বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১১:১৪:০২

রোহিঙ্গাদের আরসা কি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী না কি মুক্তিযোদ্ধা?

রোহিঙ্গাদের আরসা কি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী না কি মুক্তিযোদ্ধা?

ম্যাক্স বিয়ারাক : গত দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ও বার্মার (মিয়ানমার) মধ্যকার উপকূলীয় সীমান্ত এলাকা প্রায় ধারণাতীত দুঃখ- দুর্দশাপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছে। বার্মা থেকে প্রায় ৩ লাখ (বর্তমানে ৩ লাখ ৭০ হাজার) রোহিঙ্গা শুধুমাত্র কিছু কাপড় নিয়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশের শিবিরগুলোতে।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলেন, তারা মূলত বার্মা সেনাবাহিনীর ‘স্কর্চড-আর্থ অভিযান’ থেকে বাঁচতে পালাচ্ছে। এই অভিযানের উদ্দেশ্য হলো, বার্মা থেকে সংখ্যালঘু মুসলিম গোষ্ঠীটিকে জোর করে বের করে দেয়া। আর এই অভিযান সফল করতে রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, প্রতিনিয়ত সম্ভ্রমহানী করা হচ্ছে আর পুরো শহর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার প্রধান সোমবার এই নৃশংসতাকে জাতিগত নির্মূলতার (এথনিক ক্লিনসিং) এর একটি সপষ্ট দৃষ্টান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বার্মার সামরিক বাহিনী ও সরকার অবশ্য বলছে যে, তারা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা চালাচ্ছে না।

তারা একদল সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ওপর হামলা চালাচ্ছে- যারা রোহিঙ্গাদের রক্ষা করার দাবি করে কিন্তু আসলে তারা হচ্ছে জঙ্গিগোষ্ঠী যারা রাখাইন প্রদেশে আরো একটি আইএস তৈরি করতে চাচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে একটি প্রবাদের কথা মনে পড়ে, একজনের সন্ত্রাসী, অন্যের মুক্তিযোদ্ধা (ওয়ান ম্যান’স টেরোরিস্ট ইজ এনাদার ম্যান’স ফ্রিডম ফাইটার)।

বলা হচ্ছে, দুনিয়ার সবচেয়ে বন্ধুহীন গোষ্ঠী হচ্ছে রোহিঙ্গারা। আর নিশ্চিতভাবেই তাদের সুরক্ষার প্রয়োজন। কয়েক দশক ধরে তারা নিপীড়ন সয়ে আসছে। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মা থেকে তাদেরকে দেয়া হচ্ছে না নাগরিকত্ব। ২০১১ সালে মিয়ানমারে প্রায় অর্ধশতক ধরে চলা সামরিক শাসনের অবসান ঘটে, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আবির্ভাব ঘটে গণতন্ত্রের।

আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের অনেকেই তখন ধারণা করেছিলেন যে, বার্মা সরকার এবার রোহিঙ্গাদের সেই প্রয়োজনীয় সুরক্ষা প্রদান করবে- বিশেষ করে যখন দেশটির নেত্রী শান্তিতে নোবেলজয়ী আর আত্মস্বীকৃত শান্তিবাদী অং সান সুচি। তবে দেশটির নতুন সংবিধান অনুসারে সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণের কোনো ক্ষমতা নেই সুচির হাতে।

তাছাড়া বার্মার বহু নাগরিকের মতন তারও ধারণা যে, রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসীর দল- যদিও তারা শতাব্দী না হলেও কয়েক প্রজন্ম ধরে সেখানেই বসা করছে। বার্মা সরকার তাদেরকে বাঙালি বলেই সম্বোধন করে থাকে। অল্প কিছুদিন আগ পর্যন্ত বাংলাদেশিরাও রোহিঙ্গাদের নিয়ে অনেকটা একইরকম ধারণা পোষণ করতো।

এ বছরের শুরুতে মোহাম্মদ ইউনুস নামের এক রোহিঙ্গা নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছিল, বাংলাদেশিরা এক সময় আমাদের ঘৃণা করতো। তারা বলতো আমরা বার্মা, একটা বাজে স্বরে আর বিভিন্ন উপায়ে আমাদের নিয়ে শপথ করতো। তবে এখন তারা বোঝে যে আমরা নিপীড়িত হচ্ছি। রোহিঙ্গাদের নিপীড়িত হওয়ার এই খবর দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে।

রোহিঙ্গাদের ছবি ও সাক্ষ্যপ্রমাণ দেখে জাকার্তা ও চেচনিয়া থেকেও মানুষেরা রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে সব মিলিয়ে ৭ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাস করছে। বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমার সরকারের এই আচরণকে গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করেছে। এখন শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক চাপের মুখেই বার্মা বেশিরভাগ রোহিঙ্গাদেরকে ফেরত নেবে। তবে ফেরত যাওয়া প্রায় কেউই বার্মার নাগরিকত্ব পাবেন না।

ডিসেম্বরে, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) এক তদন্তে প্রকাশ করা হয় যে, রোহিঙ্গাদের এই পরিস্থিতি পাকিস্তান, সৌদি আরব ও অন্যান্য জায়গার বিভিন্ন ধনী ব্যক্তিদেরকে একটি বিশৃঙ্খল জঙ্গি দল গঠন করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় ওই অনভিজ্ঞ জঙ্গিগোষ্ঠী পরিচিত ছিল হারাকাহ আল-ইয়াকিন নামে- আরবিতে যার মানে বিশ্বাস আন্দোলন।

সেই দলটিই এখন আরাকান রোহিঙ্গা সালভ্যাশন আর্মি বা আরসা নামে পরিচিত। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল ও বাংলাদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গা প্রবাসীরা তাদেরকে অর্থ আর অস্ত্র সরবরাহ করত। স্থানীয় যোদ্ধারা বার্মাতেই প্রশিক্ষণ নিত। আইসিজির প্রতিবেদনে বলা হয়, বার্মার রোহিঙ্গাদের মধ্যে আরসার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সমপ্রতি চলা এই সহিংসতার শুরুও আরসার কারণেই শুরু হয়েছে।

আরসা সদস্যরা সমন্বিতভাবে বার্মার সীমান্তরক্ষীদের বিভিন্ন পোস্টে হামলা চালায়। এতে ১২ সীমান্ত পুলিশকর্মী নিহত হয়। আবার অন্যদিকে, এই সহিংসতার কারণে হয়তো অনেকে জঙ্গি দলটিতে যোগদান করতে পারে। তবুও আরসা ও বার্মার সামরিক বাহিনীর মধ্যকার এই সহিংসতাকে ভারসাম্যহীন বলাটা ঠিক হবে না। আরসার সম্ভবত মাত্র কয়েক শ’ যোদ্ধা ছিল।

তাদের সঙ্গে বিদেশি যোদ্ধারা যোগ দিয়েছে তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। রোববার আরসা, মানবিক সংকটময় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতির আশায় একটি একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে। তবে বার্মা সরকার তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। রোহিঙ্গারা বার্মায় এখনো আগের মতোই ঘৃণিত।

তবে আরসার আক্রমণ, যদিও তা বার্মার সামরিক বাহিনীর আক্রমণের তুলনায় কিছুই নয় তবুও তা এই বিভাজন আরো বিস্তৃত করেছে ও সরকারের দাবির পক্ষে কাজ করছে। বার্মার সামরিক বাহিনী সকল রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচনা করছে আর কার্যকরভাবে মানবিক সাহায্যের রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। আর এই সুযোগে জঘন্য নিপীড়ন ও সামরিকীকরণের চক্র পুরোদমে ঘুরছে।

আরসার আক্রমণের এক সপ্তাহ পরেও রাখাইনের গ্রামগুলোতে আগুন জ্বলছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গারা এখন আর বার্মাতে না থেকে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে বাস করছে। প্রশ্ন তো জাগবেই: আরসা কি রোহিঙ্গাদের সাহায্য করছে না কি আঘাত করছে?

(ম্যাক্স বিয়ারাক দ্য ও্যাশিংটন পোস্ট পত্রিকায় বৈদেশিক বিষয় নিয়ে লিখেন। পূর্বে তিনি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ও অন্যান্য পত্রিকার জন্যে দক্ষিণ এশিয়া থেকে প্রতিবেদন লিখতেন। উপরোক্ত প্রতিবেদনটি ওয়াশিংটন পোস্টের অনলাইন সাইটে সেপ্টেমবর ১১, ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটির ভাবানুবাদ করেছেন রিফাত আহমাদ।) এমজমিন

এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে