বৃহস্পতিবার, ০৫ নভেম্বর, ২০১৫, ০৪:২২:৫৮

বিচারক ও আসামির ২২ দফা টেলিসংলাপ

বিচারক ও আসামির ২২ দফা টেলিসংলাপ

কবির হোসেন: খুনের মামলার আসামির সঙ্গে চাঁদপুরের জেলা জজ মো. মফিজুল ইসলাম ২২ দফায় টেলিফোনে কথা বলেছেন। অভিযোগ গঠনের সময়ই দুই আসামিকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন এ বিচারক। সুপ্রিমকোর্ট গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্ট বিভাগীয় মামলা দায়েরের সুপারিশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘চাঁদপুরের জেলা জজ মো. মফিজুল ইসলামের বিরুদ্ধে এ সংক্রান্ত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এ লক্ষ্যে জেলা জজকে দিয়ে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি করে দেয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার সুপারিশ করা হয়েছে। এখন পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে মন্ত্রণালয়।’ ১৬ জুলাই বিভাগীয় মামলা দায়েরের সুপারিশ করে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। মাঝে পার হয়েছে প্রায় আড়াই মাস। কিন্তু এখন পর্যন্ত আইন মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। টেলিফোনে এ ব্যাপারে বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করা হলেও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। ৮ এপ্রিল মামলার অভিযোগ গঠনকালে চাঁদপুরের জেলা জজ আদালত আসামি মঈনউদ্দিন হোসেন টুনু ও মো. এহসানকে অব্যাহতি দেন। এর আগে একই আদালত থেকে তাদের জামিন দেয়া হয় বলে জানা গেছে। জেলা জজ ও আসামি এহসানের মধ্যে টেলিফোনে কথোপকথনের একটি তালিকা হাতে পাওয়ার পর মামলার বাদী প্রধান বিচারপতি বরাবর অভিযোগ দাখিল করেন। এতে জেলা জজ ও আসামির মধ্যে অনৈতিক যোগাযোগের অভিযোগ তোলা হয়। এর পরিপ্রেক্ষেতে তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন সুপ্রিমকোর্ট। সুপ্রিমকোর্ট গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আইনবহির্ভূতভাবে দায়রা ৩২৫/২০১৪ মামলার ১নং আসামি মইনউদ্দিন টুনু এবং তার ছেলে ৫নং আসামি মো. এহসানকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আসামি মো. এহসানের সঙ্গে মফিজুল ইসলামের মোবাইলে ২২বার কথোপকথন এবং ঠিক একই সময়ে আসামি মো. এহসান ও তার পিতা আসামি মইনউদ্দিন হোসেন টুনুকে আইনবহির্ভূতভাবে অব্যাহতি প্রদান- এ দুয়ের মধ্যে একটি যোগসূত্র রয়েছে, যা সংশ্লিষ্ট বিচারকের বিচারসুলভ আচরণ, সততা ও নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ১৭ মার্চ থেকে ১৫ এপ্রিলের মধ্যে জেলা জজ মো. মফিজুল ইসলামের মোবাইল নম্বর-০১৮১৯-৪৪৯৬০২ এবং আসামি মো. এহসানের মোবাইল ফোন নম্বর ০১৮১৯-২২২৯৫৭-এ ২২ বার কথা হয়েছে। দুই আসামিকে অব্যাহতি দেয়া হয় ৮ এপ্রিল। এর আগের দিন বিকাল ৫টা ২২ মিনিট, রাত ১০টা ২০ মিনিট, রাত ১০টা ৩২ মিনিট এবং রাত ১০টা ৩৭ মিনিটে তাদের মধ্যে ৪ বার ফোনালাপ হয়। নিজ আদালতে বিচারাধীন খুনের মামলার আসামির সঙ্গে মোবাইলে কথোপকথন বিচারকসুলভ আচরণের পরিপন্থী- যা নিঃসন্দেহে অসদাচরণের শামিল। জানা গেছে, ২০১২ সালের ১০ মে রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টায় চাঁদপুর মতলব উত্তর থানাধীন এনায়েতগঞ্জ সাহেব বাজারে আবদুল মান্নানের চায়ের দোকানে পূর্বশত্রুতার জের ধরে লিয়াকত উল্লাহ সরকারকে খুন করা হয়। এ সময় তার সঙ্গী মমিন দেওয়ানকে গুরুতর আহত করা হয়। পরদিন মইনউদ্দিন হোসেন টুনু এবং তার ছেলে মো. এহসানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এতে জ্ঞাত ১৬ এবং অজ্ঞাত আরও ৭/৮ জনকে আসামি করা হয়। মামলার বাদী লিয়াকতের ভাইয়ের ছেলে তৌফিক আজিম মিশু। তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ৬ মার্চ অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। অভিযোগ গঠনের শুনানিকালে আসামি মইনউদ্দিন হোসেন টুনু ও মো. এহসান, নুরুল আমিন সরকার, কিষাণ সরকার, সাইফুল ও মনিরুজ্জামান মোহন অব্যাহতির আবেদন করেন। এই আবেদনের শুনানির আগে জেলা জজের সঙ্গে এহসানের মোবাইল ফোনে কথোপকথনের অভিযোগ ওঠে। সে সময় আসামি এহসান জামিনে ছিলেন। কথোপকথনের পরই তাদের দু’জনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। অন্য চার আসামির অব্যাহতির আবেদন নামঞ্জুর করে অভিযোগ গঠন করেন। আসামিদের অব্যাহতির আদেশে বিচারক উল্লেখ করেন, ‘নথিতে রক্ষিত প্রমাণাদি থেকে আসামি মইনউদ্দিন হোসেন টুনু অভিযোগ সংঘটনের হুকুমদাতা বা সহায়তায় জড়িত ছিল বলে যথেষ্ট ভিত্তি দেখা যায় না। আসামি মো. এহসান ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই।’ এছাড়া তদন্ত প্রতিবেদনেও কথিত হত্যার সঙ্গে সে কিভাবে জড়িত ছিল তা উল্লেখ করা হয়নি। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ৬ জন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। কিন্তু এদের অধিকাংশই আসামি এহসানের উপস্থিতি সম্পর্কে বক্তব্য দেয়নি। এ অবস্থায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার জবানবন্দি, অভিযোগপত্র এবং মামলার নথিতে আসামি মো. এহসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করার মতো যথেষ্ট ভিত্তি নেই বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘অব্যাহতিপ্রাপ্ত দুই আসামিকে ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত করে এজাহার দায়ের করা হয়। ২০১২ সালের ১১ মে (পর দিন) চায়ের দোকানদার আবদুল মান্নান এবং জখমি মমিন দেওয়ান পুলিশের কাছে এই দুই আসামিকে ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত করে জবানবন্দি দেন। এছাড়া মফিজার সরকার, মো. জুয়েল সরকার ও খোরশেদ আলম ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তারা বাবা ও ছেলেসহ অন্য আসামিদের জড়িয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। এ অবস্থায় অভিযোগ গঠনের সময় আসামি মইনউদ্দিন হোসেন টুনু ও মো. এহসানকে অব্যাহতি দেয়ার বিষয়ে বিচারক যে অভিমত প্রকাশ করেন তা আইনগতভাবে সঠিক নয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে সাক্ষ্যের ভিত্তিতে অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করার সুযোগ থাকে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদন পেয়ে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন চাঁদপুরের জেলা জজ মফিজুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার সুপারিশ করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। একই সঙ্গে বিভাগীয় মামলা তদন্তের জন্য চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ মুহাম্মদ নুরুল হুদাকে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করেন সুপ্রিমকোর্ট। মামলার বাদী তৌফিক আজিম মিশু বলেন, ‘মামলার আসামিরা অনেক টাকার মালিক। দুই আসামি কিভাবে অব্যাহতি পেল তা খোঁজার চেষ্টা করি। তখন আসামির একজন চাচাতো ভাই আমাকে জানায়, বিচারকের সঙ্গে ৪০ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। এ সময় আমি আসামির সঙ্গে বিচারকের ফোনালাপ হয়েছে কিনা তা খোঁজার চেষ্টা করি। পরে এক মাসের কললিস্ট হাতে পেয়ে যাই। এতে দেখা যায় এক মাসেই ২২ বার কথোপকথন হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমার আবেদন অনুমোদন করে। পরে গেজেটের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। কিন্তু দুই বছর ধরে গেজেট জারি করা হয়নি।’ তিনি এই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার দাবি করেন।-যুগান্তর ৫ অক্টোবর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/পিবি/পিপি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে