রবিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৭, ০১:৪৯:৪৯

মানবে না আওয়ামী লীগ

মানবে না আওয়ামী লীগ

মাহমুদ আজহার ও রফিকুল ইসলাম রনি : প্রধানমন্ত্রীকে বাইরে রেখে নির্বাচনকালীন ‘সহায়ক সরকার’ নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে যে প্রস্তাব দেওয়া হবে তা মানবে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের সাত দিন আগে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী নামানোর প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করবে দলটি।

সেই সঙ্গে ২০০৮ সালের আগে নির্ধারিত সীমানা নির্ধারণ, তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই সর্বস্তরের প্রশাসনে রদবদল, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করে সেনাবাহিনীকে ‘ল ইনফোর্সিং এজেন্সি’ হিসেবে যুক্ত করার প্রস্তাবও নাকচ করে দেবে তারা।

কয়েকটি মৌলিক বিষয়সহ অর্ধশত প্রস্তাব নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সংলাপে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। একইভাবে প্রস্তুত হচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে বিএনপির পুরোপুরি বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে সরকারি দল। তাই সংলাপের সফলতা নিয়েও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে নানা উদ্বেগও রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণ পেলে আমরা অংশ নিতে পারি। তবে সংলাপে অংশ নিলে সেখানে আমাদের এক নম্বর প্রস্তাব থাকবে সহায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিয়ে নির্বাচনের সাত দিন আগেই সেনাবাহিনী নামাতে হবে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ডিসি-এসপি পরিবর্তন করতে হবে। একইভাবে ২০০৮ সালের আগে যে সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেই অবস্থায় নির্বাচন কমিশনকে ফিরে যেতে হবে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি মৌলিক বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করছি।’

এ দাবি নাকচ করে দিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে এবং শেখ হাসিনার সরকার সহায়ক সরকারের ভূমিকা পালন করবে। এ  ক্ষেত্রে বিএনপির কান্নাকাটি করেও কোনো লাভ হবে না। নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে বিএনপির দাবি প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, সংবিধানে যেভাবে সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা নির্ধারিত রয়েছে, নির্বাচনকালে সেনাবাহিনী সেভাবেই দায়িত্ব পালন করবে। তিনি এও বলেন, কোনো দাবি পেশ করে তাদের লাভ হবে না। দাবি পেশ করে যদি দাবির বাস্তবায়ন না হয় তাহলে পরাজিত হিসেবে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। এটা কোনো দলের জন্য শুভ নয়।’

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ আধুনিক সব গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশেও আগামী সংসদ নির্বাচন হবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হবে। এটাই বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের মূল ভিত্তি। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনই সংসদ নির্বাচন আয়োজন করবে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে সব ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের কাছেই চলে যাবে। সব পর্যায়ের রদবদলের দায়িত্বেও থাকবে নির্বাচন কমিশন।

সূত্র জানিয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে আওয়ামী লীগ আলাদা বেশকিছু প্রস্তাব তুলে ধরবে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) সংলাপে অংশ নিয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার, অভিন্ন পোস্টারসহ ১২টি নির্দিষ্ট প্রস্তাব দেবে ক্ষমতাসীন দলটি। এর মধ্যে অন্যতম থাকবে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ই-ভোটিং প্রবর্তন। অভিন্ন পোস্টার, নির্বাচনী এলাকায় একটি নির্দিষ্ট জায়গায় জনসভার আয়োজন করা। প্রার্থীদের জামানত ১০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা করা, নির্বাচন কমিশন থেকে প্রার্থীদের নির্দিষ্ট একটি টোকেন মানি সরবরাহ।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিলে তা প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি। তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া পাল্টা একজন ‘সম্মানিত নাগরিক’-এর নেতৃত্বে সাবেক ১০ উপদেষ্টাকে নিয়ে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব দেন শেখ হাসিনাকে। ক্ষমতাসীন দলটির নেতারা মনে করেন, বিএনপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে। না নিলে রাজনীতিতে তাদের অস্তিত্ব থাকবে না।

তারা মূলত নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের কথা বলে নিজেদের আলোচনায় রাখতে চায়। একই সঙ্গে নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা রাখার কৌশল হিসেবে বিএনপি সহায়ক সরকারের কথা বলছে। বিএনপির নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের উদ্দেশ্য একটাই, তা হলো নির্বাচনকালীন সরকারে তাদের প্রতিনিধি রাখা। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচনকালীন সরকারে বর্তমান সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলের লোকেরাই থাকবেন। এর বাইরে কোনো দলের প্রতিনিধি রাখার সুযোগ সংবিধানে নেই ।

এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার নিয়ে বিএনপির কোনো প্রস্তাব মানা হবে না। তারা মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকেই নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার হিসেবে চায়। কিন্তু বর্তমান সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এখন আর নেই। কাজেই নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের নামে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃস্থাপনের কোনো সম্ভাবনাই নেই।’

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, ১৪ দলের মুখপাত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আগামী নির্বাচন নিয়ে কোনো ধরনের কথা বা আলোচনা হবে না। কী আলোচনা করব তাদের সঙ্গে? যারা জঙ্গিদের আশ্রয় দেয়, জ্বালাও-পোড়াও করে, মানুষ মারে, তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়। নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হবে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে। কারণ নির্বাচন কমিশনের অধীনেই নির্বাচন হবে, তারাই আলোচনা করবে। বিএনপির আলোচনাও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গেই হবে।’

বিএনপি সূত্র জানায়, বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা ও সাবেক আমলার সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশনে যাওয়ার প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে কয়েকটি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে আরপিও সংশোধন। আরপিওতে ল ইনফোর্সিং এজেন্সিতে ২০০৯ সালের ধারা পরিবর্তন করে ডিফেন্স সার্ভিস অব বাংলাদেশ পুনঃস্থাপন করতে হবে। নতুনভাবে গঠিত নির্বাচন কমিশনের ৭৯ অনুচ্ছেদের আলোকে সাংবিধানিক ও আর্থিকভাবে স্বাধীন সচিবালয় থাকতে হবে।

নির্বাচন কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ছাড়াও বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রেষণে নির্বাচনে দায়িত্বে নিয়োজিত প্রকাশ্যে রাজনৈতিক মতাবলম্বী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে তাদের নির্বাচনকালীন দায়িত্ব থেকে বিরত রাখতে হবে। জানা যায়, বিএনপির প্রস্তাবে রয়েছে : তফসিল ঘোষণার পরপরই স্বরাষ্ট্র, অর্থ, তথ্য, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য থাকবে।

তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত এ অবস্থা বলবৎ থাকবে। নির্বাচনের সাত দিন আগে থেকে শুরু করে ফলাফলের গেজেট হওয়া পর্যন্ত প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিয়ে সব নির্বাচনী এলাকায় টহলসহ ভোট কেন্দ্রে ও বিশেষ বিশেষ স্থানে মোতায়েন করতে হবে। ছবিসহ ভোটার তালিকা যা নির্বাচন কর্মকর্তাদের হাতে থাকে তার অভিন্ন তালিকা সব প্রার্থীর এজেন্টদের হাতে সরবরাহ করতে হবে।

জানা যায়, প্রস্তাবে আরও রয়েছে : নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাদের হাতেও ম্যাজিস্ট্রেশিয়াল ক্ষমতা থাকতে হবে। সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে পর্যবেক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক কোনো নেতা বা কর্মী থাকতে পারবেন না। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন পদ্ধতিও বাতিলের দাবি থাকবে বিএনপির।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘দেশের বর্তমান বাস্তবতায় সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শুধু একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনই যথেষ্ট নয়। কারণ নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক প্রশাসনিক ও লজিস্টিক সহযোগিতা প্রদান এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব।’ -বিডি প্রতিদিন

এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে