শংকর কুমার দে : সন্ত্রাসী সংগঠন ও জঙ্গী মদতদাতা হিসেবে নিষিদ্ধ করা হতে পারে জামায়াত-শিবির। বিশ্বের সন্ত্রাসী সংগঠনের দশ শীর্ষ তালিকায় জামায়াতের ছাত্রফ্রন্ট ইসলামী ছাত্রশিবির তৃতীয় হিসেবে চিহ্নিত। এটা চিহ্নিত করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক সংস্থা জেইনস ও মার্কিন সহযোগী সংস্থা আইএইচএ। প্রকাশিত গ্লোবাল টেররিজম এ্যান্ড ইনসার্জেন্সি এ্যাটাকস ইনডেক্সের ভিত্তিতে ছাত্রশিবিরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আর আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক্স এ্যান্ড পিসের (জিটিআই) এক প্রতিবেদনে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২০১৩ সালের প্রায় পুরোটা সময় ব্যাপক রাজনৈতিক সহিংসতা, হানাহানি ও নাশকতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জামায়াতে ইসলামী এবং তার সহযোগী সংগঠন ছাত্রশিবিরকে ইতোমধ্যেই সন্ত্রাসী ও জঙ্গী মদতদাতা সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি এখন আবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গীবাদ দমনে ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগ কামনা এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের ওয়াশিংটন টাইমসে লিখিত এক নিবন্ধে জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছেন। খুব শীঘ্রই জামায়াত-শিবিরকে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী মদতদাতা সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে। সরকারের উচ্চপর্যায় সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে এ খবর দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার এক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা জানান, প্রধানমন্ত্রী ও তার তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দুই পরাশক্তি দেশের কাছে সন্ত্রাস ও জঙ্গী দমনে সহায়তা ও জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণার দাবির প্রেক্ষিতে জামায়াত-শিবির সংগঠন নিষিদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে গেছে। স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘ নিষিদ্ধ ছিল। স্বাধীনতাবিরোধী দালালদের ক্ষমা ঘোষণার সুযোগ নিয়ে তখনকার বিভিন্ন সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠনে ভিড়ে গিয়েছিল ইসলামী ছাত্রসংঘের ক্যাডাররা। তারা গোপনে ইসলামী ছাত্রসংঘের সাংগঠনিক কার্যক্রম পুরোপুরিই চালিয়ে গেছে। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের জারি করা রাজনৈতিক দলবিধির সুযোগ নিয়ে ১৯৭৭ সালে জামায়াতে ইসলামী নতুন নামে ‘ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ’ নামে আত্মপ্রকাশ করে।
দলটির অঙ্গসংগঠন হিসেবে পুনরাবির্ভাব ঘটে ছাত্রসংঘের স্থলে নতুন নামধারী ইসলামী ছাত্রশিবিরের, যার প্রথম সভাপতি ছিলেন বর্তমানে মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারাধীন আসামি মীর কাশেম আলী।
১৯৭৯ সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে স্বনামে কার্যক্রম জোরদার করার পর্যায়ে তার প্রধান আর্থিক পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় ছিল সৌদি সরকার, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ধনকুবেররা ও ক্রমবর্ধমান ইসলামী এনজিওগুলো। একই ধারাবাহিকতায় ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবির ক্রমাগতভাবে শক্তি সঞ্চয় করতে শুরু করে। ১৯৮০ সালের চাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের উভয় গ্রুপে ভাঙ্গনের ফলে ইসলামী ছাত্রশিবির সহসভাপতিসহ অধিকাংশ পদে জয়ী হয়।
তখন থেকেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছাত্রশিবিরের সশস্ত্র ক্যাডারদের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠে। ১৯৮২ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মদদে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির সারাদেশে দ্রুত শক্তি বাড়াতে সমর্থ হয় বলে অভিযোগ আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান পরিচালিত আফগান যুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে যে শত শত মুজাহিদ পাঠানো হয়, তাতে এখানকার ধর্মীয় সংগঠনগুলোর সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। কক্সবাজার ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোকেও জামায়াত-শিবির জঙ্গী প্রশিক্ষণের ক্যাম্প হিসেবে পুরো আশির দশকে ব্যবহার করেছে।
সৌদি আরবের বিভিন্ন জঙ্গীবাদী গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ অর্থায়নে মুজাহিদ সংগ্রহের ওই কর্মসূচী পরিচালিত হওয়া কারণে বাংলাদেশ সরকার জামায়াত-শিবিরের সেসব প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। ১৯৮২ সালে এরশাদ বেসরকারী খাতে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের একাধিক সংস্থার অর্থায়নে প্রতিষ্ঠা পায় ‘ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ।’ বাংলাদেশের বেসরকারী ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক সর্ববৃহৎ ব্যাংকে পরিণত হয়েছে। গত ৩২ বছরে জামায়াত-শিবিরের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বিস্তারের মূল চাবিকাঠি ধারণ করে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। মধ্যপ্রাচ্য থেকে এ দেশে আসা প্রবাসীদের রেমিটেন্সের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি এককভাবে আসে এ ব্যাংকের মাধ্যমে। জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা যে নিয়মিত ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে, তার উৎস কোথায়, সেটিও খুঁজে বের করেছে গোয়েন্দা সংস্থা।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর গোপন গাঁটছড়ার কারণে জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়। ১৯৯৬ সালে জামায়াত তার নিজস্ব শক্তিমত্তা দেখাতে এককভাবে নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশ নেয়। ১৯৯৬ সালে মাত্র তিনটি সংসদীয় আসনে জয়ী হয়েছিল তারা। জামায়াত-শিবির তখন পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছে, আরও বহুদিন বিএনপির কাঁধে ভর করেই তাদের নির্বাচনে অবতীর্ণ হতে হবে। একই সঙ্গে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে তারা নিজেদের সমর্থক সংগ্রহ করে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে চলে।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের কিছু বাছাই করা অঞ্চলেই জামায়াত-শিবিরের তা-ব ছিল সবচেয়ে বেশি। সেসব পকেটে তারা পুলিশ বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর কৌশলগত কারণেই জামায়াত-শিবির সাময়িকভাবে সংঘাত কমিয়ে সাংগঠনিক শক্তিকে পুনর্গঠিত করে নিচ্ছে। পরবর্তী মানবতাবিরোধী অপরাধীর রায় যখন আন্তাজর্তিক ট্রাইব্যুনালসহ উচ্চ আদালত থেকে বের হয়, তখন আবারও শুরু হয় তাদের সশস্ত্র তা-ব। বাংলাদেশের সন্ত্রাসী গ্রুপের সূতিকাগার জামায়াত-শিবিরের মদতদাতা হিসেবে চিহ্নিত জেএমবি-বাংলা ভাই, হুজি, লস্কর-ই-তৈয়বা, হিযবুত তাহরীর কিংবা হিযবুত তওহীদ।
জামায়াতে ইসলামীর নাম আগে ছিল জামায়েতে ইসলামী বাংলাদেশ, অর্থাৎ মূল দল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ শাখা। গত ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনের আপত্তির কারণে নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ জামায়েতে ইসলামী। ২০১২ সালে দলের সাবেক আমির প্রয়াত সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম এক সাক্ষাতকারে বলেন, জামায়েতের হেড কোয়ার্টার লাহোরে, আগেও লাহোরে ছিল এখনও সেখানেই আছে। জামায়াত-শিবির যে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নয়- এটাই তার প্রমাণ এবং তারা গৃহযুদ্ধ বাধানোর জন্য পাঁয়তারা করে আসছিল।
গোয়েন্দা সংস্থার রেকর্ড থেকে জানা যায়, যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক সংস্থা ‘জেইনস’-এর মার্কিন সহযোগী সংস্থা ‘আইএইচএস’ সম্প্রতি তাদের প্রকাশিত ‘গ্লোবাল টেররিজম এ্যান্ড ইনসার্জেন্সি এ্যাটাকস ইনডেক্স’-এর ভিত্তিতে নির্ধারিত বিশ্বের সন্ত্রাসী সংগঠনের শীর্ষ দশটির তালিকায় জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে তৃতীয় বৃহত্তম সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদর ও রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়ে ইসলামী ছাত্রসংঘের ক্যাডাররা পাকিস্তানী ঘাতক সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার ফলেই তারা লাখ লাখ বাঙালীকে হত্যায় সফল হয়েছিল।
অপরদিকে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক্স এ্যান্ড পিসের (জিটিআই) প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে- ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২০১৩ সালের প্রায় পুরোটা সময় ব্যাপক রাজনৈতিক সহিংসতা ও হানাহানি চলে। জামায়াত কর্মীরা একদিকে দেশজুড়ে নাশকতা চালায় এবং অন্যদিকে নির্বাচন ঠেকাতে জামায়াত-বিএনপি জোটের হরতাল অবরোধে সহিংসতায় বহু মানুষ হতাহত হয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা অবরোধ-হরতালের নামে পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়িয়ে মারার সহিংস সন্ত্রাসে বহু নিরীহ নিরপরাধ মানুষজনের জীবন্ত দগ্ধ হয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু হওয়ার পর ২০১৩ সালের প্রথমদিক থেকে বড় ধরনের নাশকতা, নৈরাজ্য সৃষ্টি করে বিএনপি-জামায়াত জোট।
আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের রায় ঘোষণার পর রায়ের বিরুদ্ধে তাদের হাতে পুলিশ, বিডিআরসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৮ জন নিহত হন এবং আহত হন বহুসংখ্যক। বিএনপি-জামায়াত জোটের সশস্ত্র ক্যাডাররা থানায় আক্রমণ, পুলিশের অস্ত্র লুট, কর্তব্যরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের ওপর আক্রমণ, গাছ কেটে রাস্তায় অবরোধ দিয়ে সন্ত্রাসের তা-বলীলা চালানোর ঘটনায় দেশ-বিদেশে সন্ত্রাসের তালিকায় বাংলাদেশের নাম উঠিয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্র প্রমাণের চেষ্টা করে বিএনপি-জামায়াত জোট। বিএনপি-জামায়াত জোটের পেট্রোলবোমার সহিংস সন্ত্রাসের ঘটনা দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তজার্তিক মহলেও ছড়িয়ে পড়ে।
গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, জামায়াত-শিবিরকে জঙ্গী মদতদাতা ও সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অনেক আগে থেকেই আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিতি লাভ করেছে। দেশের ভেতরেও এ সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি করা হচ্ছিল। যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও বিচারের রায় ঘোষণা কেন্দ্র করে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হরতালের নামে সহিংস সন্ত্রাসের তা-বলীলা চালিয়ে বহু লোককে হতাহত, সম্পদহানি, আতঙ্কের জনপদে পরিণত করেছে তাতে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়াটি এখন ফের সামনে চলে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী ও তার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টার যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নিষিদ্ধ ও জঙ্গী দমনে সহায়তার দাবির প্রেক্ষিতে দেশের ভেতরে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার ঘোষণাটি এখন সময়ের বিষয় মাত্র। যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রক্রিয়ার মধ্যেই জামায়াত-শিবিরকে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী মদতদাতা হিসেবে নিষিদ্ধ করার চিন্তাভাবনা চলছে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে।-জনকণ্ঠ
১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে