শুক্রবার, ০৫ মে, ২০১৭, ১২:০৭:৫২

প্রস্তুতির বার্তা বিএনপির তৃণমূলে

প্রস্তুতির বার্তা বিএনপির তৃণমূলে

কাফি কামাল : সাংগঠনিক সফরের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা প্রস্তুতির বার্তা দিচ্ছেন বিএনপি’র তৃণমূলে। নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবিতে সম্ভাব্য আন্দোলন কিংবা আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ, যে সিদ্ধান্তই আসুক শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে তার জন্য যেন প্রস্তুত থাকে তৃণমূল।

এ সফরে জেলা-উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে নেতাদের দ্বন্দ্ব-কোন্দল, ক্ষোভ-বিক্ষোভসহ সাংগঠনিক পরিস্থিতি, আন্দোলন এবং নির্বাচন প্রশ্নে তাদের মতামত সংগ্রহ করবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। যাতে আগামীতে যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই সেসব সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে পারেন শীর্ষ নেতৃত্ব।

সেই সঙ্গে জনগনের ভোটাধিকার নিশ্চিত ও একটি জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠায় বিএনপির দাবির প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধিতে সক্রিয় ভূমিকা পালনে তৃণমূল নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করবেন কেন্দ্রীয় নেতারা। সাংগঠনিক সফরে বিভিন্ন জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা দলের এমন মনোভাবের কথা জানিয়েছেন।  

নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। কিন্তু পরবর্তীতে সে আন্দোলনের রেশ ধরে রাখতে পারেনি। পরের বছর একতরফা নির্বাচনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ঘোষিত কর্মসূচিতে সরকারের তরফে বাধা এলে এক অদূরদর্শী আন্দোলনের দিকে যাত্রা করে বিএনপি।

বহু নেতাকর্মীর প্রাণ বিসর্জন, মামলা-হামলার ভেতর দিয়ে টানা সে আন্দোলনের নিষ্ফল সমাপ্তি টানেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তারপর দুই বছর ধরে ধীরে চলো নীতিতে পরিচালিত হচ্ছে বিএনপি’র কার্যক্রম। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি থেকে কিছুটা সরে এসে সামনে এনেছে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে ফর্মুলা দিতে গিয়ে নতুন এ দাবিকে সামনে এনেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। এ নিয়ে জাতির সামনে একটি ফর্মুলা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতিতে এখনও সে ফর্মুলা দেয়া হয়নি।

দলের নেতারা জানান, নির্বাচনী বিধি অনুসারে পরপর দুইবার নির্বাচন বর্জন করলে নিবন্ধন হারানোর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বিএনপি। তার উপর নানা মামলায় সাজার মুখে রয়েছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। মামলা ইস্যুতে সরকার কঠোর হলে শীর্ষ নেতৃত্বকে বাইরে রেখে নির্বাচনে যাবার পক্ষে নয় দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল। এছাড়া এসব ইস্যুতে সরকার শেষ পর্যন্ত কোন পথে যাবে তা পরিষ্কার নয়।

অন্যদিকে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের পর থেকেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ওঠে এসেছে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে সম্পন্ন করেছে মাঠ জরিপ। কাজ করছে ভোটারদের মধ্যে সমর্থন বৃদ্ধি, দলীয় প্রস্তুতি ও কৌশল এবং সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা প্রণয়নে। আগামী অক্টোবর-নভেম্বরকে টার্গেট ধরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মিশনে মাঠে রয়েছে সরকার।

অব্যাহতভাবে জেলা সফর করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে সরকারের মন্ত্রী, ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সভা-সমাবেশে দলীয় প্রতীকে ভোট চাইছেন। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা এই দলটির মূলত এখন নির্বাচনী ট্রেনে। শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত সকল পর্যায়ের নেতারাই এখন নির্বাচনী প্রচারণায়।

দলটির নীতি-নির্ধারণী ফোরাম থেকে শুরু করে সকল স্তরের সভার এজেন্ডায় থাকছে নির্বাচন প্রস্তুতি। সবমিলিয়ে এক ধরনের চাপের মধ্যে পড়েছে বিএনপি। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জনের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে খোদ বিএনপি’র দলীয় মহলে। এমন পরিস্থিতিতে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে আগামী নির্বাচনও বর্জন করতে পারবে কিনা এ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে দলের নীতি-নির্ধারণী ফোরামে।

এদিকে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে বিএনপি’র পক্ষ থেকে স্পষ্ট ঘোষণা না এলেও নেতারা নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবিতে অনড়। পাশাপাশি নির্বাচনে মাঠ ছেড়ে না দেয়া, প্রস্তুতির ব্যাপারেও ইঙ্গিত দিচ্ছেন তাদের বক্তব্যে। আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিএনপি’র প্রস্তুতির ব্যাপারে একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজারে ফুল দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমরা একটা নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল, আমরা নির্বাচনে বিশ্বাস করি। যদি সহায়ক সরকার থাকে, নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত থাকে, আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত সবসময়। আওয়ামী লীগের কাজের সঙ্গে আমাদের কাজের তুলনা করার দরকার নেই। নির্বাচনের জন্য ৩০০ আসনে বিএনপি’র ৯০০ প্রার্থী আছে।’

বিএনপি নেতারা জানান, বিএনপি’র অবস্থান সম্পর্কে এখনও পরিষ্কার নয় আওয়ামী লীগ। তাই বিএনপি যখন নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি সামনে এনেছে তখন ভয় থেকেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠ গরম করছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনমুখী রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের এ অবস্থান এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই বিএনপির।

অন্যদিকে বিএনপি এখনই নির্বাচনের প্রশ্নে পরিষ্কার ঘোষণা দিলে আওয়ামী লীগ নতুন কৌশল নিতে পারে। তাই সরকারকে এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে রেখেই আপাতত পথ চলতে চায় বিএনপি। যাতে আগামী নির্বাচনের আগে সরকারের ওপর দেশের রাজনৈতিক দল ও আন্তর্জাতিক মহলের চাপ বাড়িয়ে একটি মাঝামাঝি পথ বের করা যায়। আর সেটা করতে হলে আন্দোলনের যেমন প্রস্তুতি লাগবে তেমনি সুযোগ তৈরি হলে নির্বাচনের ফলাফল অনুকূলে আনার জন্য প্রয়োজন ভোটের প্রস্তুতি। তাই সরকারের নির্বাচন প্রচারণার বিপরীতে বিএনপি’র এ সাংগঠনিক সফর।

সাংগঠনিক সফর নিয়ে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থেই বিএনপি’র আন্দোলন। এখন যে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দলের মজবুত সাংগঠনিক ভিত্তির প্রয়োজন। নতুন কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে কোথায় দলের অবস্থা কেমন সেটা জেনে নেয়া শীর্ষ নেতৃত্বের জন্য জরুরি। যাতে আগেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া যায়।

বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, বিএনপি একটি বিপুল জনসমর্থিত ও নির্বাচনমুখী দল। জনগণের সমর্থণ এবং শক্তিশালী সংগঠন থাকলে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা ও উত্তরণ করা যায়। আমরা এখন সংগঠনকে গুরুত্ব দিয়ে এ সফর শুরু করেছি, সংগঠন শক্তিশালী থাকলে নির্বাচনের প্রস্তুতিও থাকে। চলমান সাংগঠনিক সফরে আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রধান ইস্যু নয়, তবে অন্যতম ইস্যু।

এ সফরে দলের সাংগঠনিক পরিস্থিতি যেমন উঠে আসছে তেমনি জানা যাচ্ছে নির্বাচনের ব্যাপারে তৃণমূলের চিন্তা-ভাবনা। তবে রাখ-ঢাক নয়, সাংগঠনিক সফরের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে খোলাখুলি বক্তব্য দিয়েছেন বিএনপি’র কয়েকজন সিনিয়র নেতা।

ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খোন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, আন্দোলন বা নির্বাচন আগামীতে বিএনপি চেয়ারপারসন যে ডাকই দিন তার জন্য সবাই প্রস্তুত থাকেন সেই বার্তাই আসলে দেয়া হচ্ছে তৃণমূলে। প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতার কারণে অনেক জেলায় নেতাকর্মীরা সভা-সমাবেশ করতে পারছেন না। কেন্দ্রীয় নেতারা তাদের একত্রিত করে দলের সাংগঠনিক পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। তাদের বলা হচ্ছে, আর ঘরে বসে থাকার সময় নেই। মানুষকে ভোটবিহীন রাখার সুযোগ নেই। এজন্য আন্দোলন বা নির্বাচন শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে যে নির্দেশনাই আসে তা বাস্তবায়নের প্রস্তুত থাকতে হবে।

যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, দুইটি লক্ষ্য নিয়েই কেন্দ্রীয় নেতারা সারা দেশে জেলায় জেলায় সাংগঠনিক সফর করছেন। আগামী দিনে আন্দোলন বা নির্বাচন যে পথেই পরিচালিত হয় দলের গতিপথ জেলা থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীরা যেন তার জন্য সমানভাবে প্রস্তুত থাকেন। তিনি বলেন, আমাকে যশোর জেলা সফরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

ইতিমধ্যে প্রস্তুতি সভা করেছি। মূলসভায় জেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বিএনপি ও অঙ্গদলের নেতা এবং বিগত নির্বাচনে বিএনপি দলীয় প্রার্থীরা মিলিয়ে প্রায় ৩০০ জন নেতা অংশ নেবেন। সেখানে তাদের বক্তব্য শুনব এবং শীর্ষ নেতৃত্বের বার্তা পৌঁছে দেবো। স্থানীয় পর্যায়ে সাংগঠনিক সমস্যা এবং তৃণমূল নেতাদের পরামর্শ ও মতামতগুলো নোট করে চেয়ারপারসনের কাছে উপস্থাপন করব। চেয়ারপারসনই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।

এ সফরের মধ্যদিয়ে বিএনপি’র আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রাক-প্রস্তুতি একাংশ সম্পন্ন হবে। আরেক যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সরোয়ার বলেন, চলমান সাংগঠনিক সফরে নেতারা দলের তৃণমূলের সাংগঠনিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে চেয়ারপারসনকে অবহিত করবেন। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রয়োজনীয় বার্তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে তৃণমূলে।

৪ মে, ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে