ভোটের বাতাসে ভয় বিএনপিতে উদ্বেগ
সাখাওয়াত হোসেন : বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালানোর ক্ষেত্রে ক্রমেই বাড়ছে সহিংস হামলা, ধরপাকড় এবং মিথ্যা মামলাসহ বিভিন্ন ধরনের হয়রানি-নির্যাতনের ঘটনা। তাই নির্বাচনী হাওয়ায় দেশ উত্তাল হলেও মাঠে নামতে সাহস পাচ্ছেন না দলটির নেতাকর্মীরা। এমনকি দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ফেসবুক-টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা গোপনেও প্রচারণাকাজে সহযোগিতা করার সাহস হারিয়ে ফেলেছেন তারা।
এ পরিস্থিতিতে বিএনপির প্রার্থীরা বাধ্য হয়ে ভাড়াটে কর্মীদের দিয়ে লিফলেট বিলি, মাইকিং এবং ব্যানার-ফেস্টুন লাগানোসহ প্রচার-প্রচারণার বিভিন্ন কার্যক্রম চালাচ্ছেন। তবে তাদের উপরও ক্ষমতাসীনদের নির্যাতনের খড়্গ নেমে আসায় সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। এর পাশাপাশি ভোটের মাঠে বড় ধরনের হামলার আতঙ্কও জেঁকে বসেছে দলটিতে।
বিএনপির বেশ কয়েকজন মেয়র ও কাউন্সিলর পদপ্রার্থী এবং স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে কথা বলেও এর সত্যতা পাওয়া গেছে। তারা জানিয়েছেন, ৯ জানুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হওয়ার পর আত্মীয়-স্বজন ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নিয়ে তারা মাঠে নামলেও স্থানীয় নেতাকর্মীদের অনেককেই পাশে পাননি।
বেশ কিছু কর্মী সাহস করে তাদের পক্ষে প্রচারণার কাজ শুরু করলেও ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের হুমকি-ধমকিতে তাদের অনেকেই নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। তাই বাধ্য হয়েই তাদের নিম্ন আয়ের মজুর শ্রেণির শ্রমিকদের ভাড়ায় নিয়ে কোনো রকমে প্রচারণা চালিয়ে যেতে হচ্ছে। কিন্তু তারাও ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না। বিভিন্ন স্থানে খুঁজে খুঁজে দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন তারা।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করে বলেন, নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা ততই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর সহযোগীরা হত্যা, সন্ত্রাস, আচরণবিধি লঙ্ঘন, বিপক্ষ প্রার্থীদের প্রচারণায় বাধাদান, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, হয়রানি এবং নৈরাজ্যময় পরিস্থিতি সৃষ্টির অপকীর্তি বন্ধ করছে না। আর সরকারের চাওয়া-পাওয়ার প্রতি লক্ষ রেখেই নির্বাচন কমিশন যাবতীয় কর্মকা- পরিচালিত করছে।
বিএনপির অভিযোগ, ইতোমধ্যে বেশ কিছু স্থানে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এবং দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। এতে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। প্রতিনিয়তই ধানের শীষের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে।
প্রতিদিন অন্তত ১৪-১৫টি হামলা-সহিংসতার খবর আসছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেলের দায়িত্বশীল নেতারা।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার সকালে পটুয়াখালীর কলাপাড়া পৌরসভার বিএনপি সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী হাজি হুমায়ুন সিকদারের নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে হামলার শিকার হন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী। এতে তার স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার চৌধুরীসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। একই দিন দুপুরে কুমিল্লার চান্দিনায় বিএনপির প্রচার সম্পাদক জয়নাল আবদিন ফারুকের প্রচারাভিযানে আক্রমণ হয়েছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ঝিনাইদহের শৈলকূপা পৌরসভার বিএনপি সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী খলিলুর রহমান, নোয়াখালীর চৌমুহনীর হারুন-উর-রশীদ এবং চট্টগ্রামের মিরেরসরাইয়ের বারৈয়ারহাট পৌরসভার মেয়র পদপ্রার্থী মঈনউদ্দিন লিটনের ছোট ভাইয়ের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু পৌরসভায় দলের প্রার্থী জিন্নাতুল হক খানের পক্ষে ভোট চাওয়ায় যুবদল নেতা আজম ম-লকে কুপিয়ে জখম করেছে ক্যাডাররা। নাটোরের সিংড়া পৌরসভায় মেয়র পদপ্রার্থী শামীম আল রাজী মো. সিহানুর রহমানের নির্বাচনী অফিস বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিপক্ষ দলের নেতাকর্মীরা। কোনো মামলা না থাকলেও পৌরসভা ওলামা দলের সভাপতিকে আটক করা হয়েছে।
এছাড়া রাজশাহীর আড়ানী পৌরসভায় প্রচারের সময় বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী তোজাম্মেল হকের কর্মীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। রূপগঞ্জের তারাব পৌরসভায় দলীয় প্রার্থী নাসির উদ্দিনের বাড়িতে হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ পৌরসভায় দলের মেয়র পদপ্রার্থীর মিছিলে হামলা চালিয়েছে আওয়ামী লীগের কর্মীরা। এ সময় সব পোস্টার ছিঁড়ে নির্বাচনী অফিস ভাংচুর করা হয়।
রাজশাহীর কাঁটাখালীতে ধানের শীষের নির্বাচনী এজেন্ট মনিরুজ্জামান দুলাল এবং কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থানা বিএনপির সভাপতি কায়সার মাহমুদ রিপনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। কুমিল্লার লাকসামে বিএনপি সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থীর প্রচারণায় বাধা দেয়া হচ্ছে এবং পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। বরিশালের বাকেরগঞ্জে সশস্ত্র ক্যাডারদের হামলায় ৫ কর্মী আহত হয়েছে। ভোলার বোরহানউদ্দিনে দলের মেয়র পদপ্রার্থী মনিরুজ্জামানের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করা হয়েছে।
বিএনপির মনিটরিং সেলের সদস্য সচিব মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, প্রায় প্রতিটি পৌরসভায় আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থীর সমর্থকরা ধানের শীষের প্রার্থী এবং তাদের প্রচারকর্মীদের ওপর আক্রমণ করছে। তবে এর সামান্য তথ্যই সেলে আসছে। হামলা-হাঙ্গামার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারের অফিসে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার মিলছে না। তাই বিএনপির নেতা-কর্মী-সমর্থকদের অনেকেই নির্বাচনী প্রচারণায় নামতে সাহস পাচ্ছেন না।
এদিকে, বিএনপির এসব অভিযোগ যে অমূলক নয়, তা দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনী প্রচারণার মাঠ ঘুরে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি ভাড়াটে প্রচারণাকর্মী সরবরাহকারীদের অনেকেই এ বিষয়টি নিঃসংকোচে স্বীকার করেছেন। তাদের ভাষ্য, হামলা, নির্যাতন এবং মিথ্যা মামলায় হয়রানির ভয়ে বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে কেউ কাজ করতে রাজি হচ্ছেন না। যারা সাহস করে এগিয়ে আসছেন, তারাও উচ্চ মজুরি দাবি করছেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের অধিকাংশ প্রার্থীই প্রচার-প্রচারণায় শোডাউন দেয়ার জন্য প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক ভাড়াটে কর্মী নেয়ায় সবাই এখন সেদিকেই ঝুঁকছে বলে দাবি করেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারাদিন প্রচার-প্রচারণা চালানোর জন্য একজন পূর্ণবয়স্ক প্রচারকর্মীকে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা দেয়া হচ্ছে। আর বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজছাত্রী কিংবা শিক্ষিতা স্মার্ট নারীদের দিনপ্রতি হাজিরা ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। কিন্তু এরপরও তাদের নানা রকম বিপত্তির মুখে পড়তে হচ্ছে। ভাড়াটে কর্মীরা বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে বাসায় ফিরে যাওয়ার পথে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা তাদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। গাজীপুরসহ বেশ কয়েকটি পৌরসভায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন অজুহাতে তাদের ধরে নিয়ে গেছে_ এমন নজির রয়েছে বলেও বিএনপির একাধিক মেয়র পদপ্রার্থী অভিযোগ করেছেন।
এদিকে, প্রচারণার পাশাপাশি বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিষ্ক্রিয়করণ এবং দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে মাঠে নেমে বিব্রত বিএনপির শীর্ষ নেতারা। তারা জানান, অধিকাংশ নির্বাচনী এলাকাই নেতাকর্মীশূন্য। তাদের উপস্থিতিতেও দলের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় নামতে সাহস পাচ্ছে না তৃণমূলের কর্মীরা। এ অবস্থায় বিএনপির অধিকাংশ প্রার্থীই ভাড়াটে কর্মী নিয়ে নির্বাচনী শোডাউন দেয়ার চেষ্টা করছেন বলে স্বীকার করেছেন দলের প্রথম সারির একাধিক নেতা।
বেগতিক এই পরিস্থিতিতে দলীয় নেতাকর্মীরা সরে থাকায় ভাড়াটে কর্মীদের ওপর ভরসা করে বিএনপি আদৌ নির্বাচনের মাঠে টিকে থাকতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের দাবি, ভাড়াটে কর্মীদের কাছে তার প্রাপ্য মজুরিই মুখ্য। তাই তার পক্ষাবলম্বী প্রার্থীর জয়-পরাজয়ে কিছুই আসে যায় না। এছাড়া প্রতিপক্ষের প্রার্থীর কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা পেয়ে ভাড়াটে কর্মীদের রাতের আধারে বিক্রি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই তাদের ওপর ভরসা করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া অনেকটাই অসম্ভব মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
এদিকে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, অধিকাংশ এলাকায় প্রার্থীরা নিজেরাই আতঙ্কে রয়েছেন; তাদের অনেকে প্রচারণার মাঠে নামার আগ্রহও হারিয়ে ফেলেছেন। অথচ নির্বাচনে সব বাধা দূর করে কৌশলী হয়ে নেতা-কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে প্রচারণা চালিয়ে যেতে হয়। কিন্তু তারা সেই ঝুঁকি না নেয়ায় পিছু হটেছেন সাধারণ কর্মীরা। ভীত-সন্ত্রস্ত কাউকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া ঠিক হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির এসব নেতা।
তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা এজন্য বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব এবং নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অসহায়ত্বকে দায়ী করছেন। তাদের ভাষ্য, ইসি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে না পারায় এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পৌর নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
এদিকে, গত কয়েকদিনে নির্বাচনী মাঠে যেভাবে হু হু করে সহিংসতার ঘটনা বাড়ছে, তাতে ভাড়াটে কর্মীদেরও বিএনপি শেষ পর্যন্ত পাশে পাবে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান অভিজ্ঞ রাজনীতিকরা। তাদের ভাষ্য, ভাড়াটে কোনো কর্মী কখনোই কারো জন্য কোনো ঝুঁকি নেবে না, বরং তারা কিছুটা কম মজুরিতে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবে, যার প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে বলে মনে করেন নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা। -যায়যায়দিন
২৪ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস