বুধবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৫:৩৩:৩৯

সৌদি সামরিক জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়

সৌদি সামরিক জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়

আবদুল মান্নান : অনেকটা হঠাৎ করেই গত ১৪ ডিসেম্বর সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে দেশটির দ্বিতীয় গদিনশিন রাজপুত্র মোহাম্মদ বিন সালমান এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করলেন, সৌদি আরবের নেতৃত্বে ৩৪টি মুসলমানপ্রধান দেশের সমন্বয়ে নাকি গঠিত হয়েছে একটি সন্ত্রাসবিরোধী আন্তর্জাতিক সামরিক জোট। সাধারণত সৌদি আরবে গদিনশিন রাজপুত্ররা সংবাদ সম্মেলন করেন না। তারা আমোদফুর্তিতে ব্যস্ত থাকতে অনেক বেশি আগ্রহী। যেসব দেশ এই জোটে থাকবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে, তার মধ্যে উগান্ডা (জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশ খ্রিস্টান), গ্যাবন (৭৫ শতাংশ খ্রিস্টান), বেনিন (সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিস্টান) আর টোগো, যেখানে সাধারণ মানুষ স্থানীয়ভাবে স্বীকৃত দেব-দেবীর পূজা করে, তারাও আছে। আবার বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলমান অধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়া এই জোটে এখন পর্যন্ত যোগ দেয়নি। বাইরে আছে ইরানের মতো শক্তিশালী দেশ। যুক্তরাষ্ট্র অধিকৃত ইরাককে এই জোটের বাইরে রাখা হয়েছে। ইয়েমেনকে এই জোটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু সেই একই ইয়েমেনে নিত্যদিন সৌদি বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করে নিরীহ মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। জোট ঘোষণার পর মালয়েশিয়া বলেছে, তারা জোটের কথা জানে, কিন্তু সামরিক জোটের কথা কিছুই জানে না। পাকিস্তান জানিয়েছে, তাদের অন্তর্ভুক্তির কথা তারা সরকারিভাবে কিছুই জানে না। বাংলাদেশ এক দিন পর বলেছে, এই জোটে তারা থাকবে। সৌদি উদ্যোগে কিছু হলে বাংলাদেশ তাতে সাধারণত ‘না’ বলে না, কারণ সেই দেশে বাংলাদেশের আনুমানিক ৪০ লাখ মানুষ কাজ করে। বাংলাদেশে সাধারণত পাকিস্তান বাদে অন্যান্য মুসলমান দেশ কোনো অভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানালে তাতে সাড়া দেয়। সুতরাং জোটে যোগ না দিয়ে বাংলাদেশের সামনে তেমন কোনো ভিন্ন পথ খোলা ছিল বলে মনে হয় না। এই জোট নাকি জঙ্গি সংগঠন আইএস বা ‘দায়িস’-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। যেসব দেশের নাম এই ৩৪টি দেশের মধ্যে আছে তার মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, তুরস্ক, মিসর, মালয়েশিয়া ছাড়া অন্য দেশের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার তেমন কোনো সক্ষমতা নেই। আবার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান নিজেই একটি সন্ত্রাস রপ্তানিকারক দেশ। অন্যদিকে আধুনিক বিশ্বে উগ্র ধর্মীয় জঙ্গিবাদের সূতিকাগার হচ্ছে সৌদি আরব। সৌদি আরবে বর্তমান রাজপরিবারের হাত ধরে সে দেশে কট্টর ওয়াহাবিবাদ প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে ইসলামের নামে উগ্র জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাস দেখা বা শোনা যায়নি। ওয়াহাবিবাদের প্রবক্তা অষ্টাদশ শতকের ধর্মগুরু মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব (১৭০৩-১৭৯২), যাঁর মতবাদই হচ্ছে ইসলাম গোড়াতে যেমন ছিল, ঠিক তেমনভাবে তাকে পালন করতে হবে এবং প্রয়োজনে তা পালনে মানুষকে বাধ্য করতে হবে; যদিও পবিত্র কোরআন বা হাদিসে এমন কোনো কথা বলা নেই। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বেদুইন আবদুল আজিজ ব্রিটিশদের সাহায্যে অটোমানদের হটিয়ে সৌদি রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং ওয়াহাবিবাদকে আরো এক ধাপ এগিয়ে তিনি সৌদি আরবে ‘সালাফি’ ব্র্যান্ডের আরো কট্টর ওয়াহাবিবাদ চালু করেন। সে সময় তাকে সহায়তা করে ব্রিটেন। পরে যুক্ত হয় ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র। সৌদি আরব হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র দেশ, একটি পরিবারের নামে যার নামকরণ হয়েছে এবং দেশটি প্রকাশ্যে ধর্মের নামে জিহাদের অথবা নিরপরাধ মানুষ হত্যার প্রবক্তা। শিশু, নারী, পুরুষ, দেশি-বিদেশি—সবার শিরশ্ছেদ সেখানে ঠুনকো অজুহাতে জায়েজ। ২০১৪ সালের ৩১ মে সৌদি আরবের তত্কালীন বাদশাহ আবদুল আজিজ ঘোষণা দিয়েছিলেন, নাস্তিক বা ভিন্ন রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী সবাই সন্ত্রাসী বা জঙ্গি। সেই দেশে রাজপরিবারের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দিলে তার একমাত্র শাস্তি শিরশ্ছেদ। অথচ দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বিশ্বে এমন কোনো অপকর্ম বা পাপ কাজ নেই, যা রাজপরিবারের সদস্যরা করেন না। বাহরাইনের সুড়িখানা আর জুয়ার আড্ডাগুলো চলেই সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাজপরিবারের সদস্যদের পৃষ্ঠপোষকতায়। ইসলামের নামে যেসব উগ্র ধর্মীয় সংগঠন মানুষ হত্যা জায়েজ বলে ফতোয়া দেয়, সেসব সংগঠন কোনো না কোনো সময় সৌদি আরবের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছে। সৌদি আরব তেলসম্পদে সমৃদ্ধ একটি দেশ এবং যেহেতু সেই তেল আহরণের সক্ষমতা তাদের নেই, সেহেতু এই কাজে তারা ডেকে এনেছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন আর নেদারল্যান্ডসের তেল কম্পানিগুলোকে। সেই দেশে তেল লুটপাট চলছে সেই তিরিশের দশক থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গুলিহেলন ছাড়া দেশটির কোনো কিছু করার জো নেই। সার্বিক বিচারে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের শুধু একটি তাঁবেদার রাষ্ট্রই নয়, এক ধরনের করদরাজ্যও বটে। এমন একটি রাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি সামরিক জোটের হঠাৎ, অনেকটা বিনা নোটিশে, বা প্রস্তুতি ছাড়া আবির্ভাব ঘটলে দেশ-বিদেশের বিশ্লেষকরা ভ্রু কোঁচকাবেন তো বটেই এবং ঠিক তা-ই হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একাধিক সামরিক জোটের সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে সিয়াটো, সেন্টো, ন্যাটো, ওয়ারস প্যাক্ট অন্যতম। এসব জোট সৃষ্টির পেছনে কাজ করেছিল ষাট ও সত্তরের দশকের ঠাণ্ডা লড়াই। বার্লিন দেয়ালের পতন আর সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তির পর এসব জোটও প্রয়োজনীয়তা হারিয়েছে এবং ন্যাটো ছাড়া অন্য জোটগুলোও ভেঙে গেছে। ন্যাটো টিকে আছে, তবে জার্মানি মাঝেমধ্যে চিন্তা করে ন্যাটোকে বাদ দিয়ে ইউরোপের দেশগুলোকে নিয়ে নতুন কোনো জোট করা যায় কি না। ন্যাটো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দাদাগিরি জার্মানির তেমন একটা পছন্দ নয়। ন্যাটো অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছায় পরিচালিত হয়, যার উত্কৃষ্ট উদাহরণ জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক, লিবিয়া আর মিসর আক্রমণ ও দখল। যুক্তরাষ্ট্রের সব অপকর্মে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স তাদের সঙ্গী হয়েছে। শুধু সামরিক জোট নয়, যেকোনো জোট গঠনের পেছনে থাকে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি, আলাপ-আলোচনা আর হোমওয়ার্ক। থাকে আদর্শ-উদ্দেশ্য। সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটে তেমনটি ছিল বলে শোনা যায়নি। বলা হচ্ছে, সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের মূল আদর্শ হচ্ছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমন। তবে যেহেতু সৌদি আরব কখনো কট্টর সুন্নি মতের বাইরে ইসলাম ধর্মের অন্য কোনো মতবাদ স্বীকার করে না, সুতরাং ধরে নেওয়া যায়, এই জোটে সহজে ইরানের অংশগ্রহণ হচ্ছে না। ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক কখনো ভালো ছিল না। ১৯৭৯ সালে পবিত্র হজের সময় একদল সশস্ত্র ইরানি পবিত্র কাবা শরিফ দখল করে সৌদি রাজপরিবারকে উচ্ছেদের চেষ্টা করেছিল। এই ঘটনার পরপর ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমেনি ঘোষণা করেছিলেন, পবিত্র কাবা শরিফ দখলের পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হাত। সেবার কাবা শরিফকে মুক্ত করতে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ইরানকে বাদ দিয়ে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট অর্থহীন। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এটি যত না সন্ত্রাসবিরোধী জোট, তার চেয়ে হয়ে উঠতে পারে শিয়াবিরোধী জোট। এটি শিয়া-সুন্নি বিরোধের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। হতে পারে ইসলামপ্রধান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আরো বিভক্তি সৃষ্টির বড় ধরনের ষড়যন্ত্র। তবে এই তথাকথিত জোট যে যুক্তরাষ্ট্রের ইশারায় তৈরি হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেখার বিষয় যুক্তরাষ্ট্র এই জোটকে কিভাবে ব্যবহার করে। ইরাক আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্র ওআইসিকে বেশ ভালোভাবে ব্যবহার করেছে। আরব লীগও এ সময় কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। ওআইসি আর আরব লীগ দুটিই অনেকটা অকার্যকর সংস্থায় পরিণত হয়েছে। সার্বিক বিচারে সৌদি নেতৃত্বাধীন তথাকথিত জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী আন্তর্জাতিক সামরিক জোটেরও তেমন কোনো ভবিষ্যৎ দেখা যাচ্ছে না। ফাস্ট ফুডের মতো চটজলদি একটি বহুজাতিক সামরিক জোট টেকার সম্ভাবনা তেমন আছে বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সূতিকাগার সৌদি আরব। তাদের নানাভাবে মদদদাতা যুক্তরাষ্ট্র। এই দুটি দেশ চাইলেই সন্ত্রাসবাদ দমন সম্ভব। আর ওই অঞ্চলে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী রাষ্ট্র তো ইসরায়েল। তাদের সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র বা সৌদি আরবকে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য করতে তো দেখা যায় না। বাংলাদেশ এই তথাকথিত সামরিক জোটে যোগ দিয়ে ভালো করেছে কি মন্দ, তা হয়তো এখনই বোঝা যাবে না। তবে এর মধ্যেই আইএস ঘোষণা করেছে, সৌদি আরব ক্রুসেডারদের সঙ্গে জোট বেঁধেছে এবং তারা সময়মতো সৌদি আরব আক্রমণ করবে। বাংলাদেশও তাদের নজরদারিতে আছে বলে জানিয়েছে। সুতরাং ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে সতর্ক হতে হবে। এদিকে বাংলাদেশে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছেন, একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হননি। যুক্তরাষ্ট্রের আদালত বিএনপিকে তৃতীয় শ্রেণির সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রথম শ্রেণির সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে তৃতীয় শ্রেণির সংগঠনের মিলন ঘটতেই পারে। এখন দেখার পালা কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক ২৩ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে