বিদ্রোহীদের ফেরাবে না আওয়ামী লীগ
তৈমুর ফারুক তুষার : চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ পৌরসভায় মেয়র পদে নৌকা প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জামানত হারিয়েছেন ময়েন খান। এখানে বিজয়ী পৌর আওয়ামী লীগের সম্প্রতি বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক কারিবুল হক রাজিন।
দলের প্রার্থী হিসেবে রাজিনের নামই কেন্দ্রে পাঠিয়েছিল শিবগঞ্জ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। কিন্তু তৃণমূলের এ চাওয়াকে উপেক্ষা করে দলটির কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকরা ময়েন খানকে মনোনয়ন দেন। ভোটের ফলাফলে নৌকার ভরাডুবির মধ্য দিয়ে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করছে শিবগঞ্জের নেতাকর্মীরা।
শুধু শিবগঞ্জ নয়, আরো অনেক জায়গায় মেয়র পদে তৃণমূলের পছন্দ মানেননি কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকরা। তাদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হন, তাঁদের দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু এসব পৌরসভার বেশির ভাগেই কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত ‘ভুল’ প্রমাণিত হয়। ১৯টি পৌরসভায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা বিজয়ী হন। অন্তত আরো এক ডজন বিদ্রোহী দ্বিতীয় হয়েছেন। এসব পৌরসভার বেশির ভাগেই নৌকা প্রতীক তৃতীয় বা চতুর্থ স্থান পেয়েছে। এমনকি নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
এমন ফলাফল দেখে পরে নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেও তা সংশোধন করবে না আওয়ামী লীগ। বিদ্রোহীদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্তেই অটল থাকার কথা জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন। তাঁদের বক্তব্য, দলের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার সুযোগ নেই। তবে আগামী দিনে প্রার্থী মনোনয়নে আরো সতর্কতা অবলম্বন করা হবে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ‘বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছি। দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের আগামী বৈঠকে সিদ্ধান্ত আসবে। আমাদের সরে আসার সুযোগ নেই। কারণ সামনে আরো নির্বাচন আছে, এখন বিদ্রোহীদের ছাড় দিলে পরবর্তীতে দলে এ ধরনের ঘটনা আরো বাড়বে। ব্যক্তির চেয়ে দল বড়—এটা সবাইকে বুঝতে হবে। দল করতে হলে দলের সিদ্ধান্ত মানার মানসিকতা থাকতে হবে।’
জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে, এমন প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকদের ভুল সিদ্ধান্ত কি না—জানতে চাইলে কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ‘দু-একটা জেনুইন ভুল যে নেই, এমন বলব না। অল্প সময়ে আমাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করতে হয়েছে। ফলে এ ধরনের ভুল অস্বাভাবিক নয়। আর এসব ক্ষেত্রে দেখা গেছে মন্ত্রী বা স্থানীয় সংসদ সদস্য ভুল প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। তাদের কারণে যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী আড়ালে পড়ে গেছেন।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার পর প্রার্থী বাছাইয়ে আমরা স্বল্প সময় পেয়েছি। এত অল্প সময়ে তৃণমূল থেকে সঠিক প্রার্থী বাছাই করা দুরূহ কাজ। এর পরও দ্রুত সময়ের মধ্যে যে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়, তার শতকরা ৯০ ভাগই সঠিক ছিল। হয়তো ১০ ভাগ প্রার্থীর মধ্যে দুর্বলতা ছিল। সে কারণে দু-একটি জায়গায় বিদ্রোহী প্রার্থী জিতেছেন।’
বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে নেওয়া সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে জানিয়ে হানিফ বলেন, ‘আগামী কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে তাঁদের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।’
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ফারুক খান বলেন, ‘সামনে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে বিদ্রোহী বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। তাঁদের বিষয়ে আমাদের কঠোর অবস্থানই অব্যাহত থাকবে। কারণ দলীয় শৃঙ্খলা যাতে নষ্ট না হয় সে বিষয়ে আমরা সতর্ক রয়েছি।’
তবে মনোনয়নের ক্ষেত্রে আগামী দিনে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আরো সতর্ক হবে জানিয়ে ফারুক খান বলেন, ‘এ নির্বাচন আমাদের জন্য একটি নতুন অভিজ্ঞতা। ফলাফল আমরা পর্যালোচনা করে দেখছি। আমরা প্রার্থী দিয়েছি এবং ফলাফলের মাধ্যমে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কাছে ফিডব্যাক পেয়েছি। পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে এগুলো বিবেচনায় নিয়ে সতর্ক হব।’
আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল এমন অর্ধশত পৌরসভায় ভোটের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, জয়-পরাজয় নির্ধারণে এই প্রার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ১৯টিতে বিদ্রোহীরা বিজয়ী হয়েছেন। এক ডজনের মতো বিদ্রোহী দ্বিতীয় হয়েছেন। আর অন্যগুলোয় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোট পেয়ে তৃতীয় বা চতুর্থ হয়েছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে বিদ্রোহী প্রার্থী কারিবুল হক রাজিন নারিকেলগাছ প্রতীকে পান ১০ হাজার ২১৫ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী জামায়াত নেতা জাফর আলী ছয় হাজার ২২২ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন। এখানে বিএনপির শফিকুল ইসলাম চার হাজার ৯৩৫ ভোট পেয়ে জামানত বাঁচান। আর নৌকা প্রতীক নিয়ে ময়েন খান দুই হাজার ৬৬১ ভোট পেয়ে চতুর্থ স্থান পান। এ পৌরসভায় মোট ২৪ হাজারের বেশি ভোটার ভোট দেন। জামানত বাজেয়াপ্ত এড়ানোর জন্য নৌকার তিন হাজার ভোট প্রয়োজন ছিল।
শিবগঞ্জ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ পৌরসভায় বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে কারিবুল হক রাজিন ও তাঁকে সহযোগিতা করার জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য গোলাম রাব্বানীকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু ভোটের ফলাফলে প্রমাণ হয়েছে কেন্দ্রীয় নেতারা ভুল প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছিলেন। এখন কেন্দ্রের উচিত হবে বহিষ্কারাদেশ তুলে নিয়ে ভুল সংশোধন করা।
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে বিদ্রোহী প্রার্থী আব্দুল কাইয়ুম পেয়েছেন ১০ হাজার ১৮৬ ভোট। আর নৌকা প্রতীক নিয়ে কামরুল ইসলাম চৌধুরী মামুন পেয়েছেন চার হাজার ৯১ ভোট।
সিলেটের কানাইঘাট পৌরসভায় বিদ্রোহী প্রার্থী নিজাম উদ্দিন আল মিজান নারিকেলগাছ প্রতীক নিয়ে পান তিন হাজার ৩৭৮ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের লুত্ফুর রহমান দুই হাজার ৮৯৭ ভোট।
নিজাম উদ্দিন আল মিজান এবং তাকে সহযোগিতা করার অভিযোগে পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যক্ষ সিরাজুল ইসলামকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় বিদ্রোহী প্রার্থী শফি আলম ইউনুছ চার হাজার ২২৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএ কামাল উদ্দিন পেয়েছেন চার হাজার ১৬৪ ভোট। এখানে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী দ্বিতীয় স্থানও পাননি।
নড়াইলের কালিয়া পৌরসভায় বিদ্রোহী ফকির মুশফিকুর রহমান তিন হাজার ৮১২ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। এখানে নৌকা প্রতীকে মো. ওয়াহিদুজ্জামান হীরা পান এক হাজার ৭৫৪ ভোট।
মেহেরপুরের গাংনীতে বিদ্রোহী প্রার্থী আশরাফুল ইসলাম ভেণ্ডার সাত হাজার ৮৬ ভোট পেয়ে জয় পান। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আহম্মেদ আলী নৌকা প্রতীকে পান পাঁচ হাজার ১১৬ ভোট।
চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে আওয়ামী লীগ থেকে সম্প্রতি বহিষ্কৃত বিদ্রোহী প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ছয় হাজার ৪০৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। এখানে নৌকার প্রার্থী দ্বিতীয় স্থানও পাননি। বিএনপির নোয়াব আলী তিন হাজার ৮২২ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন। চুয়াডাঙ্গা পৌরসভায় বিদ্রোহী ওবাইদুর রহমান চৌধুরী ২৪ হাজার ৯৮৩ ভোট পেয়ে জয়ী হন। এখানে নৌকা প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়তে পারেনি। নৌকায় মাত্র ১০ হাজার ৫৭ ভোট পড়ে।
বগুড়ার ধুনটে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হয়েছেন বর্তমান মেয়র এ জি এম বাদশা। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পারেননি নৌকার প্রার্থী। দ্বিতীয় হয়েছেন বিএনপির আলিমুদ্দিন হারুন মণ্ডল।
পাবনার চাটমোহরে বিদ্রোহী প্রার্থী মির্জা রেজাউল করিম দুলাল তিন হাজার ৫৩৮ ভোট পেয়ে জয় পেয়েছেন। এখানেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পারেনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী। বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী প্রফেসর আবদুল মান্নান এখানে দ্বিতীয় স্থান পান।
দিনাজপুরের বিরামপুরে বিদ্রোহী প্রার্থী লিয়াকত আলী সরকার টুটুল ৯ হাজার ৬২০ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। আওয়ামী লীগের আক্কাস আলী আট হাজার ৯২৮ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন।
এ ছাড়া সিলেটের গোলাপগঞ্জে সিরাজুল জব্বার চৌধুরী, ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে মোজাফফার হোসেন মিয়া, নেত্রকোনার মদনে আব্দুল হান্নান তালুকদার শামীম, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে আবদুস ছাত্তার, ময়মনসিংহের ত্রিশালে এ বি এম আনিসুজ্জামান, বরগুনায় শাহাদাত হোসেন; কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে আব্দুল কাইয়ুম, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে সাদেকুর রহমান বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন।
আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনায় যুক্ত একটি সূত্র জানায়, প্রায় একডজন পৌরসভায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়ের কাছাকাছি পৌঁছালেও শেষ পর্যন্ত হেরে গেছেন। এসব পৌরসভায় বিদ্রোহীরা দ্বিতীয় হন।
সূত্রটি জানায়, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থী ৯ হাজারের মতো ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। বিদ্রোহী প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ ঘোষ পাঁচ হাজার ৭৯ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন। আর নৌকা প্রতীক নিয়ে আব্দুল হাই পেয়েছেন প্রায় চার হাজার ভোট। এখানে একক প্রার্থী থাকলে নৌকা জয় পেত।
নীলফামারীর জলঢাকায় বিএনপির ফাহমিদ ফয়সাল চৌধুরী ৯ হাজার ৬৫৪ ভোট পেয়ে জয়ী হন। এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে না পারলেও বিদ্রোহী প্রার্থী ইলিয়াস হোসেন বাবলু সাত হাজার ৫৪০ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন।
পাবনার সুজানগরে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী তোফাজ্জল হোসেন তোফা তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন নৌকার আব্দুল ওহাবের সঙ্গে। ওহাব পান ছয় হাজার ৭৪ ভোট আর তোফা পাঁচ হাজার ৯৫।
কুষ্টিয়ার খোকসাতে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আল মাসুম মোর্শেদ।
২ জানুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪ডটকম/এসএস/এসবি