উৎপল রায় : পুষ্প (৩২)। স্নাতকোত্তর পাস করে কয়েক বছর আগে রাজধানীর উত্তরার একটি বায়িং হাউজে চাকরি নেন। পুষ্প যখন ছাত্রী ছিলেন তখন তার জন্য বিয়ের অনেক প্রস্তাব আসতো। কিন্তু এখন সে সংখ্যা বেশ কমে গেছে।
রুচিতা (৩০)। দেখতে সুন্দরী। একটি খ্যাতনামা এনজিওতে বড় কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন প্রায় ৪ বছর ধরে। রুচিতার সমস্যাও পুষ্পের মতো। একসময় পাত্রদের ভিড় থাকলেও এখন আর সে অবস্থা নেই। পুষ্প-রুচিতার মতো অনেক উচ্চশিক্ষিত মেয়েদের ক্ষেত্রেই বিয়ে নিয়ে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। মূলত সমপর্যায়ের শিক্ষিত পাত্র না পাওয়ার কারণেই তৈরি হচ্ছে এই সংকট।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞানী ড. সাদেকা হালিম এ প্রসঙ্গে বলেন, এক্ষেত্রে ছেলেরা মনে করে সে যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে সেই মেয়েটি উচ্চ শিক্ষিত স্বাবলম্বী, তার নিজের চিন্তা ভাবনা আছে, সে ওই মেয়েকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না, বয়সটা একটু কম হলে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে- এ ধরনের হীনমন্যতা ছেলেদের মধ্যে কাজ করে। আর আমাদের সমাজ ব্যবস্থাটাই এ ধরনের মানসিকতা তৈরি করে। আর এ বিষয়গুলোই কিন্তু একটি উচ্চশিক্ষিত মেয়ের বিয়েতে প্রভাব পড়ে।
তিনি বলেন, এলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এখনো নারীকে পণ্য হিসেবে দেখা হয়, একজন মানুষ হিসেবে দেখা হয় না। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে যৌথ আয়ের পরিবার বাড়ছে। আর যৌথ আয়ের পরিবারে একটি মেয়েকে নানা চাপের মধ্যে থাকতে হয়। তার সংসারের চাপ, কর্মস্থলের চাপ ইত্যাদি। এ জন্য পুরুষদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। উচ্চশিক্ষিত নারীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার যে চিন্তা, সেই হীনমন্যতা ত্যাগ করা উচিৎ। এখানে নারীকে নিয়ন্ত্রণে রাখা বা হীনমন্যতায় ভোগার বিষয় নেই। নারী বা স্ত্রীকে প্রতিযোগী ভাবারও কোনো কারণ নেই।
ড. সাদেকা হালিম আরো বলেন, মেয়েদের পড়াশুনা কিন্তু ছেলেদের মতো না। ছেলেরা পড়াশুনা করে চাকরির জন্য। কিন্তু মেয়েরা পড়াশুনা করলে তার চিন্তা ও মননশীলতায় পরিবর্তন আসে এবং সে যে একজন মানুষ সেই স্বীকৃতিও ওই নারী পাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পারিপার্শ্বিকতা বা কিছু পুরুষের নারী সম্পর্কে নেতিবাচক মানসিকতা নারীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। মজার বিষয় হচ্ছে- যে ছেলে কম বয়সী শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করতে চায়, কিছু ক্ষেত্রে সেই মেয়েও কিন্তু কিছুদিন পরে চাকরি করে।
‘নিজেরা করি’র সমন্বয়ক ও নারীনেত্রী খুশী কবির বলেন, স্ত্রীর বয়স কম হলে তার পরিণত অবস্থান কম হবে, আর লেখাপড়া কম হলে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা কম থাকবে। এক্ষেত্রে একজন পুরুষ কিন্তু তার স্ত্রীকে সঙ্গী হিসেবে দেখছে না। এটি কিছু পুরুষের অপরিণত মানসিকতা। একই সঙ্গে আস্থাহীনতাও। যার নিজের ওপর আস্থা কম থাকে তখন সে অন্যজনকে দমন করতে চায়। তারও যে কর্তৃত্ব আছে এটিও প্রমাণ করতে চায়। তবে, যার নিজের ওপর আস্থা আছে তার কর্তৃত্ব কোথাও প্রমাণ করতে হয় না।
তিনি বলেন, আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছে যে, পুরুষ মানেই এমন একটি চরিত্র থাকতে হবে, যেটা টিকিয়ে রাখার জন্য পুরুষ নারীকে ভয় পায় যে নারীকে তার অধীনস্থ রাখতে পারবে না। এটা পুরুষের দুর্বলতা। তবে, সবাই যে এমন তা কিন্তু নয়। অনেকে পুরুষ উচ্চশিক্ষিত কর্মজীবী নারীকে বিয়ে করে সুখে সংসার করছেন। খুশী কবির বলেন, বিয়ে শুধু একজনের সঙ্গে আরেকজনের সম্পর্কই নয়, এটি একটি ‘পার্টনারশিপ’। কিন্তু এখনো কিছু পুরুষ নারী সম্পর্কে তাদের নেতিবাচক অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। আর ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, একজন শিক্ষিত, কর্মজীবী নারীকে নিয়ে অভিভাবক এবং সমাজের ভয় পাওয়ার কোনই কারণ নেই। কারণ নারী যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, তাহলে সেই নারী বিবাহিত না হলেও কিছু যায় আসে না।
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট ফওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, শিক্ষিত মেয়েরাই কিন্তু ভালো গৃহিণী, ভালো মা এবং ভালো মানুষ হয়। একজন কম শিক্ষিত নারীকে তার স্বামীর অর্থের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু একজন শিক্ষিত ও কর্মজীবী মেয়েকে ওই সমস্যায় পড়তে হয় না, সে তেমন অপচয়ও করে না। কিন্তু যে পরিবারের ছেলেরা নেতিবাচক পারিবারিক শিক্ষা পায় তাদের মধ্যেই আসলে এ ধরনের নেতিবাচক মানসিকতা কাজ করে। কেউ কেউ চিন্তা করে, একটু বেশি বয়সী মেয়ে বিয়ে করলে হয়তো সন্তান জন্ম দিতে পারবে না। টেলিভিশনে বা অন্য কোনো মাধ্যমে সুন্দরী মেয়েদের ছবি ছেলেদেরকে সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখায়।
তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষ করে স্কুলগুলোতে যেভাবে পড়াশুনা হচ্ছে তাতে সেখানে ছোটবেলা থেকেই মেয়েদেরকে সম্মান দেয়া হয় না। স্কুলগুলোতে বোঝানো হয় স্বামীর পায়ের নিচেই স্ত্রীর বেহেস্ত। স্বামী ছাড়া এটা হবে না, ওটা হবে না। এমনকি অনেক পরিবারের পারিবারিক সিদ্ধান্তের বেলায়ও নারীরা আসতে পারে না। বলা হয়, নারীরা পারিবারিক আলোচনার কি বোঝে? এখন এই ধরনের মানসিকতা যখন চলতে থাকে তখন কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতি বেরিয়ে আসে।
এডভোকেট ফওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, শিক্ষিত মেয়েদের যে বিয়ে হচ্ছে না তা কিন্তু না। তবে, আমি মনে করি নারী সম্পর্কে পুরুষদের ওই ধরনের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে এবং অদূর ভবিষ্যতে অবশ্যই তা হবে। -মানবজমিন
১৪ মে, ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/এসবি