মঙ্গলবার, ০৩ নভেম্বর, ২০১৫, ০২:২৩:৩৯

বিদেশী খুনের পরিকল্পনা হয় ২২ সেপ্টেম্বর

বিদেশী খুনের পরিকল্পনা হয় ২২ সেপ্টেম্বর

আলাউদ্দিন আরিফ : বিদেশী নাগরিককে হত্যা করে আতংক সৃষ্টির পরিকল্পনা করা হয়েছিল ২২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর উত্তর বাড্ডার এক বাসায়। সেখানে ছিলেন ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও বাড্ডার সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আবদুল কাইয়ুমের ভাই এমএ মতিন। তিনি রাসেল চৌধুরী ওরফে চাক্কি রাসেল ওরফে বিদ্যুৎ রাসেল ও মিনহাজুল আরেফিন রাসেল ওরফে ভাগিনা রাসেল ওরফে কালা রাসেলকে একজন সাদা চামড়ার (শ্বেতাঙ্গ) বিদেশীকে হত্যার নির্দেশ দেন। এ জন্য তাদের দুজনের সঙ্গে প্রথমে আলাদা ও পরে একসঙ্গে বৈঠকও করেন। দুই রাসেল নির্দেশ মোতাবেক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য শুটার রুবেলকে ভাড়া করে। তাদের উপস্থিতিতে শুটার রুবেল ৪টি গুলি করে হত্যা করে সিজারি তাভেল্লাকে। কালা রাসেল আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ তথ্য জানায়। রোববার জবানবন্দি শেষে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। আরেক আসামি সাখাওয়াত হোসেন শরীফ সোমবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাহরিয়ার মোহাম্মদ আদনানের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিক সে। এর আগে ২৬ অক্টোবর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় তামজিদ আহম্মেদ রুবেল ওরফে মোবাইল রুবেল ওরফে শুটার রুবেল। আদালত সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডের মাঠপর্যায়ের পরিকল্পনাকারী রাসেল চৌধুরী ওরফে চাক্কি রাসেল ওরফে বিদ্যুৎ রাসেল জবানবন্দি দিতে রাজি হয়নি। আট দিনের রিমান্ড শেষে তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। পুলিশের দাবি, ১৯ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডা ও গুলশান থেকে চার আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের তিনজন নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। তবে স্বজনরা বলছেন, তাদেরকে ১৯ অক্টোবরের আগেই ডিবি পুলিশের পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। হত্যাকাণ্ডের মাঠপর্যায়ের নির্দেশদাতা হিসেবে জবানবন্দিতে নাম আসা এমএ মতিনকেও অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেছে মতিনের পরিবার। যদিও ডিবি অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, মাঠপর্যায়ে যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদেরকে আমরা আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। এখন তদন্তের মাধ্যমে পরিকল্পনাকারী, নির্দেশদাতা ও অর্থদাতাদের খুঁজে বের করা হবে। ২০ অক্টোবর ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, এক বড় ভাইয়ের নির্দেশে সাদা চামড়ার বিদেশী হিসেবে সিজারি তাভেল্লাকে খুন করা হয়। পরদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, সেই বড়ভাই হচ্ছেন বিএনপির নেতা আবদুল কাইয়ুম। তদন্ত সংস্থা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবি ও আদালত সূত্রে কালা রাসেলের জবানবন্দির বিবরণ জানা গেছে। এর আগে দেয়া শুটার রুবেলের জবানবন্দির সঙ্গে এর অনেক মিল রয়েছে। কালা রাসেল বলেছে, বাড্ডা এলাকার কাইয়ুম কমিশনারের ছোট ভাই এমএ মতিনকে বড়ভাই হিসেবে শ্রদ্ধা করে সে। আগে থেকেই তার সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ছিল। কোরবানি ঈদের দুদিন আগে (২২ সেপ্টেম্বর) উত্তর বাড্ডার এক বাসায় মতিনের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। মতিন বলেন, বড় একটা কাজ করে দিতে পারবা? জবাবে হ্যাঁ বলে কালা রাসেল। মতিন বলেন, গুলশান এলাকায় একজন বিদেশীকে গুলি করে হত্যা করতে হবে। তুই চাক্কি রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ কর। এরপর কালা রাসেল যোগাযোগ করে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু চাক্কি রাসেলের সঙ্গে। জবানবন্দিতে কালা রাসেল আরও বলে, মতিন ভাইয়ের প্রস্তাবের পর চাক্কি রাসেলের সঙ্গে এ বিষয়ে সে কয়েকবার কথা বলে। পরে দুজন গিয়ে এমএ মতিনের সঙ্গে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। তার (মতিন) সঙ্গে মোবাইলেও এ বিষয়ে কথা বলেছে তারা। তিনি (মতিন) সাদা চামড়ার বিদেশীকে গুলি করে হত্যা করার নির্দেশ দেন। এ জন্য ৫ লাখ টাকা দেয়ার প্রস্তাব করেন। তিন লাখ টাকা অগ্রিম দেন। তাভেল্লা তাদের খুনের টার্গেট ছিল না। কালা রাসেল আরও জানায়, শুটার রুবেল তার কাছ থেকে ৫০০ ইয়াবা বড়ি নিয়ে তার বন্ধু জনিকে দেয়। জনি একশ পিস বিক্রি করে ১০ হাজার টাকা রুবেলকে দিয়েছে। বাকি ৪শ পিস বিক্রির ৪০ হাজার টাকা দেয়নি। রুবেলের কাছে টাকা চাইলে সে টালবাহানা করত। বলত, জনি টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে। কোরবানির ঈদের দিন রুবেলের সঙ্গে দেখা হয়। তাকে নিয়ে চাক্কি রাসেলের দক্ষিণ বাড্ডা বাজার গলির বাসায় যায়। সেখানে রুবেল, রুবেলের বন্ধু বীপু ও চাক্কি রাসেলকে আইসক্রিম খাওয়ায়। এরপর চাক্কি রাসেলের কাছে অভিযোগ দেয়, রুবেলের কাছে ৪০ হাজার টাকা পাব। কিন্তু সে টাকা দিচ্ছে না। টাকা না পাওয়ায় আমি বেশ ঝামেলার মধ্যে আছি। তবে রুবেল সুরাহা না করে কাজের কথা বলে চলে যায়, রুবেলও চলে যায়। কালা রাসেল বলে, ঈদের পরদিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সে ও চাক্কি রাসেল রুবেলকে ডেকে নেয়। তাকে বলা হয়, গুলশান-২-এর দিকে গুলি কইরা একটু ভয়ভীতি দেখাতে হবে। চাক্কি রাসেল রুবেলকে বলে, এটা করতে পারলে পাওনা ৪০ হাজার টাকা দিতে হবে না। বরং আরও কিছু বাড়তি টাকা পাবি। জবানবন্দিমতে, ২৭ সেপ্টেম্বর বেলা ১টার দিকে কালা রাসেল ও চাক্কি রাসেল গুলশান কমার্স কলেজের গলিতে দাঁড়িয়ে কীভাবে কী করা যায় এসব নিয়ে কথা বলে। ওই সময় রুবেল আসে। চাক্কি রাসেল রুবেলকে বলে, কাজটা দ্রুত করতে হবে। কালা রাসেল ও চাক্কি রাসেল মধ্য বাড্ডা বাজারের কসাই গলির ভাঙারি সোহেলের কাছ থেকে একটা পিস্তল আনতে বলে। ভাঙারি সোহেল তাদের পূর্বপরিচিত ও অস্ত্র ভাড়া দিত। রুবেল কসাই গলিতে গিয়ে পিস্তল নিয়ে আসে। কালা রাসেলের বাসার নিচে এসে পিস্তল চাক্কি রাসেলকে দেয়। এরপর রুবেল বাসায় চলে যায়। দুই রাসেল কীভাবে কী করতে হবে তার পরিকল্পনা করে। কালা রাসেল আরও বলে, ২৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে শরিফের কাছ থেকে একটি অপারেশন আছে জানিয়ে হোন্ডা (মোটরসাইকেল) চেয়ে নিয়ে আসে। বিকাল ৪টার দিকে কালা রাসেলের বাসার সামনে যায় রুবেল। রুবেলকে পিস্তলটি দিয়ে কীভাবে গুলি করতে হবে তারা কয়েকবার করে দেখিয়ে দেয় (দুই রাসেল)। রুবেলকে বলা হয়, পিস্তলে পাঁচটা গুলি আছে। তাকে আবারও দুই রাসেল আশ্বস্ত করে কোনো চিন্তা করিস না। টাকা দিতে হবে না। কামটা হইলে আরও কিছু বাড়তি টাকা পাইবা। এপরপর চাক্কি রাসেল বিদায় নেয় এবং বলে সিটি কর্পোরেশন অফিসের গেটে দেখা হবে। কালা রাসেল হোন্ডায় রুবেলকে তুলে নিজে চালিয়ে গুলশান-২-এর সিটি কর্পোরেশনের গেটের সামনে যায়। সেখানে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী চাক্কি রাসেল উপস্থিত ছিল। দুই রাসেল ঘটনার পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা করে। এর কিছুক্ষণ পর চাক্কি রাসেল ৯০ নম্বর রোডে বিদেশী লোকটারে দেখায়। লম্বা সাদা চামড়া লোকটি তখন হেঁটে যাচ্ছিল। চাক্কি রাসেল বলে ওই লোকটারে গুলি করতে হবে। তখন কালা রাসেলের হোন্ডায় ওঠে রুবেল। হোন্ডা নিয়ে লোকটিকে ওভারটেক করে ইউটার্ন নেয় তারা। তখন সময় সন্ধ্যা ৬টা থেকে সাড়ে ৬টা হবে। ঈদের পর হওয়ায় রাস্তায় লোকজন তেমন একটা ছিল না। বিদেশী লোকটা হাঁটতে হাঁটতে গুলশান এভিনিউর গভর্নর ভবনের কাছে পৌঁছলে রুবেল পরপর ৪টা গুলি করে। এরপর তাড়াতাড়ি হোন্ডায় ওঠে। কালা রাসেল একটু সামনে গিয়ে চাক্কি রাসেলকে তোলে। তারা গলির ভেতর দিয়ে ঘুরা রাস্তায় ১২ নম্বর রোডের মাথায় রুবেলকে নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে দুই রাসেল উত্তর বাড্ডায় গিয়ে মতিনের সঙ্গে দেখা করে। মতিন তাদেরকে সাবধানে থাকতে বলে। রাতে রুবেলের সঙ্গে দেখা হয়। তখন পিস্তলটা চাক্কি রাসেলকে দিয়ে বাসায় চলে যায়। পরদিন দুপুর বেলা রুবেলকে ফোন করে ডেকে আনে দুই রাসেল। সন্ধ্যার দিকে প্রাণআরএফএলের মাঠে রুবেলের সঙ্গে দেখা হয়। সেখানে চাক্কি রাসেল পিস্তলটা ভাঙারি সোহেলকে দিয়ে আসার জন্য বলে। রুবেল গিয়ে পিস্তল দিয়ে আসে। পুলিশ ধরার আগ পর্যন্ত আমরা এলাকাতেই ছিলাম। শরীফের জবানবন্দি : সোমবার আদালতে জবানবন্দি দেয় মোটরসাইকেলের মালিক সাখাওয়াত হোসেন শরীফ। তার বাসা থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়। শরীফ নিজেকে হত্যাকাণ্ড ও খুনের সঙ্গে জড়িত নয় দাবি করে। বলে, ঘটনা গোপন রেখেই চাক্কি রাসেল ও কালা রাসেল তার কাছ থেকে অপারেশন আছে বলে মোটরসাইকেল নেয়। এর আগেও তারা কয়েক দফায় মোটরসাইকেল নিয়ে আবার ফেরত দিয়েছে। ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় গুলশান ২-এর ৯০ নম্বর সড়কে সিজারি তাভেল্লাকে (৫১) গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি নেদারল্যান্ডসভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা আইসিসিও কো-অপারেশনের প্র“ফসের (প্রফিটেবল অপরচুনিটিজ ফর ফুড সিকিউরিটি) প্রকল্প ব্যবস্থাপক ছিলেন। - যুগান্তর ৩ নভেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে