মাহমুদ আজহার : জয়পুরহাট বিএনপিতে মোজাহার আলী প্রধান আর সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোস্তফার দ্বন্দ্ব পুরনো। এ দ্বন্দ্ব নতুন রূপে প্রকাশ পায় ৯ মে। কেন্দ্রীয় নেতাদের জেলা সফরের অংশ হিসেবে জয়পুরহাট যান বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক। এ উপলক্ষে জেলা টাউন হল সম্মেলনকক্ষে ডাকা হয় কর্মিসভা।
সেখানে জয়নুল আবদিন ফারুকের উপস্থিতিতেই শুরু হয় দুই গ্রুপের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। এক পর্যায়ে তা রূপ নেয় সংঘর্ষে। এতে দুই গ্রুপের ১০ জন আহত হন। শুধু জয়পুরহাটই নয়, কেন্দ্রীয় নেতাদের তৃণমূল সফর আর জেলা কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে বিএনপির পুরনো কোন্দল নতুন রূপে প্রকাশ পাচ্ছে। জানা যায়, বিএনপির সাংগঠনিক জেলা বর্তমানে ৮২টি। গত তিন বছরেও সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে অর্ধেক জেলার কমিটি দিতে পারেনি বিএনপি। আবার ঘোষিত কমিটির অধিকাংশই কেন্দ্র থেকে দেওয়া।
কাউন্সিল হয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি জেলায়। এতে এক পক্ষ খুশি হলেও আরেক পক্ষ ক্ষুব্ধ। ফলে পূর্ণাঙ্গ কমিটিও হয়নি অনেক জেলায়। এ নিয়ে তৃণমূলের পুরনো কোন্দল নতুন রূপে দেখা দিয়েছে। এদিকে কেন্দ্রীয় নেতাদের জেলা সফরকে কেন্দ্র করে গ্রুপভিত্তিক নেতা-কর্মীরা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। শোডাউন-পাল্টা শোডাউনও চলছে। অবশ্য বিএনপি একে ইতিবাচকভাবেই দেখছে। এতে দল সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় হচ্ছে বলে মনে করেন নেতারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘জেলা সফরে নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হলেও রাজনৈতিক দলের নানা কর্মসূচি থাকে। তা ছাড়া সময়মতো কর্মসূচি করতে অনুমতিও পাওয়া যায় না। তাই আরও কয়েক দিন সময় বাড়ানো হয়েছে। কমিটি গঠনে সব কটিতে কাউন্সিল না হলেও জেলা ও উপজেলা নেতাদের মতামতের ভিত্তিতেই দেওয়া হচ্ছে। বিএনপির মতো জনপ্রিয় দলের কমিটিতে জায়গা পেতে প্রতিযোগিতা থাকবেই। একে কোন্দল বলা যাবে না।’
মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতা আর সাধারণ সম্পাদক মইনুল হোসেন খান শান্তর মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ১৬ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণার পর কোনো বৈঠক হয়েছে কিনা নেতা-কর্মীরা জানেন না। কমিটির কার্যক্রম পুরোপুরি স্থবির। পূর্ণাঙ্গ কমিটি কবে হবে তা কেউ বলতে পারছেন না। বিএনপির কারণে জেলা যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অন্য অঙ্গসংগঠনের কার্যক্রমও নেই বললেই চলে। সারা দেশে জেলা সফরের হাঁকডাক হলেও মানিকগঞ্জ বিএনপি নেতারা নীরব। এর আগেও মানিকগঞ্জে বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল হারুনার রশীদ খান মুনু্নর।
পটুয়াখালীতে একই স্থানে বিএনপির দুই গ্রুপের সমাবেশ ঘিরে সম্প্রতি বিএনপির কর্মিসভা ভণ্ডুল হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেওয়ার কথা ছিল স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর। জেলা সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে জেলার সাবেক সাধারণ সম্পাদক স্নেহাংশু সরকার কুট্টি, শাহাদাত হোসেন মৃধা ও মোস্তাক আহমেদ দীপুর দ্বন্দ্বের কারণে এখন পর্যন্ত কর্মিসভা হয়নি সেখানে। নেতা-কর্মীরাও দ্বিধাবিভক্ত। চুয়াডাঙ্গা বিএনপিতে এখন চতুর্মুখী দ্বন্দ্ব। দেড় বছর আগে আহ্বায়ক কমিটি হলেও এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি জেলা নেতৃত্ব। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই স্নায়ুযুদ্ধ চলছে জেলার আহ্বায়ক অহিদুল ইসলাম বিশ্বাসের।
এ ছাড়া জেলা বিএনপির সদস্য মো. কামরুজ্জামান ও শরিফুজ্জামান নতুন দুটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। জেলা নেতাদের দ্বন্দ্বে অঙ্গসংগঠনগুলোর কার্যক্রমও স্থবিরপ্রায়। চাঁদপুরে আহ্বায়ক শেখ ফরিদ আহমেদ মানিকের বিরুদ্ধে একাট্টা জেলার সাবেক মন্ত্রী-এমপিরা। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আ ন ম এহছানুল হক মিলন, ইঞ্জিনিয়ার মমিনুল হক, রাশেদা বেগম হীরা, জি এম ফজলুল হক, এস এ সুলতান টিটু, মোস্তফা খান সফরী, শফিকুর রহমান ভূইয়াসহ সবাই মানিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আছেন। এ কারণে এখনো জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। মেয়াদোত্তীর্ণ মাদারীপুর জেলা বিএনপিতে তিনটি গ্রুপ সক্রিয়। এক গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন জেলা সভাপতি আবু বকর সিদ্দিকী (আবু মুন্সি) ও জাহান্দার আলী জাহান।
অন্য দুটির একটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক খন্দকার মাশুকুর রহমান মাশুক ও যুবদল সভাপতি মিজানুর রহমান মুরাদ। এ ছাড়া সুনামগঞ্জে ফজলুল হক আসপিয়ার সঙ্গে নাছির চৌধুরী এবং মৌলভীবাজারে নাসের রহমান বনাম খালেদা রাব্বানীর দ্বন্দ্ব অনেকটাই প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। সম্প্রতি কর্মিসভা ঘিরে বরিশাল উত্তর জেলা বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে তুমুল হট্টগোল, চেয়ার ছোড়াছুড়ি এবং হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। এতে বিব্রত হয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ কেন্দ্রীয় নেতারা।
বরিশাল মহানগরে গতকাল যুবদলের পদবঞ্চিত নেতাদের একটি অংশ জেলা ও মহানগর বিএনপি অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেয়। এ নিয়ে চলছে চরম উত্তেজনা। বরিশাল বিভাগের সব কটি জেলাতেই দলীয় কোন্দল রয়েছে। চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ জেলা এবং ঝিনাইদহে কর্মিসভায় দলটির নেতা-কর্মীদের দুই পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত ৩২ জন আহত হন। চট্টগ্রাম উত্তরে সংঘর্ষের কারণে কর্মিসভা হয় সংক্ষিপ্ত। এ কারণে চট্টগ্রাম দক্ষিণের কর্মিসভায় কেন্দ্রীয় নেতারা যাননি। রাজশাহী মহানগরী ও জেলায় নতুন নেতৃত্ব এলেও এখনো গতিশীল হতে পারেনি সংগঠন। আগের ও বর্তমান নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব এখনো চরমে। নতুন নেতৃত্বকে রুখতে রাজশাহী মহানগরীতে দলীয় অফিসে তালাও দেওয়া হয়।
ছয় নেতাকে অব্যাহতি দেওয়ার পর থেকে খুলনা মহানগরী ও জেলা বিএনপিতে উত্তেজনা চলছে। ময়মনসিংহ দক্ষিণ ও উত্তর জেলা এবং মহানগর বিএনপির কমিটি গঠনকে ঘিরেও নেতা-কর্মীদের মধ্যে পুরনো কোন্দল এখন প্রকাশ্যে এসেছে। দলটিতে এখন পদ-পদবি ঘিরেই চলছে ব্যাপক লবিং-গ্রুপিং।
ফেনী বিএনপির নতুন কমিটি ঘিরে শুরু হয়েছে ব্যাপক লবিং-গ্রুপিং। দীর্ঘ আট বছর কাউন্সিল না হওয়ায় জেলা বিএনপি এখন অন্তঃকোন্দলে জর্জরিত। নতুন কমিটিতে পদ-পদবির আশায় নেতারা তৎপর হয়েছেন।
এদিকে ২২ এপ্রিল থেকে ৭ মে— এই সময়ের মধ্যে ৮২টি সাংগঠনিক জেলায় কর্মিসভা করতে কেন্দ্রীয় নেতাদের নেতৃত্বে ৫১টি দল গঠন করেছিল বিএনপি। ১৮ এপ্রিল দলনেতাদের এ-সংক্রান্ত যে চিঠি দেওয়া হয়েছিল, তাতে ‘দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা, দলের অবস্থান ও দলের ঐক্য’ নিয়ে বক্তব্য দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
২৫ এপ্রিল এই কমিটিগুলো গঠনের ঘোষণা দিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘আন্দোলন, নির্বাচন সব বিষয়ে আলোচনা হবে এবং আমরা আশা করছি এই সফরের ফলে দলের ঐক্য আরও বৃদ্ধি পাবে। আমাদের নেতা-কর্মীরা আরও উজ্জীবিত হবেন।’ কিন্তু মাঠের বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। কোনো কোনো স্থানে সরকারের বাধাও ছিল। আবার কোনো কোনো স্থানে দলীয় কোন্দলের কারণে কর্মিসভা করতে পারেনি বিএনপি। এ নিয়ে চিন্তিত দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। বিডি প্রতিদিন
১৪ মে, ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/এসবি