জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সঙ্কট মোকাবিলায় মোটা দাগে ৬টি প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশে বলেন, গত বছর জাতিসংঘ অধিবেশনে কোভিডমুক্ত বিশ্ব গড়তে টিকার সর্বজনীন ও সাশ্রয়ী মূল্যে প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে টিকাকে ‘বৈশ্বিক সম্পদ’ হিসেবে বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছিলাম।
বিশ্বনেতাদের অনেকে এতে সহমত পোষণ করলেও সেই আবেদনে প্রত্যাশিত সাড়া পাওয়া যায়নি। ফলে ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে টিকা বৈষম্য বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ যাবৎ উৎপাদিত টিকার ৮৪ শতাংশ উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মানুষের কাছে পৌঁছেছে। নিম্ন আয়ের দেশগুলো পেয়েছে ১ শতাশেরও কম টিকা। জরুরিভিত্তিতে এ বৈষম্য দূর করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, লক্ষ লক্ষ মানুষকে টিকা থেকে দূরে রেখে কখনোই টেকসই পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। বাংলাদেশের সরকার প্রধান কোভিড-১৯ মোকাবিলায় কার্যকর বৈশ্বিক উদ্যোগের ঘাটতির বিষয়টি সামনে আসার কথা যেমন, তেমনি এ নিয়ে বৈশ্বিক সংহতি ও সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার উপরেও আলোকপাত করেন।
তিনি বলেন, সর্বজনীন বিষয়গুলোতে আমাদের অবশ্যই একসঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই ক্রান্তিলগ্নে জাতিসংঘই হোক আমাদের ভরসার সর্বোত্তম কেন্দ্রস্থল। আসুন, সেই ভরসাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রত্যয়ে আমরা সবাই হাতে হাত মিলিয়ে একযোগে কাজ করি। বিশ্ব শান্তি ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের অবদানের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভোরে একদল বিপথগামী ঘা'তক আমার পিতা, বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আমার পরিবারের ১৮ জন সদস্য ও নিকটাত্মীয়কে নির্ম'মভাবে হ'ত্যা করে। আমি ও আমার ছোটবোন শেখ রেহানা সে সময় বিদেশে অবস্থান করায় বেঁচে যাই।
আমাদের ৬ বছর দেশে ফিরতে দেওয়া হয়নি। স্বজন হা'রানোর বে'দনা বুকে নিয়ে বিদেশের মাটিতে নি'র্বা'সিত জীবন কাটিয়েছি। দেশে ফিরে আমি মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শুরু করি। জাতির পিতার স্বপ্ন সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্যে আজও আমি কাজ করে যাচ্ছি। যতদিন বেঁচে থাকবো, মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে যাব, ইনশাআল্লাহ।
শুক্রবার নিউ ইয়র্ক সময় সকাল ১০টায় (বাংলাদেশ সময় রাত১২টা) ভাষণ দেন বাংলাদেশের সরকার প্রধান। ২৫ মিনিটের ভাষণে তিনি রোহিঙ্গা সঙ্কট, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁ'কি মোকাবিলা এবং সম-সাময়িক বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেন। বঙ্গবন্ধুর পথ অনুসরণ করে অতীতের ভাষণের ধারাবাহিকতায় এবারও প্রধানমন্ত্রী বিশ্বসভায় বাংলায় ভাষণ দেন।
মহামারি প্রলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা, প্রধানমন্ত্রীর নির্দিষ্ট ৬ প্রস্তাব:
বাংলাদেশের সরকার প্রধান শেখ হাসিনা বলেন, অনাদিকাল হতে মানবজাতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামা'রি এবং মানবসৃষ্ট নানা সং'ঘা'ত ও দু'র্যোগ মো'কাবিলা করে আসছে। এতদসত্ত্বেও বুকে আশা এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে মানবজাতি এসব পাহাড়সম সমস্যা অতিক্রম করে টিকে রয়েছে। করোনা মহামারিও এমনি একটি সঙ্কট যেখান থেকে বহু মানুষের টিকে থাকার অনুপ্রেরণামূলক এবং উদারতার উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে।
দুঃখজনক হলেও এই মহামারি আরও বেশ কিছুদিন স্থায়ী হবে বলে মনে হচ্ছে। সেজন্য এ অভিন্ন শত্রুকে মোকাবিলা করার জন্য অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন আমাদের অনেক বেশি নতুন, অন্তর্ভূক্তিমূলক ও বৈশ্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়ে আমি কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরছি।
এক. কোভিডমুক্ত একটি বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে টিকার সর্বজনীন ও সাশ্রয়ী মূল্যে প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। তাই আমি আবারও আহ্বান জানাচ্ছি, সবার জন্য ন্যায়সঙ্গত ও সাশ্রয়ী মূল্যে টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে। অবিলম্বে টিকা প্রযুক্তি হস্তান্তর টিকার সমতা নিশ্চিত করার একটি উপায় হতে পারে। প্রযুক্তি সহায়তা ও মেধাস্বত্ত্বে ছাড় পেলে বাংলাদেশও ব্যাপক পরিমাণে টিকা তৈরি করতে সক্ষম।
দুই. এ মহামারি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে অধিকমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ-১ এর প্রতিবে'দনে আমাদের এ গ্রহের ভবিষ্যতের এক ভ'য়া'ল চিত্র ফু'টে উঠেছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে জলবায়ু পরিবর্তনের ধ্বং'সাত্ম'ক প্রভাব কা'টিয়ে উঠা কঠিন হবে। ধনী অথবা দরিদ্র - কোন দেশই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে নিরাপদ নয়। তাই আমি ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, নিঃস'রণের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং টেকসই অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন ও প্রযুক্তির অবাধ হস্তান্তরের আহ্বান জানাচ্ছি।
ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম এবং ভালনারেবল-২০ গ্রুপ অব মিনিস্টারস্ অব ফাইন্যান্স-এর সভাপতি হিসেবে আমরা ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা- দশক ২০৩০’ এর কার্যক্রম শুরু করেছি। এ পরিকল্পনায় বাংলাদেশের জন্য জলবায়ুকে ঝুঁকির কারণ নয়, বরং সমৃদ্ধির নিয়ামক হিসেবে পরিণত করার কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিতব্য ‘কনফারেন্স অব পার্টিজ’ কপ-২৬ শীর্ষ সম্মেলন আমাদের নতুন নতুন অন্তর্ভূক্তিমূলক পরিকল্পনার পক্ষে সমর্থন আদায়ের অপার সুযোগ করে দিতে পারে। এ সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য সবাইকে আহ্বান জানাই।
তিন. মহামারির প্র'কো'পে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা চর'মভাবে বি'পর্য'স্ত। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের ত'থ্য অনুযায়ী, করোনাকালে আংশিক বা পুরোপুরি বিদ্যালয় বন্ধের কারণে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্র'স্ত হয়েছে। নিম্ন আয়ের দেশগুলোর লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর দূরশিক্ষণে অংশগ্রহণের সক্ষমতা ও প্রযুক্তি না থাকায় ভর্তি, স্বাক্ষরতার হার ইত্যাদি অর্জনগুলো হু'মকির মুখে পড়েছে। ডিজিটাল সরঞ্জামাদি ও সেবা, ইন্টারনেটের সুযোগ-সুবিধার সহজলভ্যতা ও শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করতে হবে। এ জন্য আমরা জাতিসংঘকে অংশীদারিত্ব ও প্রয়োজনীয় সম্পদ নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান জানাই।
চার. কোভিড-১৯ অতিমারির নজিরবিহীন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পথে রয়েছি। তবে, এ মহামারি অনেক দেশের উত্তরণের আকাঙ্ক্ষাকে বিপ'ন্ন করেছে। স্বল্পোন্নত দেশের টেকসই উত্তরণ ত্বরান্বিত করার জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে আমরা প্রণোদনাভিত্তিক উত্তরণ কাঠামো প্রণয়নে আরও সহায়তা আশা করি। এলডিসি-৫ সম্মেলনের প্রস্তুতিমূলক কমিটির অন্যতম সভাপতি হিসেবে, আমরা আশা করি যে দোহা সম্মেলনের সুনির্দিষ্ট ফলাফল আরও বেশি সংখ্যক দেশকে সক্ষমতা দান করবে, যেন তারা স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে টেকসইভাবে উত্তরণ করতে পারে।
পাঁচ. মহামারিকালে প্রবাসীরা অপরিহার্য কর্মী হিসেবে স্বাস্থ্য ও অন্যান্য জরুরি সেবাখাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। তারাও সম্মুখসারির যো'দ্ধা। তবুও তাদের অনেকে চা'কুরিচ্যু'তি, বেতন ক'র্ত'ন, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সামাজিক সেবার সহজলভ্যতার অভাব ও বাধ্যতামূলক প্রত্যাবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্র'স্ত হচ্ছে। এই সঙ্ক'টকালে অভিবাসীগ্রহণকারী দেশগুলোকে অভিবাসীদের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত আচ'রণ করার এবং তাদের কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য এবং কল্যাণকে নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
ছয়. রোহিঙ্গা সঙ্কট এবার পঞ্চম বছরে পড়লো। কিন্তু এখন পর্যন্ত বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের একজনকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। মিয়ানমারে সামপ্রতিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে অনিশ্চয়তা তৈরি হলেও এ সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান খুঁ'জে বের করতে আমরা আন্তর্জাতিক স'মপ্র'দায়ের জো'রালো ভূমিকা ও অব্যাহত সহযোগিতা আশা করি। মিয়ানমারকে অবশ্যই তার নাগরিকদের প্রত্যাবর্তনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে সহযোগিতা করতে সদা প্রস্তুত। বাংলাদেশে তাদের সাময়িক অবস্থানকে নিরাপদ ও সুরক্ষিত রাখতে কিছু সংখ্যক বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিককে আমরা ‘ভাষানচর’-এ স্থানান্তর করেছি। আশ্রয় শিবিরে কোভিড-১৯ ম'হামা'রির বিস্তাররোধে টিকালাভের যোগ্য সকলকে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
আগেও বলেছি, আবারও বলছি- রোহিঙ্গা স'ঙ্ক'টের সৃষ্টি মিয়ানমারে, সমাধানও রয়েছে মিয়ানমারে। রাখাইন রাজ্যে তাদের মাতৃভূমিতে নিরা'পদ, টে'কসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই কেবল এ স'ঙ্ক'টের স্থায়ী সমাধান হতে পারে। এ জন্য আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে অবশ্যই গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমরা আশা করি আসিয়ানের নেতৃবৃন্দ বা'স্তুচ্যূ'ত মিয়ানমার নাগরিক ই'স্যু'তে গৃ'হীত প্রচেষ্টাকে আরও বে'গ'বান করবেন। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক স'মপ্র'দায়কে মানবাধিকার ল'ঙ্ঘ'নের জন্য দা'য়ীদের জবা'দদি'হি নিশ্চিতক'রণে গৃহীত সকল কর্মকা'ণ্ডে সহযোগিতা করতে হবে।