শুক্রবার, ২৮ জুলাই, ২০১৭, ১২:৪১:৪১

‘ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা আর মদ ছাড়া কিছুতেই আগ্রহ ছিল না’

‘ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা আর মদ ছাড়া কিছুতেই আগ্রহ ছিল না’

ওরিয়ানা ফ্যালাচি : ইনিই হচ্ছেন আভিজাত্যের প্রতীক জুলফিকার আলী ভুট্টো। মুসলমান ভুট্টো, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি যাকে মৌলিকভাবে বদলাতে পারেনি। এটা কোনো দুর্ঘটনা নয় যে, তার স্ত্রী দুজন। অথবা ভুট্টো যখন সামরিক হেলিকপ্টারে উঠে কোথাও যান, তখন তার মাথায় একটা ক্যাপ থাকে, চৌ এন লাই-এর দেয়া। চৌ এন লাই তার দীক্ষাগুরু।

যখন উড়ে যান তখন উপর থেকে শুষ্ক অনাবাদী জমি দেখে, প্রাগৈতিহাসিক আমলের মতো মাটির কুঁড়েতে কৃষকের আবাস দেখে তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়। এসব দেখে তার হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়, তিনি স্বগতোক্তি করেন, ‘আমাকে সফল হতেই হবে।’ ইনি মার্ক্সবাদী ভুট্টো, যিনি পাকিস্তানকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধার পীড়ন থেকে মুক্তি দিতে সচেষ্ট।

সবশেষে ভুট্টো আমাকে তার করাচি ও রাওয়ালপিন্ডির বাড়িতে আমন্ত্রণ করে তার অবস্থানের পক্ষে যুক্তিগুলো প্রদর্শন করেন, ইন্দিরা গান্ধী, শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খানকে কঠোরভাবে আক্রমণ করে। তার বাড়িগুলো রুচিশীল সাজে সজ্জিত প্রাচীন ইরানী গালিচা, মূল্যবান ধাতব পাত্রের সমাহার। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাড়ির প্রাচীরে তার সবচেয়ে ক্ষমতাধর আন্তর্জাতিক সহকর্মীদের উদ্ধৃতি সংবলিত ফটোগ্রাফ। শুরু হয়েছে মাও সে তুং দিয়ে।

নৈশাহারের সময় আমরা মদ পান করলাম। সম্ভবত ক্যাভিয়ার। উপস্থিত ছিলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী নুসরাত, সুন্দরী এবং ভদ্র আচরণ তার। পরে এলো তার ছেলে। দীর্ঘ চুলবিশিষ্ট প্রাণবন্ত ছোট্ট বালক। এখন ভুট্টো আধুনিক, ধোপদুরস্ত, ইউরোপীয় কেতায়। ভুট্টো তুখোড় বক্তা, গ্রন্থ রচয়িতা, যিনি ইংরেজি জানেন উর্দুর চেয়েও ভালো এবং পাশ্চাত্যের যেকোনো লোককে আকৃষ্ট করার মতো।

ভুট্টোর সাথে সাক্ষাৎকার কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। ঠিক যেমনটা হয়েছিল কিসিঞ্জারের সাক্ষাৎকারে, সাংবাদিকতার দৃষ্টিতে মানোত্তীর্ণ নয়, কিন্তু কূটনৈতিক চাতুর্যে পরিপূর্ণ ও আন্তর্জাতিক ধাঁচের। ইন্দিরা গান্ধী যে তাকে ভারসাম্যহীন লোক বলেছেন তা পাঠ করে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। অতএব ইন্দিরাও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। যখন তিনি পাঠ করলেন যে, ভুট্টো তাকে একজন নগণ্য মহিলা, যার বুদ্ধিশুদ্ধিও অতি সাধারণ, উদ্যোগে ও কল্পনাশক্তি শূন্য এবং যে তার পিতার অর্ধেক মেধাও পাননি বলে উল্লেখ করেছেন।

ভুট্টো তার সাথে সাক্ষাতের ও হাত মিলানোর ধারণাকে বিরক্তিকর বলে মনে করেন। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, ইন্দিরারও ক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তাকে মূল্যায়ন করতে ভুট্টো ঘৃণাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। আমি নিজেও ভুট্টোর এ ধরনের মন্তব্যে অস্বস্তি বোধ করেছিলাম এবং ভুট্টোকে নিবৃত্ত করতেও চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ভুট্টো আমার পরামর্শ নেননি এবং পরিবর্তে আরো আপত্তিকর মন্তব্য যোগ করেছেন, যা আমি প্রকাশ করিনি এবং আমার নিজের এই সেন্সরশিপে খুব ভালো ফল হয়নি। ফলটা ছিল নাটকীয়, বরং বলা যায় হাস্যকর। পরিণতিটা আমারই সৃষ্টি।

ভুট্টো ও ইন্দিরা গান্ধীর তখন সাক্ষাৎ হওয়ার কথা, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের জন্য। নয়াদিল্লির সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বিশেষ কিছু বাক্যে তিনি সতর্ক হয়ে আমাকে অনুরোধ জানালেন সাক্ষাৎকারের পুরোটা তার কাছে পাঠাতে এবং আমি রোম থেকে টেলিগ্রামে তা পাঠালাম। সেটা পাঠ করে তিনি ঘোষণা করলেন যে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার বৈঠকটি হবে না। ভুট্টো হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে আমাকে খুঁজতে লাগলেন। অবশেষে তার ইতালিস্থ রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে সন্ধান পেলেন আদ্দিস আবাবায়। সেখানে আমি গিয়েছি হাইলেসেলাসির সাক্ষাৎকারের জন্য। আমাকে সবচেয়ে আপত্তিকর অনুরোধটাই করা হলো।

হ্যাঁ, আমাকে লিখতেই হবে। ভুট্টো আমাকে দ্বিতীয় একটা রিপোর্ট লিখতে বলেছিলেন, যাতে আমি লিখি যে, ভুট্টোর সাথে কখনোই সাক্ষাৎকার নেয়া হয়নি, বরং আমি এ ধরনের কল্পনা করেছিলাম। আমাকে বলতে হবে, ইন্দিরা গান্ধীর সম্পর্কে মন্তব্য আসলে ভুট্টোর নয়, আমারই কল্পনা এবং আমি ভেবেছিলাম, ভুট্টো এরকমই বলতে পারেন। প্রথমে আমি বুঝতেই পারিনি ব্যাপারটা কি। “আপনি কি বলছেন মি. অ্যামব্যাসেডর?” “আমি বলছি, “আপনার লিখা উচিত যে, আপনি নিজে এসব উদ্ভাবন করেছেন, বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কিত অংশটুকু।”

আপনি কি পাগল, মি. অ্যামব্যাসেডর? আপনার প্রধানমন্ত্রীও কি পাগল হয়ে গেছেন?” “মিস ফ্যালাচি, আপনি নিশ্চয়ই বুঝবেন। ষাট কোটি মানুষের জীবন নির্ভর করছে আপনার উপর, তারা আপনার হাতে।” আমি তাকে জাহান্নামে যাওয়ার অভিশাপ দিলাম। কিন্তু ভুট্টো হাল ছেড়ে না দিয়ে আমাকে খুঁজছিলেন। যেখানেই আমি গেছি সেখানেই একজন গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানি আমাকে অনুরোধ করেছে সাক্ষাৎকারটা অস্বীকার করতে।

বারবার তারা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, ষাট কোটি মানুষ আমার হাতে। হতাশ হয়ে আমি উত্তর দিয়েছি যে, ষাট কোটি মানুষকে ধারণ করার পক্ষে আমার হাত দুটো খুবই ছোট। আমি চিৎকার করে বলেছি যে, তাদের দাবি অসম্ভব এবং অপমানজনক। এ দুঃস্বপ্নের অবসান তখনই ঘটলো যখন ইন্দিরা গান্ধী মহানুভবতার সাথে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, ভুট্টোর এ ধরনের ভুল আর ঘটবে না এবং তারা উভয়ে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করলেন। যখন তারা হাত মিলালেন ও হাসি বিনিময় করলেন, টেলিভিশনে তা দেখে আমার খুব মজা লাগছিল। ইন্দিরার হাসি ছিল বিজয়ের। ভুট্টোর হাসিতে অস্বস্তি।

জুলফিকার আলী ভুট্টো: আমার অবশ্যই বলা উচিত, কেন আমি আপনার সাথে সাক্ষাতের জন্য আকাক্সিক্ষত ছিলাম। কারণ, আপনি একজন সাংবাদিক যিনি শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে সত্যটা লিখেছেন। আপনার লেখাটা আমি দারুণ উপভোগ করেছি। তাছাড়া... দেখুন, মার্চ মাসে ঢাকায় অত্যাচারের ব্যাপারে আমার কিছু করার ছিল, এটা খুব সুখপাঠ্য ছিল না।

ওরিয়ানা ফ্যালাচি: কিছু করার ছিল মানে? মি. প্রেসিডেন্ট, ঢাকায় তারা সরাসরি বলছে যে, আপনিই ধ্বংসযজ্ঞটা চেয়েছিলেন। আপনি মুজিবের গ্রেপ্তার চেয়েছিলেন এবং সেজন্যেই আপনি ২৬শে মার্চ সকাল পর্যন্ত ঢাকায় ছিলেন।


ভুট্টো: হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের উঁচু তলায় আমার স্যুটের জানালা পথে ধ্বংসের দৃশ্য দেখা, হুইস্কি পান এবং সম্ভবত নিরোর মতো বাঁশি বাজাতে। কিন্তু তারা কোন্ সাহসে একটি বর্বরোচিত ঘটনার সাথে আমাকে জড়াতে চায়, পুরো ঘটনাটা পরিচালিত হয়েছিল এক জঘন্য উপায়ে। তারা সকল নেতাকে নিরাপদে ভারতে পালিয়ে যেতে দিয়ে যাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে তারা কোনো কিছুর জন্য দায়ী নয়। শুধু শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। একটু ভেবে দেখুন। আমি হলে আরো একটু চাতুর্য্যরে সাথে কাজটা সম্পন্ন করতাম, আরো বৈজ্ঞানিকভাবে এবং কম নিষ্ঠুরতায়। টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ব্যবহার করতাম এবং সকল নেতাই গ্রেপ্তার হতো।

কেবল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মতো একটি বিরক্তিকর মাতালের পক্ষে এত জঘন্যভাবে এবং রক্তপাত ঘটিয়ে এ ধরনের অপারেশন ঘটানো সম্ভব। সে যাই হোক, এ ধরনের উন্মত্ততা হোক, এটা চাওয়ার পেছনে আমার কি স্বার্থ থাকতে পারে? আপনি কি জানেন যে, ইয়াহিয়া খানের প্রথম শিকার শেখ মুজিব না হয়ে আমার হওয়ার কথা ছিল। আমার পার্টির বহু লোক জেলে ছিল এবং ১৯৭০ সালের শেষ দিকে, হ্যাঁ, ১৯৭০-এর ৫ই নভেম্বর তিনি শেখ মুজিবকে বলেছিলেন, “আমি ভুট্টোকে গ্রেপ্তার করবো কি করবো না?”

একটি মাত্র কারণে তিনি তার সিদ্ধান্ত বদলেছেন তাহলো, পূর্ব পাকিস্তানে যেভাবে তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানে তা পারতেন না। এছাড়া মুজিব কখনোই বুদ্ধিমান ছিলো না। সে নিজেকে কোণঠাসা করে রেখেছিল। ২৫শে মার্চের দুঃখজনক ঘটনায় আমি হতভম্ব হয়েছিলাম। ইয়াহিয়া খান আমাকেও বোকা বানিয়ে ছেড়েছিল। পরের দিনের জন্য তিনি আমাকে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছিলেন এবং দিন শেষে জেনারেল মোহাম্মদ ওমর আমাকে জানালেন যে, ইয়াহিয়া খান চেয়েছিলেন আমি যাতে ঢাকায় অবস্থান করে ‘সেনাবাহিনীর দক্ষতা প্রত্যক্ষ করি।’ আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, এর সব কথাই সত্যি।

ওরিয়ানা ফ্যালাচি: অল রাইট মি. প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আমার অবাক লাগে যে, সেই ভয়াবহ রাতে এবং পরবর্তী মাসগুলোতে আসলে কি ঘটেছিল ইতিহাস কখনো তার সঠিক ব্যাখ্যা দেবে কি না? শেখ মুজিবুর রহমান...।

ভুট্টো: ভারতীয়রা সংখ্যাটা বলেছিল দশ লাখ। মুজিব এটাকে দ্বিগুণ, এরপর তিনগুণ করলো। এই হলো লোকটির বৈশিষ্ট্য। জলোচ্ছ্বাসের সময় সে একই কাণ্ড করেছে। শুনুন, ভারতীয় সাংবাদিকদের মতে সে রাতে মারা পড়েছিল ৬০ থেকে ৭০ হাজার মানুষ। মিশনারীরা বলেছিল ত্রিশ হাজার। আমার পক্ষে যেভাবে সম্ভব হয়েছে সে বিচারে মৃতের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের মতো। এটা অনেক বেশি, নৈতিকভাবে যদি কাজটা সমর্থনযোগ্যও হয়। আমি সংখ্যা কমাতে চাই না, আমি তাদেরকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে চাই, পঞ্চাশ হাজার ও ত্রিশ লাখের মধ্যে বিরাট পার্থক্য।

শরণার্থীদের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে। মিসেস গান্ধী বলেন এক কোটি লোক। এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, তিনি তার প্রতিরোধের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অভিযান চালানোর জন্য তিনি এই সংখ্যা দিয়ে শুরু করেছিলেন। কিন্তু আমরা যখন বিষয়টা তদন্ত করার জন্য জাতিসংঘকে আমন্ত্রণ জানালাম, ভারতীয়রা তার বিরোধিতা করলো।

কেন তারা বিরোধিতা করেছিল? সংখ্যাটা যদি সঠিকই হতো, তাহলে তো তদন্তের প্রশ্নে তাদের ভীত হওয়ার কথা নয়। ঘটনাটা হলো, আসলে এক কোটি নয়, বিশ লাখ লোক গিয়েছিল। নিহতের সংখ্যা বলায় আমার ভুলও হতে পারে, কিন্তু শরণার্থীদের সংখ্যার ক্ষেত্রে নয়। আমরা জানি কে দেশ ত্যাগ করেছিল। বহু বাঙালি ছিল পশ্চিমবঙ্গের। ইন্দিরা গান্ধী তাদের পাঠিয়েছিলেন। বাঙালিরা যেহেতু দেখতে একই রকম, সুতরাং কে তাদের চিনবে?

আরেকটা প্রসঙ্গ বলি, মহিলারা সম্ভ্রনহানীর শিকার ও নিহত হয়েছে। আমি এটা বিশ্বাস করি না। এটা তো নিশ্চিত যে, বাড়াবাড়ির কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু জেনারেল টিক্কা খান বলেছেন যে, ঐ দিনগুলোতে তিনি জনগণকে আহ্বান করেছেন দুর্ব্যবহার সম্পর্কে সরাসরি তার কাছে রিপোর্ট করতে। তার এই আবেদন, লাউড স্পিকারে প্রচার করা হয়েছে এবং তার কাছে মাত্র চারটি ঘটনার রিপোর্ট করা হয়েছে। এটাকে কি আমরা দশ দিয়ে পূরণ করে চল্লিশ করতে পারি? মুজিব এবং গান্ধীর ছড়ানো সংখ্যা থেকে আমরা এখনো দূরে।

ওরিয়ানা ফ্যালাচি: না মি. প্রেসিডেন্ট। ওটাকে হাজারের সাথে পূরণ করুন, এমন কি দশ হাজারের সাথেও পূরণ করতে পারেন, তাহলে আপনি সঠিক সংখ্যার কাছাকাছি আসবেন। মুজিবের ত্রিশ লক্ষ যদি ঢালাও বর্ণনা হয়, তাহলে টিক্কা খানের মাত্র চারটি ঘটনার বর্ণনা রীতিমতো ফাজলামো। চরম নারকীয়তা সংঘটিত হয়েছে। বলবেন কিভাবে? আমি এমন একজন আপনার সাথে কথা বলছি যে, ঢাকায় বহু মৃতদেহ দেখেছি। আপনি কি একটা কথা বলেছেন, ‘নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য, অথবা সমর্থিত? আমি কি ঠিক ধরতে পেরেছি? আপনি কি যথার্থই বুঝাতে চাচ্ছেন যে, এই ধ্বংসযজ্ঞটা নৈতিক দিক হতে সঠিক ছিল?

ভুট্টো: প্রত্যেক সরকারের, প্রত্যেক দেশের অধিকার রয়েছে প্রয়োজন হলে বল প্রয়োগ করার। যেমন, ঐক্যের নামে। ধ্বংস ছাড়া আপনি সৃষ্টি করতে পারেন না। দেশ গড়ার স্বার্থে স্ট্যালিন শক্তি প্রয়োগ ও হত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। মাও সে তুংও বল প্রয়োগ ও হত্যা করেছেন বাধ্য হয়। বিশ্বের পুরো ইতিহাস তুলে না ধরে সাম্প্রতিক কালের দুটো ঘটনাই উল্লেখ করলাম।

হ্যাঁ, এখন কোথায় রক্তপাত ঘটিয়ে দমন করা হবে এবং তা সমর্থনযোগ্য হবে কি হবে না সেটাই বিচার্য। মার্চ মাসে পাকিস্তানের ঐক্য নির্ভর করছিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নির্মূল করার উপর। কিন্তু যারা এর জন্য দায়ী তাদের বদলে জনগণের উপর এ ধরনের নিষ্ঠুরতা চালানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। যে নিরীহ লোকদের বলা হয়েছিল যে, ছয় দফা আদায় হলেই আর কোনো জলোচ্ছ্বাস হবে না, আর কোনো বন্যা হবে না, খাদ্যাভাব হবে না, তাদেরকে বুঝানোর পন্থা এই নিষ্ঠুরতা নয়। আমি কঠোরভাবে এই পন্থা গ্রহণের বিরোধিতা করেছি, বিশেষ করে যখন কেউ মুখ খুলতে সাহস করেনি।

ওরিয়ানা ফ্যালাচি: তবু আপনিই টিক্কা খানকে সেনাবাহিনীর প্রধান নিয়োগ করেছেন, যে জেনারেল এই ধ্বংস যজ্ঞের নির্দেশ দিয়েছিল, তাই না?

ভুট্টো : টিক্কা খান একজন সৈনিক হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিলেন সুনির্দিষ্ট নির্দেশ নিয়ে এবং ফিরেও এসেছেন সেই নির্দিষ্ট আদেশে। তাকে যা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, তিনি তাই করেছেন, যদিও সবকিছুতে তার সম্মতি ছিল না। আমি তাকে নিয়োগ করেছি, কারণ আমি জানি যে, তিনি একই ধরনের শৃঙ্খলার সাথে আমার নির্দেশও পালন করবেন এবং তিনি কখনো রাজনীতিতে নাক গলাবার চেষ্টা করবেন না। আমি গোটা সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করতে পারি না। তাছাড়া ঢাকার ঘটনা নিয়ে তার বদনাম আসলে অতিরঞ্জিত। এ ঘটনার জন্য একজনই কেবল দায়ী, ইয়াহিয়া খান।

তিনি এবং তার উপদেষ্টারা ক্ষমতা নিয়ে এতই মদমত্ত ছিলেন যে, সেনাবাহিনীর মর্যাদার কথাও বিস্মৃত হয়েছিলেন। তারা সুন্দর গাড়ি সংগ্রহ, বাড়ি তৈরি, ব্যাংকারদের সাথে বন্ধুত্ব করা, বিদেশে অর্থ পাচার করা ছাড়া আর কিছু ভাবার সুযোগ পাননি। ইয়াহিয়া খান দেশের সরকার সম্পর্কে উৎসাহী ছিলেন না। নিজের জন্য ক্ষমতা ছাড়া আর কিছুতে তার আগ্রহ ছিল না। ঘুম থেকে উঠেই যিনি মদপান শুরু করেন এবং ঘুমাতে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মদপান বন্ধ করেন না। এ ধরনের একজন নেতা সম্পর্কে কি আর বলা যেতে পারে। তার সাথে কিছু করা যে কি বেদনাদায়ক, সে ধারণাও করতে পারবেন না। তিনি হচ্ছেন জ্যাক দ্য রিপার। (চলবে) এমজমিন

লেখা : ইতালির বিখ্যাত মহিলা সাংবাদিক ওরিয়ানা ফ্যালাসির বই থেকে নেওয়া।
এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে