রবিবার, ০৩ জানুয়ারী, ২০১৬, ১০:০৭:০৮

ইসলামের জয়গানে যুগের মুয়াজ্জিন নজরুল

ইসলামের জয়গানে যুগের মুয়াজ্জিন নজরুল

নিউজ ডেস্ক : আবহমান বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির আকাশে নজরুল ইসলাম একটি ব্যতিক্রমী বিষ্ময়কর নাম। বাংলার মুসলমান সাহিত্য রাজ্যের সিংহাসনের অধিপতি কবি নজরুল। ১৮৯৯ খ্রীস্টাব্দের ২৪ মে ; ১১ জৈষ্ঠ ১৩০৬ বাংলা সনে পশ্চিম বংগের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলাম জন্ম গ্রহন করেন। উনিশ শতকের বাংগালী মুসলমানদের ইতিহাস নিদারুন নিগৃহীত জীবনের ইতিহাস। শিক্ষাহীন, চাকুরীহীন, ব্যবসাহীন, মুটে-মজুর, মাঝি, মিন্তি, কৃষক, ক্ষেতমজুর মুসলমানদের তথাকথিত বাঙালী বাবুদের ক্রীতদাস হয়ে ধুঁকে ধুঁকে বেচে থাকার ইতিহাস। সেই সময়েই কাজী নজরুল ভোরের নকীব হয়ে জাগরণের গান শুনালেন- কোথা সে আজাদ কোথা সে পূর্ণ মুক্ত মুসলমান ? আল্লাহ ছাড়া করেনা কারেও ভয় কোথা সেই প্রাণ কোথা সে আরিফ,কোথা সে ইমাম,কোথা সে শক্তিবীর মুক্ত যাহার বানী শুনে কাপে ত্রীভূবন থরথর । ভাগ্যাহত, নিপীড়িত একটি জাতি যখন স্বাধীনতা হারিয়ে ঘরে বাইরে শত্রু পরিবেষ্টিত, আধমরা আড়ষ্ট ও ম্রিয়মান তখন এই যুগশ্রষ্টা সাহসী সন্তান বাঙালী মুসলমানদের আত্মবিস্মৃতি, অসচেতনতা, নিদরাচ্চন্নতাকে চাবুক মেরে জাগিয়ে তুলেন- ভূবনজয়ী তোরা কি হায় সেই মুসলমান খোদার রাহে আনলে যারা দুনিয়া না-ফরমান এশিয়া ইউরোপ আফ্রিকাতে যাহাদের তাকবীর হুংকারিল উড়লো যাদের বিজয় নিশান। যে সময়ে বাঙালীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কলংকিত, সবচেয়ে বেশি নিন্দিত, কু লিখিত বিষয় ছিল ইসলাম, সেই সময়ে বাংলার সাহিত্যে ইসলামের সত্য সনাতন নিষ্কলংক চিত্র দান করেছিলেন নজরুল।তিনিই বাংগালী মুসলমানদের ভগ্ন শুষ্ক শ্রান্ত বুকে আশার ধ্বনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন। ইসলামের সত্যস্বরুপ দেশের সম্মুখে ধরে মুসলমানদের বুকে বল দিয়েছিলেন। অমুসলমানদের বুক হতে ইসলামের অশ্রদ্ধা দূর করতে হিন্দু-মুসলমান মিলনের সত্য ভিত্তির পত্তন করেছিলেন। তিনি ছিলেন বাংগালী মুসলমানদের মুক্তির অগ্রদূত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথসহ বাংলার বড় বড় লেখিয়েরা উৎসব বুঝাতে যখন দুর্গোৎসব আর ঢাকের বাদ্য নিয়ে চর্চায় মেতেছিলেন তখন সেই ১৯৩১ সালে "হিজ মাস্টার্স ভয়েজ " রেকর্ডে আব্বাস উদ্দিনের কন্ঠে নজরুল গাওয়ালেন 'ও মন রমজানের ঐ রোযার শেষে এলো খুশির ঈদ'। ১৯৪১ সালের ২৩ অক্টোবর পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন, তৎকালীন ইং-হিন্দু পরিচালিত অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে প্রথম যে আজানের ধ্বনি ভেসে এলো তার স্বার্থক মোয়াজ্জিন কাজী নজরুল। সেই বৈরী সময়েও রেডিও থেকে পাক কুরআনের তেলাওয়াত ঝংকৃত হলো, ক্বারী আমাদের কবি নজরুল। কাজী নজরুল বিদ্রোহের গান গেয়েছেন, অন্যায় জুলুমের বিরুদ্ধে, বেনিয়ানদের বিরুদ্ধে, মিথ্যা কলুষিত পুরাতনের বিরুদ্ধে,ধর্মের নামে ভন্ডামী ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। যার কারনে তিনি একদিকে স্বজাতির কাছ থেকে কাফির ফতোয়ার শিকার হন। অপরদিকে অমুসলমানদের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক বলে গালি দেয়া হয়। সর্বোপরি তিনি উপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা কারা নির্যাতনের শিকার হন। কাজী নজরুল ছিলেন মানুষের কবি।মানুষকে প্রকৃত অর্থে ভালবেসেছিলেন তিনি। এই মানুষের মাঝে কোনো শ্রেণী বা ধর্মভেদ ছিলনা, ছিলনা শ্রেণী বৈষম্য । একমাত্র নজরুলই যিনি আজীবন সাম্য ও সম্প্রীতির কথা বলেছেন।হিন্দু মুসলমান মিলনের কথা বলেছেন। যার কারনে তিনি যেমনি ইসলামী সংগীত তথা মুসলমানের জাগরনের কথা লিখেছেন, তেমনি হিন্দুদের জন্য শ্যামা সংগীত ও লিখেছেন ।নজরুলের সাহিত্যে যেমনি মুসলমানের কথা আছে তেমনি অমুসলমানের কথাও- গাহি সাম্যের গান মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,নাই কিছু মহিয়ান। নাই দেশ কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি সবদেশে সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জাতি। কাজী নজরুল স্বধর্ম ও স্বজাতির উত্থান কামনা করেছেন, মুসলমানদেরকে অতীতের গৌরবোজ্জল স্বপ্নে উজ্জিবিত হতেও আহবান জানিয়েছেন।কিন্তু তার কবিতা গানে হিন্দু ও অন্যান্য জনগোষ্ঠির অস্তিত্ব বিচিত্ররুপে ধরা দিয়েছে। গাহি সাম্যের গান- যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম ক্রীস্টান। নজরুল ছিলেন নারী অধিকার আন্দোলনের অগ্রপ্রতিক। তার কাব্যে নারীসত্তার স্বাধিকারের দাবী পরিপূর্ণতা লাভ করে। সমঅধিকার ভিত্তিক নারীসত্তায় তার কলম ছিলো স্বচ্ছ,নির্ভীক ও সোচ্চার। বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি, চিরকল্যানকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। দিবসে দিয়াছে শক্তি সাহস,নিশাথে হয়েছে বধু পুরুষ এসেছে মরু তৃষা লয়ে, নারী জোগায়েছে মধু। কোনকালে একা হয়নিক জয়ী পুরুষের তরবারী প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয়লক্ষী নারী। তারুণ্যের জয়গান গেয়েছেন লেখায়, চিন্তায়, কথায়।তরুণদের জাগাতে তিনি লিখেছেন, তরুণ নামের জয় মুকুট শুধু তাহার -যাহার শক্তি অপরিমান, গতিবেগ ঝনজার ন্যায়, তেজ নির্মেঘ আষাঢ়, বিপুল যাহার আশা, ক্লান্তিহীন যাহার উৎসাহ, বিরাট যাহার ঔদার্য, অফুরন্ত যাহার প্রাণ, অতল যাহার সাধনা, মৃত্যু যাহার মুঠিতলে"- চল চল চল উর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল নিম্নে উতলা ধরণীতল অরুণ প্রাতের তরুণ দল চলরে চলরে চল। গরিব দুঃখী মেহনতি মানুষের জন্য কবি নজরুলের প্রাণ সদা কাদতো।তাইতো তাদের দুঃখ কষ্ট অধিকারের কথা তার লেখায় ফুটে উঠে - দেখিনু সেদিন রেলে কুলি বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে চোখ ফেটে এলো জল এমনি করে কি জগত জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল। কাজী নজরুল তিনি ছিলেন কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার, সুরকার ,সাংবাদিক,চলচ্চিত্রকার,নাট্যকার, অভিনেতা, সংগীতশিল্পী ও সৈনিক। অপরদিকে তিনি ছিলেন মসজিদের মুয়াজ্জিন কিংবা ইমাম। পাশাপাশি মানবপ্রেমে ভরপুর এক বহুমাত্রিক বিচিত্র ব্যন্জনায় সমৃদ্ধ এক মহান পুরুষ। মাত্র ২২ বছরের সাহিত্য জীবনে কাজী নজরুল ইসলাম সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন প্রচন্ড বিস্ময় ও নতুন ইতিহাস। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট সকাল ১০টা ১০ মিনিটে এই মহান কবি ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুর পর তার শেষ ইচ্ছানুযায়ী তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গনে সমাহিত করা হয়। মসজিদেরি পাশে আমায় কবর দিও ভাই যেন গোর থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই ৩ জানুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪ডটকম/এসএম/ডিআরএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে