বুধবার, ০৮ নভেম্বর, ২০১৭, ০৫:০৩:৩৯

যে কারণে স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের মধ্য সন্দেহ আর অবিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে

যে কারণে স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের মধ্য সন্দেহ আর অবিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে

উদিসা ইসলাম : সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। উখিয়ার বেলাল মিয়া (ছদ্মনাম) তার বাসার আশেপাশে ১১টি ছাউনি তোলেন। এসব ছাউনিতে আশ্রয় নেয় ২২টি রোহিঙ্গা পরিবার। এদের সবাই জীবন বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছে।

কেউ আহত, কেউ দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত, কারও চোখে আবার ঘরবাড়ি, সহায়সম্পদ, আর  দেশ হারানোর শোক। ২২টি পরিবারের সদস্যদের জন্য তিন বেলা থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন বেলাল। ছাউনিতে থাকার জন্য কোনও ভাড়া নেননি তিনি। এরপর রোহিঙ্গা পরিবারগুলো নিজেদের মতো ব্যবস্থা করে চলে যেতে থাকে।

কিন্তু তারা ক্যাম্পের দিকে যাননি দাবি করে বেলাল বলেন, ‘একমাসের ভেতরই তারা ডেকে ডেকে তাদের আত্মীয়-স্বজনদেরও আনা শুরু করে। আমি তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলাম। তারা আমাকে না জানিয়ে অন্য লোকদের জায়গা করে দিলো প্রথমে। এরপর হঠাৎ দেখি, একেকজন করে চলে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে বলছে না। তাহলে এটা তো আমার নিরাপত্তার জন্যও হুমকি। এরপর আমি তাদের ক্যাম্পে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেই। গত এক সপ্তাহ আগে তাদের সবাই চলে গেছে।’

৪৮টি পরিবারের মাঝি হালিম (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমি যখন শুরুতে লোক এনেছি, তখন উভয়পক্ষে কোনও সমস্যা চোখে পড়েনি। কিন্তু এখন রোহিঙ্গা বলি আর স্থানীয় বাঙালি বলি, কেমন জানি সন্দেহ আর অবিশ্বাস। এখনই এরকম, এরপর কী হবে সেটা আন্দাজ করতে চাই না।’

মিয়ানমার থেকে সহিংসতার শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রতি স্থানীয় অধিবাসীদের গত আগস্টে যে মনোভাব ছিল, তা তিন মাসের ব্যবধানে বদলে যেতে শুরু করেছে। নিজেদের অস্তিত্বের সংকটে পড়েই স্থানীয় অধিবাসীরা শুরুতে যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, সেই আন্তরিকতায় এখন ভাটা পড়েছে।

সমাজে মর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়া, কাজ হারানো, পরস্পরের জীবনযাপনের মধ্যে বৈষম্যের উপলব্ধি স্থায়ীদের রোহিঙ্গাবিমুখ করে তুলছে, বলছেন গবেষকরা। আর স্থানীয়রা বলছেন, আদর করে রাখবো কিন্তু আমার দিকে কেউ খেয়াল দেবে না। আমার কাজ কেড়ে নেবে, সেটা মেনে নেওয়া সহজ না।

আর বিশ্লেষকরা বলছেন, মানবিকতার খাতিরে যাদের নিজ উঠোনে জায়গা করে দিয়েছিল স্থানীয়রা, সংখ্যার দিক দিয়ে আশ্রিতরা যদি বেশি হয়ে যায়, তাহলে নানারকম সংকট তৈরি হবে। বাংলাদেশে এখন সব মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে৷ এরমধ্যে ছয় লাখ এসেছে চলতি বছর ২৫ আগস্টের পর থেকে।

রোহিঙ্গাদের এক জায়গায় রাখতে কুতুপালংয়ের বালুখালিতে অস্থায়ী আশ্রয় ক্যাম্প করা হয়েছে৷ বাকিরা কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন দরকার শরণার্থী নীতিমালা এবং স্থানীয় যে কাঠামো, সেটা যেন প্রভাবিত না হয়, সেদিকে খেয়াল করা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক রহমান নাসির উদ্দিন রোহিঙ্গাদের নিয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘স্থানীয় লোকজন দীর্ঘসময়ের জন্য তাদের আশ্রয় দেয়নি। একদিকে রোহিঙ্গা এতিম প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে করছে স্থানীয় ছেলেরা, এতে করে ছেলের পরিবার সামাজিকভাবে হেয় বোধ করছে।’

তিনি বলেন, ‘বাড়ছে তাদের ক্ষোভ। আরেক দিকে কাজের জায়গায় রোহিঙ্গাদের চাহিদা বেশি, কারণ, তারা কম মজুরিতে মনোযোগ দিয়ে কাজ করে। এতে কাজ হারানো স্থানীয় মানুষেরা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। সর্বোপরি, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনেক আগে থেকে যারা আছেন, তারা আন্তর্জাতিক সহায়তা পান বিধায় স্থানীয় জনগণের চেয়ে জীবন-যাপনে অনেক বেশি বিশেষ সুবিধা পান। ফলে স্থানীয়রা বৈষম্য বোধ করেন। ’

তিনি আরও বলেন, ‘পৃথিবীর কোথাও শরণার্থীদের মেইনল্যাণ্ডে আসতে দেওয়া হয় না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এখনই এদের সুনির্দিষ্ট পরিসরে নিয়ে প্রশিক্ষণ ও সোশ্যাল ইন্টিগ্রেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকায় যে কাঠামো, জীবন ব্যবস্থা- সেটা যেন কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ তানজিমুদ্দিন খান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের অবস্থান দীর্ঘমেয়াদি যখন হবে, স্থানীয় সম্পদের ওপর চাপ পড়বে। তখন মহানুভবতা দেখানো কঠিন হবে। এই চাপের মানসিকতা থেকে হিংস্র হয়ে উঠতে হতে পারে স্থানীয় অধিবাসীরা।’

তিনি বলেন, ‘এছাড়া, ডেমোগ্রাফিক চেঞ্জ হয়েছে। সংঘাত-সংঘর্ষ যেন না হয়, তা মনিটরিং জরুরি। ক্যাম্পগুলোতে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। কাউন্সেলিং করানো জরুরি। এখন নতুন করে পরিকল্পনা করতে হবে। শরণার্থী ব্যবস্থাপনার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এই ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তনটি আমাদের কোথায় দাঁড় করাবে, সেটাও দেখার বিষয়। অবস্থান যাতে দীর্ঘমেয়াদি না হয়, সেটি সবার আগে বিবেচনায় নিতে হবে।’

লাখ লাখ রোহিঙ্গা চলে আসছে আতঙ্কিত হয়ে। বাংলাদেশের মানুষ সরকারি উদ্যোগের অপেক্ষা না করেই তাদের আশ্রয় দিয়েছে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন,  ‘এরা যে দীর্ঘমেয়াদে থেকে যাবে সেটা মাথায় ছিল না। ফলে এখন যখন বিষয়গুলো বুঝতে শুরু করেছে, নিজেদের কাজের জায়গা সংকুচিত হতে পারে বলে মনে করছে, তখন তারা মুখ ফিরিয়ে নেবে।

তিনি আরও বলেন, ‘পরস্পরের ভেতর অস্থিরতা তৈরি হবে, এটাইতো স্বাভাবিক। এটা সহজাত। যারা স্থানীয়, যাদের সম্পদ ওইসব এলাকায় আছে, তারা এটা মানবে না।’  বাংলা ট্রিবিউন
এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে