মঙ্গলবার, ০৭ নভেম্বর, ২০১৭, ০৯:২৭:৪৫

জামায়াতের ছক চূড়ান্ত

জামায়াতের ছক চূড়ান্ত

নিউজ ডেস্ক : নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। জনগণের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী প্রচারণা। এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও। অবশ্য গ্রেপ্তার আর নির্যাতন আতঙ্কে দলটির রাজনৈতিক কার্যকলাপ চলছে অনেকটা আড়ালে। আদালতের রায়ে নিবন্ধন হারানোর পাশাপাশি বাতিল হয়েছে প্রতীক দাঁড়িপাল্লাও।

এর পরও দলকে সুসংগঠিত করার পাশাপাশি আগামী নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়ন, প্রচার টিম ও নির্বাচন নিয়ে চূড়ান্ত ছক ঠিক করে রেখেছে। জামায়াত অধ্যুষিত ৫১ আসনে স্বতন্ত্রভাবে অংশগ্রহণের বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে নেতাকর্মীদের। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই প্রার্থীদের কাছে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি সাংগঠনিকভাবে প্রকাশ করা হবে।

জামায়াতে ইসলামীর বেশ কয়েকজন নীতিনির্ধারক ও শীর্ষপর্যায়ের নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জামায়াত প্রাথমিকভাবে তাদের জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে দলটির অতীতকেই মূল্যায়ন করছে। বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে ভোটের মাপকাঠিতে বেশি জনপ্রিয় এলাকাগুলোকেই বেছে নিয়েছে ২০১৯ সালের নির্বাচনের জন্য। দলটির সূত্র জানায়, জামায়াত সর্বপ্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচন করে ১৯৭৯ সালে। এ সময় কয়েকটি ইসলামি দলের জোট ইসলামী ডেমোক্র্যাটিক লীগের (আইডিএল) মাধ্যমে জামায়াতের ছয় এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে জামায়াতের ১০ জন নির্বাচিত হন।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসনে জয়লাভ করে। ১৯৯৬ সালে জামায়াতের এমপি ছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী (নীলফামারী), কাজী শামসুর রহমান (সাতক্ষীরা), দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (পিরোজপুর)। ২০০১ সালে দলটি ১৭টি আসনে জয়লাভ করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াত পায় হামিদুর রহমান আযাদ (কক্সবাজার) ও মাওলানা মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম (চট্টগ্রাম)।

এ ছাড়া স্বাধীনতার পূর্বকালে পূর্ববাংলায় ১৯৬২ সালে জামায়াতের এমএনএ ছিলেন আব্বাস আলী খান (বগুড়া), শামসুর রহমান (খুলনা), মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ (বাগেরহাট) ও ব্যারিস্টার আখতার উদ্দীন (ঝালকাঠি)। এ সময় প্রাদেশিক পরিষদে ছিলেন মাওলানা আবদুল আলী (ফরিদপুর) ও মাওলানা আবদুস সুবহান (পাবনা)।

দলটির অতীত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জামায়াতের নির্দিষ্ট কিছু আসনকে ঘিরেই ভোটব্যাংক। বিভিন্ন সময় এসব আসন থেকেই নির্বাচিত হন জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্যরা। এর বাইরে যেসব আসনে গত দুটি উপজেলা নির্বাচনে জামায়াত প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন, সেসব আসনও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে রংপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, ফেনীতে প্রার্থী থাকতে পারে জামায়াতের।

সূত্র জানায়, জামায়াতের ৪০ আসনে জয়ের জন্য মরণপণ লড়াই করবে। এক্ষেত্রে তারা জোটের প্রধান শরিক বিএনপিকেও ছাড় দেবে না। প্রয়োজনে এ রকম চারটি আসনে প্রার্থিতার ক্ষেত্রে জোটমুক্ত থাকবে দল। এমন একটি প্রস্তাবনাও তৈরি করা হয়েছে। জানা যায়, এক্ষেত্রে বগুড়াকেই গুরুত্ব দিচ্ছে জামায়াত।

বিভিন্ন উপজেলা নির্বাচনে বগুড়ায় বিএনপি থেকে ভালো ফল লাভ করে জামায়াত। এতে তাদের আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়।
সূত্র জানায়, বগুড়ায় প্রায় প্রতিটি আসনেই বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী রয়েছে। তাই এসব আসনে বিএনপিও জামায়াতকে ছাড় দেবে না। এর বাইরে রংপুরেও জোটমুক্ত থাকতে চায় জামায়াত।

সূত্র জানায়, গত রমজান মাসে জামায়াতের দায়িত্বশীল পর্যায়ে বেশ কয়েকটি সভা হয়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন নিয়ে সংগঠনের নেতাকর্মীর মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে আলোচনা হয়। সর্বশেষ গত আগস্টে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে নির্বাচনে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে নির্বাচনে গেলে সংগঠনের দীর্ঘমেয়াদি লাভ-ক্ষতির বিষয় নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়। তবে কোনো দল বা সংগঠনের ব্যানারে না গিয়ে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়।

সূত্র জানায়, দলের সংসদীয় বোর্ড ইতোমধ্যেই বাকি কাজ শুরু করেছে। দলের গঠনতন্ত্রের ২৫ ধারা অনুযায়ীÑ কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সংসদীয় বোর্ডের দায়িত্বে রয়েছে। স্থানীয় নেতাকর্মীদের মতামত-প্রস্তাব ও তথ্য যাচাই করে এই বোর্ডই প্রার্থিতার বিষয়টি চূড়ান্ত করবে।

আগামী নির্বাচনে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম ও সংগঠনের নেতাকর্মীদের কাছে ১০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে বলা হলেও জামায়াতের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। জামায়াত তাদের জরিপ অনুযায়ী, ৫১টি আসনে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। তাদের জরিপ অনুযায়ী, এর মধ্যে ২৯টি আসনে তাদের জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া ১১টি আসনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ার পাশাপাশি জয়লাভের সম্ভাবনাও রয়েছে। বাকি ১১ আসনে প্রার্থীদের মাঠপর্যায়ের কাজ ও সরকারি দলের ভূমিকার ওপর অনেকাংশে জয় নির্ধারণ করবে। এ ছাড়া এসব আসনে সংগঠনের বেশ কিছু নেতা রয়েছেন, যারা কর্মীদের কাছে খুব জনপ্রিয়। তাই তাদের নির্বাচনমুখী রাজনীতিতে যুক্ত করার জন্যই এ আসনগুলো বাছাই করা হয়েছে। কেন্দ্র থেকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের বার্তা দেওয়া হলেও নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে হলেও দলীয় প্রতীক ফিরে পাওয়ারও আশা করছেন নেতাকর্মীরা।

জামায়াতের ঢাকা অঞ্চলের দায়িত্বশীল এক নেতা জানান, জামায়াতের নীতিনির্ধারকরা ৫১ আসনকে টার্গেট করে প্রতি আসনে ২০ জনের একটি করে টিম সংশ্লিষ্ট আসনে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের জন্য প্রেরণ করেছিলেন। এরা পালাক্রমে এলাকায় অবস্থান করে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে নির্বাচনের বাস্তব হালচাল তুলে ধরবেন। এসব প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই চূড়ান্তভাবে ৫১টি আসনে প্রার্থী মনোনীত করে জামায়াত।

সূত্র জানায়, জামায়াতের বেশিরভাগ সক্রিয় নেতাই মামলা হামলায় বিপর্যস্ত। এর বাইরে অনেকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত। অনেকে বিচারে কারান্তরীণ। অনেকের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। বলতে গেলে সক্রিয় নেতারা অনেকেই নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। এক্ষেত্রে বিকল্প ভেবে রেখেছে জামায়াত।

দীর্ঘদিন ধরেই জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য এমন কিছু ক্লিন ইমেজের নেতার তালিকা তৈরি করেছে দলটি। আগামী নির্বাচনে এসব নেতাকে দিয়েও দলটি মনোনয়ন দাখিল করাবেন। সূত্র জানায়, স্বতন্ত্রভাবে মনোনয়ন দাখিলে বাধা নেই। এক্ষেত্রে জামায়াতের প্রার্থিতা সংকটে ভোগার শঙ্কা এড়াতে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

জানা যায়, গুরুত্ব বুঝে কোনো আসনে দুজন আবার কোনো কোনো আসনে তিনজনকে মাঠে নামাতে চায় দলটি। যাতে নির্বাচনের মনোনয়ন বৈধতার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা তৈরি না হয়। একইভাবে দলটি যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ও আমৃত্যু কারাদ-প্রাপ্তদের পরিবার থেকেও প্রার্থী মনোনয়ন করতে পারে। এক্ষেত্রে মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী, আবদুল কাদের মোল্লার সন্তানদের মধ্যে থেকে নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন করার চিন্তাভাবনা রয়েছে। আগ্রহী থাকলে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদের ভাইকে জোটের পক্ষ থেকে ফরিদপুরে প্রার্থী করতে দেনদরবার করবে দলটি। জামায়াতের নীতিনির্ধারকদের ভাবনায় থাকা এমন অনেক প্রার্থীদের ইতোমধ্যে গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া হয়েছে। এরা সংশ্লিষ্ট এলাকায় গণসংযোগ, প্রচার, দান-খয়রাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

সংগঠনের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও রাজধানীর একটি থানার সাবেক আমির আমাদের সময়কে জামায়াতের কৌশল সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, বর্তমানে কোনোভাবেই সংঘাত চান না জামায়াতের নীতিনির্ধারকরা। আপাতত একেবারেই নীরব থাকার পরিকল্পনা তাদের। কর্মসূচি পালনের নামে কোনো রকম ঝুট-ঝামেলায় জড়াতে চান না। এর মাধ্যমে নিজেদের একটা ক্লিন ইমেজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হবে। নীরব থাকা ও বিএনপির সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার মূল কারণ আগামী নির্বাচন।

তবে জোটগতভাবে হলেও কোনো প্রতীকের অধীনে না গিয়ে শেষতক স্বতন্ত্রভাবেই জামায়াতের প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। তবে জামায়াতের মধ্যম সারির বেশ কয়েকজন নেতার দাবি, নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে হলেও দলীয় প্রতীক ফিরে পাবেন তারা। এ জন্যই কোনোরকম ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ে জড়াচ্ছেন না নেতাকর্মীরা। সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি আইনিভাবেও চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।-আমাদের সময়
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে