বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:৫৭:০১

রোহিঙ্গাদের পাকিস্তানে একীভূত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন জিন্নাহ

রোহিঙ্গাদের পাকিস্তানে একীভূত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন জিন্নাহ

শামীমুল হক : ১৯৪৭ সালের কথা। ভারত-পাকিস্তান ভাগের সময়। রোহিঙ্গারা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। একাধিক বৈঠক করেন। তারা পাকিস্তানের সঙ্গে থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। আরাকানকে পাকিস্তানের সঙ্গে একীভুত করার আবেদন জানান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিন্নাহও তাদের নিতে অস্বীকৃতি জানান।

পাকিস্তানের সঙ্গে মিলতে ব্যর্থ হয়ে তারা ফিরে যান আরাকানে। এরপর তারা নিজেরাই রোহিঙ্গা মুসলিম পার্টি গঠন করেন। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি বার্মা স্বাধীনতা অর্জন করে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয় মিয়ানমারের। সে সময় পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্বও ছিল। আরাকানের ৫টি আসন থেকে রোহিঙ্গা সংসদ সদস্যরা মিয়ানমারের পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করেন। যাদের মধ্যে মন্ত্রীত্ব পান একজন।  

তাছাড়া এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেন। উইকিপিডিয়া অনুযায়ী সে সময় থেকেই মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। আর রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তারা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।

ভোটাধিকারও কেড়ে নেয়া হয়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ হারায়। বিয়ে করার অনুমতিও হারায় তখন। সন্তান হলে নিবন্ধনও বন্ধ করে দেয়া হয়। জাতিগত পরিচয় প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সংখ্যা যাতে না বাড়ে সে জন্য আরোপিত হয় একের পর এক বিধিনিষেধ। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৮ আর ১৯৯২ সালে দু’বার তাদের উপর সামরিক অভিযান চালানো হলে ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ২

০১২ সালে শুরু হয় রাখাইনে জাতিগত দাঙ্গা। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ১৯৭৮ সাল থেকে রোহিঙ্গারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে। তারা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে। ১৯৭৮ সালে মায়ানমার সেনাবাহিনী নাগামান অভিযানের ফলে কমপক্ষে দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।

এই সেনা অভিযান সরাসরি বেসামরিক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলছিল এবং ফলে ব্যাপক হত্যার ঘটনা ঘটে। বর্তমানে গত ২৫শে আগস্ট থেকে চলা সেনা ও মগদের যৌথ হামলায় গণহত্যা চলছে আরাকানে। রোহিঙ্গাদের হত্যার নানা দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখে শিহরে উঠছে মানুষ। প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। অবর্ণনীয়, অমানবিক নির্যাতন চালাচ্ছে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় মগরা।

ইতিহাস মতে, মগদের আদি পেশা দস্যুতা। মোগল আমলে তাদের দস্যুবৃত্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তাদের দস্যুবৃত্তি ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। মোগলরা তখন তাদের তাড়া করে জঙ্গলে পাঠায়। আর তখনই মগের মুল্লুক হিসেবে পরিচিতি পায় আরাকান রাজ্য। মগদের আরাকানে বসতি নিয়েও রয়েছে কাহিনী। মগরা বার্মার অধিবাসী।

একসময় আরাকান রাজ্য দখলকারী কট্টর বৌদ্ধ বর্মী রাজা আনাওহতা দস্যু মগদের বসতি স্থাপন করেন আরাকানে। তাদের আদি নিবাস বার্মা থেকে তাদের বিতাড়িত করে পাঠানো হয় আরাকানে। আর আরাকানের দক্ষিণাঞ্চল থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করে মগদের স্থান করে দেয়া হয়।

এ অবস্থায় রোহিঙ্গারা আরাকানের উত্তরাঞ্চলে বসতি গড়েন। সেই থেকে রাখাইনে রোহিঙ্গা ও মগ সম্প্রদায়ের বাস। ইতিহাস অনুযায়ী আরকানের আরেক নাম রোসাং বা রোসাঙ্গ। ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোসাং স্বাধীন রাজ্য ছিল। মধ্যযুগে রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের লেখকরা রাখাইন রাজ্যকে রোসাং বা রোসাঙ্গ রাজ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রোসাঙ্গ রাজ্যের রাজভাষা ফার্সি ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষাও রাজসভায় সমাদৃত ছিল।

তখন নারামেখলার ছিলেন রাজ্যের সম্রাট। বর্মী রাজা আরাকান রাজ্য দখল করে নিলে দীর্ঘ ২৪ বছর নির্বাসিত জীবন কাটান সম্রাট নারামেখলার। পরে বাংলার সুলতানের সামরিক সহায়তায় পুনরায় আরাকানের সিংহাসনে আরোহণ করেন নারামেখলার। সম্রাট নারামেখলা বাংলার সুলতানের দেয়া কিছু অঞ্চল ও আরাকানের ওপর সার্বভৌমত্ব অর্জন করেন।

সম্রাট নারামেখলা পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বাংলার প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আরাকানে বাংলার ইসলামী স্বর্ণমুদ্রা চালু করেন। পরে নারামেখলা নতুন মুদ্রা চালু করেন। যার একপাশে ছিল বার্মিজ বর্ণ এবং অপরপাশে ছিল ফার্সি বর্ণ। ১৪৩৩ সালে সুলতান জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহের মৃত্যু হলে সম্রাট নারামেখলার উত্তরাধিকারীরা ১৪৩৭ সালে রামু এবং ১৪৫৯ সালে চট্টগ্রাম দখল করে নেয়। ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম আরাকানের দখলে ছিল।

১৭৮৫ সালে বার্মিজরা আরাকান দখল করে। তখনও রোহিঙ্গা মুসলিমরা ছিল টার্গেট। তাদের উপর চলে নির্মম নির্যাতন। ১৭৯৯ সালে ৩৫ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বার্মিজদের প্রেপ্তার এড়াতে আরাকান থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলে আসে। সে সময় বার্মার শাসকরা আরাকানের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। একটা বড় অংশকে আরাকান থেকে বিতাড়িত করে।

এ সময়ই বৃটিশরা আরাকান দখল করে। তখন এটি ছিল যেন একটি মৃত্যুপুরী। ওই সময় বৃটিশরা কৃষিকাজের জন্য আরাকানের কম জনঅধ্যুষিত এবং উর্বর উপত্যকায় আশপাশের এলাকা থেকে বাঙালি অধিবাসীদের অভিবাসন করার নীতি গ্রহণ করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাকে আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিল। আরাকান ও বাংলার মাঝে কোনো আন্তর্জাতিক সীমারেখা ছিল না।

এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যাওয়ার ব্যাপারেও কোনো বিধি নিষেধ ছিল না। ১৮৯১ সালে বৃটিশদের করা এক আদমশুমারিতে দেখা যায় আরাকানে তখন ৫৮ হাজার ২৫৫ জন মুসলমান ছিল। ১৯১১ সালে এ সংখ্যা বেড়ে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪৭ জন হয়। তখন বৃটিশরা মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে। কিন্তু তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

এ ধরনের বহু ভুল করে গেছে বৃটিশ শাসকরা। যারা খেসারত এখনও দিচ্ছে এ এলাকার বাসিন্দারা। ১৯৩৯ সালে রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যে দীর্ঘ শক্রতার অবসানের জন্য বৃটিশ প্রশাসন জেমস ইস্টার এবং তিন তুতের নেতৃত্বে একটি বিশেষ অনুসন্ধান কমিশন গঠন করে। কমিশন অনুসন্ধান শেষে সীমান্ত বন্ধ করার সুপারিশ করে। এরমধ্যে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

সে সময় জাপানিরা বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীন বার্মায় আক্রমণ করে বসে। বৃটিশ শক্তি পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যায়। এর ফলে ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এরমধ্যে বৌদ্ধ রাখাইন এবং মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল উল্লেখযোগ্য। সে সময় বৃটিশপন্থিদের সঙ্গে বার্মার জাতীয়তাবাদীদেরও সংঘর্ষ হয়।

সে সময়ও জাপানেরা হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে নির্যাতন, সম্ভ্রমহানী ও হত্যা করেছিল। সে সময় কমপক্ষে ২২ হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলায় চলে আসে। যুগে যুগে রোহিঙ্গারা উপেক্ষিত হয়ে আসছে। জন্ম থেকেই রোহিঙ্গা জাতি পৃথিবীর সবচেয়ে অবহেলিত এক জাতি। যাদের নেই কোনো দেশের নাগরিকত্ব। নেই মানুষ হিসেবে স্বীকৃতিও। জন্মভিটায়ও ওরা পরবাসী। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে