পীর হাবিবুর রহমান : আমার লেখা যখন ছাপা হবে তখন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বিদায় নিয়ে নেবেন। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে তার আগের দিন একদিকে তিনি বের হবেন, অন্যদিকে নতুন রাষ্ট্রপতি দলিত সম্প্রদায় থেকে বিজেপির মনোনয়নে বিজয়ী রামনাথ কোবিন্দ প্রবেশ করবেন।
প্রণব মুখার্জির আগে কোনো বাঙালি রাষ্ট্রপতি ভবনে অভিষিক্ত হওয়ার নজির নেই। তিনি ভারতবর্ষের রাজনীতির দীর্ঘ পথ হাঁটা একজন নন্দিত নায়কই ছিলেন না, বাংলাদেশের মানুষের আপনজন ছিলেন।
চিত্রা নদীর তীরের শিল্পী এস এম সুলতানের শহর নড়াইলের জামাই ছিলেন। বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের জনগণের জন্য তিনি হৃদয়নিঃসৃত ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি রাখতেন। দুই দেশের বন্ধুত্ব ও মৈত্রী দীর্ঘজীবী হোক তা চাইতেন। বাঙালির গর্ব ছিল তাকে নিয়ে। দিল্লীর রাজনীতির এই দাপুটে নেতা রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বিদায়ের মধ্য দিয়ে বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটালেন।
তার আগে পশ্চিমবঙ্গের দাপুটে মূখ্যমন্ত্রী, কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুও ছিলেন বাংলাদেশের আরেক অকৃত্রিম বন্ধু। তার ভারতের প্রথম বাঙালি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু তার দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে গিয়ে জীবনের এমন সুযোগই হাতছাড়া করেননি, প্রথম বাঙালি প্রধানমন্ত্রী হবার সুযোগটিও হারান। তার আন্তরিকতায় ৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকার ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক গঙ্গা চুক্তি সম্পন্ন করতে পেরেছিল।
লোকসভার সাবেক স্পিকার ও কমিউনিস্ট নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় পরিষ্কার বলেছেন, পার্টির নেতা প্রকাশ কারাতি বারবার পার্টির ক্ষতি করেছেন। প্রকাশ কারাতের বাংলা নীতির কারণে, তার বাঁধার কারণে জ্যোতি বসু যেমন একজন বাঙালি হিসাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি, তেমনি তিনিও হতে পারেননি রাষ্ট্রপতি। কারাতের বাঁধা না এলে তিনি যেমন প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি হতেন, তেমনি জ্যোতি বসু হতেন ভারতের প্রথম বাঙালি প্রধানমন্ত্রী।
যাই হোক, ভারতের মতো প্রভাবশালী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন প্রণব মুখার্জি। একজন আপাদমস্তক বাঙালিই নন, একজন আপাদমস্তক গণমূখী রাজনীতিবিদই নন; ব্যাপক পড়াশুনা জানা একজন উদার গণতন্ত্রী ছিলেন। তিনি রাষ্ট্রপতি থাকাকালে যতবার দিল্লী গেছি তার স্নেহ-সান্নিধ্য কুড়িয়েছি। এক জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া মনে হয়েছে তাকে। প্রতিবার সাক্ষাতকালে এক ঘন্টার বৈঠক এত দ্রুত চলে যেত চিন্তাই করতে পারি না। এত পড়াশুনা, এত রেফারেন্স, এত ইতিহাস জানা রাজনীতিবিদ ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ প্রণব মুখার্জি।
প্রতিনিয়ত আমার উপলব্ধি হয়েছে, ভারতবর্ষের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে গান্ধী পরিবার যদি তাদের অনুগত অক্সফোর্ডের শিক্ষক ড. মনমোহন সিং কে দ্বিতীয় দফা প্রধানমন্ত্রী না করে রাষ্ট্রপতি করতো আর প্রণব মুখার্জিকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে অভিষিক্ত করতো, তাহলে ভোটের রাজনীতিতে কংগ্রেস ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন না করলেও ইতিহাসের এমন করুণ পরাজয় দেখতে হতো না।
ছোট বড় সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রণব মুখার্জীর যে ব্যক্তিগত উষ্ণ সম্পর্ক ছিল সেটিকে তিনি লোকসভার নির্বাচনে কাজে লাগাতে পারতেন। তার মতো বিদ্যান রাজনীতিবিদ ও ভারতের রাষ্ট্রনায়কের প্রতি সকল দলের, সকল মতের মানুষের শ্রদ্ধা ছিল।
১৯৬৯ সালের নির্বাচনে উঠে আসা সংসদীয় রাজনীতির আলোকিত তারকা প্রণব মুখার্জি ধীর লয়ে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে জাতীয় রাজনীতিতে তার জায়গা করেছিলেন। রাষ্ট্রপতির আসন থেকে বিদায় নেবার আগে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেদিন আগের বারের চেয়ে তাকে অনেক ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। তিনি বলেছিলেন, সংসদীয় রাজনীতি থেকে রাষ্ট্রপতির শাসনামলসহ দুই খন্ডের আত্নজীবনী লিখছেন। একখন্ড ইতিমধ্যে প্রকাশ হয়ে যাওয়ার কথা। তিনি আর রাজনীতিতে ফিরবেন না, কিন্তু কিভাবে বাকি জীবন কাটাবেন সেই পরিকল্পনা এখনো করেননি। রাষ্ট্রপতি থাকাকালেই তিনি তার জীবনসঙ্গীনি শুভ্রা মুখার্জীকে যেমন হারিয়েছেন, তেমনি তার পুত্র লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তার কন্যা দিল্লীর রাজনীতিতে কংগ্রেসের নেতৃত্বে উঠে আসছেন।
প্রতিবার তিনি হৃদয় থেকে বলেছেন, তিনি চান ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব চির অটুট থাক। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দুই দেশ একযোগে কাজ করুক। গল্পে গল্পে আরো জেনেছি, বাংলাদেশে তার দুজন ভাই-বোন রয়েছেন। একজন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যার সঙ্গে তার সপ্তাহে দুদিন কথা হয়। শেখ হাসিনা তার জন্য নিয়মিত বই উপহার দেন। প্রখ্যাত লেখিকা সেলিনা হোসেনের একাত্তরের কালোরাত্রি পেয়ে তিনি বারবার পড়ে মুগ্ধ হয়েছেন। সহজ, সরল ভাষায় বলেছিলেন; এত আমার কাছে ভগবত গীতা হয়ে গেছে। বারবার পড়ি।
বাংলাদেশের লেখকদের অনেক বইয়ের সঙ্গে সেলিনা হোসেনের গায়ত্রী সন্ধ্যা, হুমায়ূন আহমদের জোছনা ও জননীর গল্প এবং ইমদাদুল হক মিলনের নূরজাহান তাকে উপহার দিয়েছিলাম। বই পাগল এমন রাজনীতিবিদ আমি কম দেখেছি। রাষ্ট্রপতি ভবনের লাইব্রেরীর সংগ্রহশালাও অনেক বড়। একবার বলেছিলেন, এখানে এত বই, পড়ে শেষ করা যায় না। যতবার তার সঙ্গে দেখা করতে গেছি, হাতের কাছে বই ছাড়া কিছু পাইনি। বলেছেন, খাদি পাঞ্জাবি ও ধুতি তার প্রিয় পোশাক। কিন্তু রাষ্ট্রপতি হওয়ার কারণে তাকে স্যুট পরে থাকতে হয়।
একাত্তরের বীর যোদ্ধা ও ৭৫ এর প্রতিরোধ যোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমকে গভীর স্নেহ করতেন। বাঘা বলেই তিনি ডাকতেন। বলেছিলেন, ৮৬ সালের নির্বাচনে কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম তাকে একটি পানির জাঁর উপহার দিয়েছিলেন। নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার করার জন্য। এখনো সেটি তিনি সংরক্ষণ করে রেখেছেন। প্রণব মুখার্জির বিদায় লগ্নে বারবার মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের জন্য বা ভারতের বাঙালিদের জন্য রাষ্ট্রপতি ভবনের দরজা যেভাবে খোলা থাকতো, সেভাবে আর খোলা থাকবে না। আমাদের পরম আশ্রয়ের, আমাদের পরম ভালোবাসার একজন শ্রদ্ধার মানুষ রাষ্ট্রের উচ্চ আসন থেকে বিদায় নিলেন।
বিদায় সততই বেদনার। তার রাজনৈতিক জীবন বর্ণাঢ্য হলেও, গৌরবময় হলেও, সফল হলেও এই বিদায় বেদনার। বিদায়কালে তার রাজনীতির তীর্থস্থান লোকসভায় দেয়া বিদায়ী সংবর্ধনায় তিনি যে কথা বলেছেন তা আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্যও অনুকরণীয়। লোকসভার সেন্ট্রাল হলে সংসদ সদস্যদের দেয়া সংবর্ধনায় তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আবেগ, উদ্যম, সৌজন্য এবং উষ্ণতার প্রশংসা করার পাশাপাশি নরেন্দ্র মোদি জামানায় যেভাবে কোনো আলোচনা ছাড়াই বিল পাস করানো বা সংসদকে এড়িয়ে অধ্যাদেশ আনা হয়, তারও সমালোচনা করলেন তিনি।
তার নেত্রী ইন্ধিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরিণতির দিকটিও তুলে ধরতে ভুলেননি। বলেছেন, তার নেত্রী ছিলেন ইন্ধিরা। সত্য বলতে কখনো দ্বিধা করতেন না। জরুরি অবস্থার জেরে কংগ্রেসের পরাজয়ের পর লন্ডনে সাংবাদিকরা ইন্দিরাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘ জরুরি অবস্থা থেকে লাভ কি হলো?’। ইন্দিরার জবাব ছিলো, ‘এই একুশ মাসে ভারতের সব অংশের মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পেরেছি।’ জবাব শুনে প্রথমে নিরবতা তারপর অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন সবাই। কেউ আর কোনো প্রশ্ন করেননি।
এই দৃষ্টান্ত দিয়েই প্রণব মুখার্জি বলেন, ‘তখনই আমি শিখেছিলাম, নিজের ভুল স্বীকার করে তা শুধরে নিতে। অজুহাত দেয়ার থেকে নিজেকে শুধরে নেয়া সব সময় ভালো।’ প্রণব সেদিন গণতন্ত্র প্রসঙ্গে উদার গণতন্ত্রী পণ্ডিত জহুরলাল নেহেরুর একটি মন্তব্যকেও উদ্বৃত করেছেন। তিনি বিভিন্ন মতের নেতাদের কথাও উল্লেখ করেছেন। একই সঙ্গে বলেছেন, একমাত্র বাধ্য না হলে আর্থিক বিষয়েও অধ্যাদেশ আনা উচিত নয়। আইন তৈরির জন্য যেভাবে সময় কমছে, তা ‘ দুর্ভাগ্যজনক।’ আলোচনা ছাড়াই আইন হচ্ছে। এতে মানুষের বিশ্বাস ভঙ্গ হচ্ছেও বলে মনে করেন তিনি।
ভারতে যখন রাষ্ট্রপতি ভবনে পালাবদলের পর্ব চলছিল, তখন এদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ তার রাজনৈতিক সহকর্মী পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারসহ আকস্মিক দিল্লী সফর করেছেন। দিল্লী বা বিদেশ তিনি হামেশাই যাচ্ছেন। কিন্তু এইবার দিল্লী থেকে ফিরে এসেছেন উৎফুল্ল চিত্তে।
আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এরশাদ এমনকি দিল্লী বিজয় করে আসলেন যে, ঢাকায় নামার সময় দলের নেতাকর্মীরা বিমানবন্দরের বাইরে ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে সমাগত হলেন। আর তৈরি করলেন ব্যাপক যানজটের। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের জন্য রাজনীতি করলেও তাদের কর্মসূচি প্রণয়নে জনদুর্ভোগের কথা কখনোই আমলে নেন না।
৯০ সালে ক্ষমতা হারিয়ে ৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে একটি অবাদ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে মানুষ স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলেও অকপটে বলা যায়, সেই ভোটযুদ্ধে এরশাদ ও তার জাতীয় পার্টির জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড অন্য দলগুলোর সঙ্গে সমান ছিল না। কারাগারে বসে এরশাদ ৫ টি আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন। তার পার্টির নেতারা হয় পলাতক নয় কারাবন্দী ছিলেন। পার্টির ওপরে দমন নির্যাতন ছিল কি তত্বাবধায়ক সরকার, কি বিএনপি জামানায়। কিন্তু ৯৬ সালের ভোটেও কারাবন্দী এরশাদ ৫ টি আসনে বিজয়ী হয়েছেন। তার পার্টি ৩৫ টি আসন নিয়ে সংসদে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসাবে আর্বিভূত হয়েছে।
সংসদীয় গণতন্ত্রের নবযাত্রায় শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বিএনপি সরকার বিরোধী আন্দোলনে যুগপৎ ভূমিকা রেখেছে। শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে এরশাদ কারামুক্ত হয়েছেন। তার পার্টির মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ঐক্যমতের সরকারের মন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু নিয়তির অমোঘ নিয়মে ১৮ টির বেশি মামলার কারণে বরাবরই এরশাদ শাসকদলের রোষানলে পরেছেন।
যখনই খেলতে গেছেন, তথনই হুমকি নতুবা জেল তাকে খাটতে হয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বে ৪ দলীয় জোট গঠনে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তির ভূমিকা রেখেছিলেন। পরিণতিতে জেল খাটতে হয়েছে, জরিমানা দিতে হয়েছে এবং নির্বাচনের বাইরে থাকতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টিতে ভাঙন হয়েছে এবং ভোট লড়াইয়ে মাত্র ১৪ টি আসন নিয়ে ঘরে ফিরলেও ভোটের পরদিন তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে।
রাজনৈতিক মামলার কারণে বারবার রাজনৈতিক খেলার শিকার হয়েছেন এরশাদ। নানান সময়ে নানা কৌশল নিয়েছেন। কখনো এক নৌকা আবার কখনো বা দুই নৌকায় পা দিয়েছেন। একদা রংপুর ছিল তার রাজনীতির দূর্গ। সিলেট হয়ে উঠেছিল দ্বিতীয় দূর্গ। ২০০৬ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে ইদুর-বিড়াল খেলে খেলে তিনি শেষপর্যন্ত পল্টনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটেই যোগ দেন।
সেই পল্টন তুমুল করতালিতে তাকে অভিষিক্ত করেছিল। সেইবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার দুই দলের পক্ষে ঐক্যের যে চুক্তিনামা করেছিলেন সেখানে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, নির্বাচন, সরকার গঠন ও এরশাদকে ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রপতি করার অঙ্গীকার ছিল। কিন্তু ওয়ান ইলেভেন এসে সেই নির্বাচন বাতিল করে দেয়।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি মহাজোটের শরিক হলেও আগের চুক্তি বাতিল হয়ে যায়। ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ২০০৬ সালের নির্বাচন যেখানে বাতিল সেখানে চুক্তিও বাতিল। এরশাদের আর রাষ্ট্রপতি হওয়া হয়ে উঠেনি। প্রায় সম সংখ্যক আসন নিয়ে এলেও সংসদে বিরোধী দল হয়ে যায় বিএনপি। ২০১৪ সালের ৪ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সেই নির্বাচন বর্জন ও প্রতিরোধের ডাক দেয়। এরশাদ জাতীয় পার্টিকে নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন।
সমঝোতা হয়েছিল, ৭০ টি আসন আওয়ামী লীগ ছাড় দেবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি নির্বাচন বর্জনের ডাক দিলেও নিজেকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের শয্যায় নিয়ে গেলেও রাজনীতির কূট কৌশলে ভোটের ময়দান থেকে প্রত্যাহার করতে পারেননি। আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন বাবলুকে নিয়ে সেই সংকটে পার্টির হাল ধরে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে অংশ নেন রওশন এরশাদ। সংসদে বিরোধী দল হয়ে আসে জাতীয় পার্টি। কিন্তু খেলার মাঠে রেড কার্ড দেখাতে গিয়ে উল্টো তাকে এই খেসারত দিতে হয় যে, বিরোধী দলীয় নেতার আসনটি হাতছাড়া হয়ে রওশনের কাছে চলে যায়। পার্টি থাকে এরশাদের, সংসদীয় দল হয়ে যায় রওশনের।
তবুও এরশাদ পরিস্থিতি বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে সামগ্রিক গতি প্রকৃতির বিবেচনায় রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় হয়ে উঠেন। পার্টির মহাসচিব কিছুদিন জিয়াউদ্দিন বাবলুকে করলেও সেটি চলে ফের রুহুল আমিন হাওলাদারের হাতে। জিয়াউদ্দিন বাবলু হয়ে যান ভাগ্নী জামাই। এরশাদ শক্তি সঞ্চয়ে মাঠে নেমেছেন। আগামী নির্বাচন তার আখেরি লড়াই। একটি বার রাষ্ট্রপতি হওয়ার শেষ ইচ্ছেও তার রয়েছে। যদিও এ নিয়ে এখনো কার সঙ্গে শেষ খেলার ঐক্য হবে সেটি অনিশ্চিত।
তবুও পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দিনের রাজনীতির শেষে আওয়ামী লীগের সঙ্গেই তার দফারফা হবে। সমঝোতার চুক্তিনামা বিএনপির সঙ্গে নয়, আওয়ামী লীগের সঙ্গেই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বিএনপি তাকে টানা ৬ বছর জেল নির্যাতন দিয়েছে। তার পার্টিকে অত্যাচার করেছে। যেখানে সভা সমাবেশ, সেখানেই ১৪৪ ধারা জারি করে পণ্ড করে দিয়েছে। অভিমান আর বেদনার সংঘাতে এরশাদের পাল্লা বোনের দিকেই ঝুঁকছে। অর্থাৎ শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার শেষ সম্ভাবনা প্রবল।
বিএনপিপন্থীরা এরশাদকে যতটা স্বৈরশাসক বলেন, আওয়ামী লীগ অনুসারীরা ততটা বলেন না। কারণ আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খুনি মোশতাক থেকে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের জামানায় সবচে নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অন্যদিকে, এরশাদ জামানায় আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি বেশি নির্যাতন ভোগ করেছে। পার্টি পর্যন্ত ভেঙে গেছে।
এইখানে সখ্যতার বিচারে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির নির্বাচনী সমঝোতার সম্ভাবনাই বেশি। প্রশ্ন উঠতে পারে, আওয়ামী লীগ এরশাদ ও তার জাতীয় পার্টিকে কতটা ছাড় দেবে, সেটি নিয়ে। কারণ ভোট ময়দানে আওয়ামী লীগের শরিকদের মধ্যে ভোটব্যাংক না থাকলেও, শক্তিক্ষয় হয়ে যাওয়ার পরও এরশাদেরই ভোটব্যাংক রয়েছে।
অন্যদিকে, পর্যবেক্ষকরাও মনে করেন, একসময় যারা এরশাদকে সেনাশাসক হিসাবে স্বৈরাচার ও খুনি বলে চিৎকার করেছেন তাদের কণ্ঠও দুর্বল হয়ে গেছে। এরশাদ জামানার পর ক্ষমতার পালাবদলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার যে ধারাবাহিক ঘটনা ঘটে গেছে সেখানে এরশাদকে আর বড় গলায় খুনি, স্বৈরাচার ও লুটেরা বলা যাচ্ছে না। বরং তাকে অনেক উদার, ভদ্র, সজ্জ্বন এবং সহনশীল দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক কেউ কেউ বলছেন।
এরশাদকে প্রতিপক্ষরা যে তীর্যক ভাষায় এত বছর ধরে আক্রমণ করে গেছেন, তিনি সেই ভাষার তার জবাব পর্যন্ত দেননি। এককভাবে ভোটযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার রাজনৈতিক শক্তি তার না থাকলেও ক্ষমতার রাজনীতিতে বড় দলের শক্তিশালী পার্টনার হওয়ার শক্তি রয়েছে। এইবার দিল্লী সফর শেষে এত হাকডাক করে এরশাদ কেন অভ্যর্থনা নিলেন, আগামী রাজনীতি ভোটযুদ্ধ সামনে রেখে কারসঙ্গে তার গাঁটছাড়া বাঁধা হচ্ছে সেদিকেই সবার নজর। -বিডি প্রতিদিন
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এমটিনিউজ/এসএস