অবস্থান করছে বলে খবর পায় গোয়েন্দারা। ঘটনাস্থলে সোয়াত ছুটে যায়। কিন্তু ওই বাড়ির অবস্থান এমন এক জনবহুল এলাকায় যেখানে অভিযানটি জটিল করে তোলে। তলব করা হয় সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডোদের। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে জঙ্গিরা। প্যারা-কমান্ডোরা পাঁচ দিনের অভিযানে তাদের পরাস্ত করে। ২৮ মার্চ সেনাবাহিনী অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করে। এখানে একজন নারীসহ চারজন জঙ্গি নিহত হয়।

জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে গত ২৮ মার্চ রাত থেকে মৌলভীবাজার পৌরসভার বড়হাট এলাকায় একটি বাড়ি এবং খলিলপুর ইউনিয়নের সরকার বাজার এলাকার নাসিরপুর গ্রামের একটি বাড়িতে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পেয়ে ঘিরে রাখে পুলিশ ও সিটিটিসি। বুধবার সন্ধ্যায় নাসিরপুরের আস্তানায় অভিযান শুরু করে সোয়াত। পরে আলোর স্বল্পতার কারণে রাতে অভিযান স্থগিত রাখা হয়। পরদিন বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার পরে পুনরায় অভিযান শুরু করে সোয়াত। এ সময় দিনভর গুলি ও বোমায় প্রকম্পিত হতে থাকে পুরো এলাকা। বিকালে অভিযান শেষ হয়। ওই আস্তানা থেকে সাতজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। যেখানে চারটি শিশু রয়েছে।

ময়নাতদন্তের রিপোর্টে জানা যায়, শিশুদের নিয়েই আত্মঘাতী হয়েছে জঙ্গিরা। পরে গতকাল মৌলভীবাজারের বড়হাটে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শেষ হয়। সেখানে চলে ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’। এ অপারেশনের সময় আস্তানায় থাকা জঙ্গি দম্পতি বাথরুমেই আত্মহনন করে বলে জানিয়েছেন কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের কর্মকর্তারা। তারা আরও জানান, এই অপারেশনকালে আরেক জঙ্গি আত্মহনন করে বাথরুমের পাশেই। জঙ্গিরা আত্মঘাতী হওয়ার আগে তাদের গুরুত্বপূর্ণ নথি ও নগদ অর্থ পুড়িয়ে ফেলে। গত শুক্রবার রাতে ওই বাসার একটি কক্ষে আগুন ও ধোঁয়া  বের হতেও দেখা গেছে। গতকাল অভিযান শেষে ওই বাসায় প্রবেশের পর এই দৃশ্য দেখা ও জানা গেছে বলে তারা জানান।

দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের জঙ্গি আস্তানার খবরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। আর সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, জঙ্গিরা এখন তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল খুঁজে আস্তানা গড়ার চেষ্টা করছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর  জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রশিদ বলেন, ‘জঙ্গিরা ধরা পড়ার পরও আত্মসমর্পণ না করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তি অর্জন করেছে। সার্বিকভাবে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে জঙ্গিদের বেশ তত্পরতা রয়েছে। তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে চলতে পারছে। ’

সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো উন্নতি করেছে। জনগণও সচেতন হয়েছেন। সে কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে জঙ্গিরা ধরা পড়ছে। তবে তাদের নির্মূল করা যাচ্ছে না। তারা আরও কোথায় কোথায় আছে, কীভাবে আছে- হয়তো তা আমরা জানি না। তাদের একেবারে নির্মূল করা যাবে না। জঙ্গিরা মূলত ছোট ছোট ভাগে ভাগ হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। তারা নতুন নতুন টার্গেট নির্ধারণ করছে। তাদের বেশিরভাগ টার্গেটই হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ’

এ নিরাপত্তা বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘জঙ্গিরা একেবারে গ্রামে আস্তানা করতে পারবে না। তবে ছোট ছোট শহরগুলোতে তারা আস্তানা তৈরি করছে। কারণ এসব শহরে প্রতিবেশীদের মধ্যে আসা-যাওয়ার মানসিকতা বা সামাজিকতার চর্চা আগের চেয়ে কমে গেছে। তাই জঙ্গিরা সহজে আস্তানা গড়তে পারছে। তবে গ্রামে তারা এটা পারবে না। তারা মূলত শহরগুলোতেই মানুষের চোখের বা নজরদারির আড়ালে থাকছে। ’ বিডি প্রতিদিন
০২ এপ্রিল ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে