বুধবার, ০৪ নভেম্বর, ২০১৫, ০৩:১২:১০

নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবে কে?

নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবে কে?

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : গ্রাম বাংলায় বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে ‘নিজের খেয়ে বনের মষ তাড়ানো, কিংবা ‘নিজের খেয়ে অন্যের পথের কাঁটা সরানো’।জানা নেই, প্রবাদটি কোন প্রেক্ষাপটে কখন প্রচলিত হয়, তবে এর ব্যবহার যে বিশ্বের দেশে দেশে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে রয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এ কাজটি কিন্তু বেশিরভাগ সময় মানুষ জেনে শোনে করে থাকে।সেটা হতে পারে দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ কিংবা মানবিকতাবোধ থেকে। রাজনীতিতে অবশ্য এর প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এবার আমাদের দেশে বাস্তবেই ঘটলো সেটা। কিভাবে হলো- কারা করলো? এ বিষয়টি বলার আগে নিজের খেয়ে বনের মষ তাড়ানোর কিছু প্রাসঙ্গিক কথার অবতারণা করতে চাই। ইকোহামা, যারা এই শহরটিতে বসবাস করছেন কিংবা বসবাসের অভিজ্ঞতা রয়েছে তারা এ বিষয়ে বেশ ওয়াকিবহাল। স্কুল-কলেজ ছুটির দিনের সকালে চোখে পড়ে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা ড্রেস পরে রাস্তা পরিষ্কার করছে। বলতে পারেন ইকোহামা কি কোনো দরিদ্র শহর?না, বিশ্বের উন্নত দেশ জাপানের একটি শহর। তাহলে, স্কুলের ছেলেমেয়েদের রাস্তা পরিষ্কার করতে হবে? এখানেই বিষয়টির নিগুঢ় রহস্য- ছোট কচিকাঁচা বাচ্চা আর কিশোরী শিক্ষার্থীরা কতই না আগ্রহ নিয়ে গাছের পাতা, কাগজ আর অন্যান্য ময়লা প্লাস্টিকের ব্যাগে করে নিয়ে যাচ্ছে, যেন তারা নিজেদের বাড়ির বাগান কিংবা স্কুল আঙ্গিনা পরিষ্কার করছে! এটা তাদের একদিনের কিংবা চাপিয়ে দেয়া কোনো কাজ নয়, সপ্তাহের প্রত্যেক ছুটির দিনের কাজ।এ তো বললাম ইকোহামার কথা, জাপানের অন্যান্য শহরের চিত্র।শুধু জাপান কেন, ইউরোপ আমেরিকার অনেক দেশের রাস্তায় এমন চিত্র লক্ষ্যনীয়। জাপান, কানাডা, আমেরিকা ও নেদারল্যান্ডস'র মতো ধনী দেশের ছেলেমেয়েরা রাস্তা পরিষ্কার করে কেন?তাও আবার ক্লাসের দিন নয়, ছুটির দিনে দল বেঁধে। যেদিন তাদের পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর কথা, ঘুরাফেরার কথা!ওইসব নগরের পরিচ্ছন্ন কর্মচারীরা তো নিয়মিত শহর পরিষ্কার করছেই, তবুও স্কুলের ছাত্রছাত্রী কেন? এর মাধ্যমে তারা তাদের দেশকে ভালবাসতে শেখে, তাদের ভেতর দায়িত্ববোধ তৈরি করে, যেন তারা নিজেরা রাস্তা ময়লা না করে।এর মাধ্যমে টিমওয়ার্ক তৈরি হয়, যেন একে অপরের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারে।এর ভেতর দিয়ে এক ধরনের ওনারশিপ তৈরি হয়। যার মাধ্যমে তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ আর দেশপ্রেম আর বেশি জাগ্রত হয়। সেটা কী বাংলাদেশের মানুষের ভেতর আছে? বলতে গেলে এখানে এর বিপরীত চিত্র। অন্য শহরের কথা কেন, এইত ক'দিন আগে আমাদের রাজধানী শহর ঢাকায় ঘটে গেল বেশ মজার একটি বিষয়। জাপানের এশিয়া-প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র সাতজন ছাত্রছাত্রী বাংলাদেশে থাকাকালীন ঢাকা শহরের ময়লা পরিষ্কারের কাজে নেমে পড়ে। পাঁচ দিনে রাজধানীর পাঁচটি বনানী, গুলশান, ফার্মগেট, আসাদগেট ও গাবতলী এলাকায় তারা এই অভিযান চালায়। বিষয়টি তেমন কিছুই না- শুধু এক জোড়া গ্লাভস এবং ময়লা ফেলার ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়া। কিন্তু এই সামান্য বিষয়টিই অসংখ্য মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে। ফেসবুকে আমরা তাদের কার্যক্রমকে অভিনন্দন জানালাম।কয়েকটি পত্রিকায় বেশ বড় ছবিও ছাপা হয়। টেলিভিশন টকশোতে ব্যাপক আলোচনাও হয় বেশ।তাতে কি? আর আমরা কি করলাম, চারদিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কাজ দেখলাম, ভিড় করলাম। কেউ কেউ নিজেদের মোবাইল দিয়ে ছবি তুলে তা ফেসবুকে শেয়ার করলাম আর সেই ছবিগুলো নিয়ে বেশ আলোচনা হলো। এরপরও কি আমাদের মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়েছে? না, মনে কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে? না, হয়নি। কেন হয়নি কিংবা হচ্ছে না, এর জবাব অনেক গভীরে। আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ শিশুদের সেভাবে গড়ছে না।আমরা বড়রা তাদের উল্টো পথে হাঁটতে শিকাচ্ছি। এইত তিনদিন আগে সকালে ঘুম থেকে উঠে মহাখালীর নিকেতনবাজার এলাকার রাস্তায় হাঁটছিলাম, হঠাৎ উপর থেকে আমার গাঁয়ে পরলো ময়লা।কি যে বিব্রতকর অবস্থা! সাত তলা ভবনের কাকে অভিযুক্ত করবো আর কার কাছেই বা এই অভিযোগ দিবো? মনের ক্ষোভ নিবারণ করে কোনো মতে বাসায় ফিরে জামা পরিবর্তন করলাম।এইতো আমাদের সমাজ, আমাদের সচেতনতা! বাংলাভাষায় আরেকটি প্রবাদ আছে নিজের পায়ে কুড়াল মেরে অন্যের ক্ষতি করতে সিদ্ধহস্ত। অর্থাৎ মনের অজ্ঞান্তেই আমরা যে কিভাবে নিজেদেরকে ধ্বংস করছি, তা আমরা নিজেরাই জানি না। আমরা যারা রাষ্ট্র-সমাজের দায়িত্বশীল পর্যায়ে অবস্থান করছি তারা কি চিন্তা করছি- আমরা কি বলছি, সত্য না মিথ্যা? আমরা কি করছি বৈধ না অবৈধ? ফলে আজ যেখানে আমাদের রাজনীতিবিদরা মিথ্যাচার, হানাহানিতে লিপ্ত সেখানে শিশুরা কি শিখবে? কেননা, যাদের কাছ থেকে দেশপ্রেম শেখার কথা, তারাই তো দেশপ্রেমিক নন। যাদের দায়িত্বশীলতা দেখে শিশু-কিশোরদের মনে দায়িত্ববোধ জাগ্রত হবার কথা তারাই তো দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন। সর্বত্রই প্রতিহিংসা আর হানাহানির বিষবাষ্প ছড়ছে। ফলে কোন গন্তব্যে এগুচ্ছে বাংলাদেশ তাও আমরা জানি না। লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক। ই-মেইল[email protected]। ৪ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএম/ডিআরএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে