মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১০:০৬:২৯

রাজনীতিতে ‘আগাছা’ তত্ত্ব ও কালিহাতী থেকে সন্দ্বীপ

রাজনীতিতে ‘আগাছা’ তত্ত্ব ও কালিহাতী থেকে সন্দ্বীপ

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : গতকাল সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে টেলিভিশন পর্দায় 'চট্টগ্রামে কুরবানির গরুরহাটের আধিপত্য নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের দু'গ্রুপের গোলাগুলিতে দু'জন সাধারণ খেটে খাওয়া নাগরিক নিহত হবার খবর দেখার পর থেকেই মনটা খুব খারাপ। নিহত দুই নাগরিকের দেহ থেকে রক্ত গড়ানোর দৃশ্যটি কোনোভাবেই যেন ভুলতে পারছি না, হৃদয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ঈদের আগ মুহূর্তে এমন দৃশ্য দেখতে হবে তা কখনো ভাবেনি।

পত্রপত্রিকার খবর পাঠে এবং চট্রগ্রামের অবস্থান করা বন্ধুমহলের সাথে ফোনে কথা বলে যা জানতে পেলাম তাতে, আরো বেশি মর্মাহত হয়েছি। কেননা, ঘটনাটি হঠাৎ করেই ঘটেনি, বেশ ক'দিন ধরেই গরুরহাট নিয়ে উত্তেজনা চলে আসছিল। গতকাল বিকালে সন্দ্বীপ পৌরসভার বাতেন মার্কেট এলাকায় যা ঘটেছে তা মূলত: ক্ষমতাসীন দলের দুই গ্রুপের কুরবানির পশুরহাটের নিয়্ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই।যা জানা গেছে তাতে, স্থানীয় সংসদ সদস্য (চট্টগ্রাম-৩) এ বি এম মাহফুজুর রহমান মিতার সঙ্গে পৌর মেয়র জাফরউল্যাহ টিটোর দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। এ হাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও মতবিরোধ চলে আসছিল। এর জের ধরে সোমবার বিকেলে গরুর হাটে জাফর গ্রুপ ও বাতেন গ্রুপের লোকজন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তাদের এলোপাতাড়ি গুলিতে দু'জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। আর যে দুজন নাগরিকের প্রাণ গেল তাদের মধ্যে জাহাঙ্গীর পেশায় দিনমজুর আর কবির ভ্যানে করে দোকানে বিস্কুট সরবরাহ করতেন।বরাবরের মতো গতকালও তারা পেটের দায়ে কাজ বের হয়েছিল। কিন্তু বিনা অপরাধে ঈদের আগে এমন ভাগ্যবরণ করতে হবে তা হয়তো কখনো ভাবেনি তাদের পরিবারের সদস্যরা।

খবরে দেখলাম ঘটনার পরপরই ওই এলাকায় জুড়ে বিপুল সংখ্যক র্যাব-পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সন্দ্বীপ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বলেছেন, কুরবানির পশুর হাটে চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসীদের মধ্যে এ ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় কারা জড়িত, কীভাবে ঘটনা ঘটল তা খতিয়ে দেখছেন তারা। এছাড়া সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার অভিযান চালাচ্ছেন। থানা ওসির এমন বক্তব্যে আমরা মোটেও আশ্বস্ত হতে পারিনি। কেননা, পুলিশের এমন কথা নতুন কিছু নয়, বরাবরের মতোই বক্তব্য দিলেন ওসি। ওসি সাহেবের কথা শুনে মনে হলো- এই সন্ত্রাসীরা হঠাৎ করেই যেন আসমান থেকে নেমে ঘটনা ঘটিয়ে ফের বাতাসে মিলিয়ে গেছে। অবশ্য পুলিশের কাছ থেকে এর চেয়ে আর বেশি কিছু আশা করাও আমাদের বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।

কেননা, এর আগেও আমরা দেখেছি মাগুরায় ক্ষমতাসীন দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গোলাগুলিতে একজন নিহত হয়। মাতৃগর্ভে শিশুও রক্ষা পায়নি তাদের হাত থেকে।এইতো গেল শুক্রবার কালিহাতীতেও যে ঘটনা ঘটেছে সেখানেও ঘটনার নায়ক সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রোমা ও তার সহযোগীরা সরকার দলীয় লোকবল। ক্ষমতা দাপটেই তারা তুচ্ছ ঘটনায় মা-ছেলেকে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে তাদের উপর বর্বর নির্যাতন চালিয়েছে।এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়েও পুলিশের গুলিতে প্রাণ গেছে চার সাধারণ নাগরিকের। মামলায় এলাকা ছাড়া হয়ে ফেরারী আসামী হয়েছেন হাজার হাজার এলাকাবাসী।

এছাড়া ক'দিন আগে শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সামনেই দল বেঁধে শিক্ষকদের উপর হামলা করলো ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা।এর আগে আমরা দেখেছি বর্ষবরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের টিএসসি চত্বরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে কীভাবে প্রকাশ্যে নারীর ‘শ্লীলতাহানি’ ঘটনো হয়। এতে কারও কারও শাড়ি ধরে টান দিয়েছে বখাটেরা। কয়েকজনকে প্রায় বিবস্ত্রও করে অন্যায় আবদার পূরণের চেষ্টা করে।একই দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে অন্যায় আবদার পূরণের চেষ্টা করা হয়। আমরা দেখেছি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিজ দপ্তরে গিয়ে একজন এমপি এবং দলীয় ক্যাডার কর্তৃক ভিসিকে কীভাবে লাঞ্চিত করা হয়েছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি হয়নি। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে।

এইতো ক'দিন আগে সিলেটে শিক্ষকদের উপর হামলার ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী বললেন- দল থেকে 'আগাছা' ছেটে ফেলার কথা। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব স্মরণে ৩১ আগস্ট সন্ধ্যায় ছাত্রলীগ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী সংগঠন থেকে আগাছা উপড়ে নীতি আদর্শের ওপর চলতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের পরামর্শ দিয়েছেন বলেন, ‌‘জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করতে হবে। মানুষের আস্থা, ভালবাসা ও বিশ্বাস অর্জন করতে হবে।’ তিনি বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করে এও বলেন- ‘বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন, এ দেশের মাটি উর্বর, এখানে বীজ ফেললেই যেমন গাছ হয়; আবার এ উর্বর ভূমিতেই আগাছাও জন্মায়। আর এই আগাছাগুলোই আসলদের সর্বনাশটা করে। কাজেই আগাছাগুলো উপড়ে ফেলে ভাল গাছগুলো যাতে বেড়ে উঠতে পারে, সে পথটাই আমাদের বেছে নিতে হবে।’

কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণের পরও কি নিজ দলের লোকজনের দৌরাত্ম কমেছে? না, কমেনি বরং প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি উচ্চারণের কয়েকদিনের মধ্যেই এই ব্যাধি সিলেট থেকে টাঙ্গাইলের কালিহাতী হয়ে চট্রগ্রামের সন্দ্বীপ পর্যন্ত ছড়িয়েছে। জানিনা, প্রধানমন্ত্রী এখন আবার কী বলে দেশবাসীকে শান্তনা দিবেন। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে ইচ্ছে করছে, আসলে দলের আগাছা কমেছে, না ক্রমেই তা আরো বাড়ছে, তা কী একটু হিসাব মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন!

চলমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে দেশটা যেন ক্ষমতাসীনরা কারো কাছ থেকে লিজ নিয়েছে। এখানে তারা যা ইচ্ছে তাই করবে, তারা মানুষের উপর নির্যাতন করবে, গুলি করে হত্যা করবে, রক্ত নিয়ে হুলি খেলবে, কারো যেন কোনো কিছু বলার নেই।জনগণের প্রতিবাদ করারও অধিকার নেই। প্রতিবাদ করলে টাঙ্গাইলের কালিহাতীর ন্যায় পরিণতি ভোগ করতে হবে। তাই এগুলো হত্যা নয়, যেন ঈদের আগে ক্ষমতাসীন দলের আগাছা কর্তৃক জাতিকে লাশ দিয়ে ঈদ উপহার! ফলে এসব ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা আমার নেই।      

ক্ষমতাসীনরা জোর গলায় যাই বলুক না কেন, অগণতান্ত্রিক চর্চা আর বিচারহীনতা সংস্কৃতি যে দেশকে ক্রমেই অধ:পতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।ফলে দলবাজি বন্ধ করে যতদিন সমাজে আইনের শাসন কায়েম না হবে ততোদিন এসব চলতেই থাকবে।
 
তাই আজ বারবার মনে পড়ছে প্রয়াত বিচারপতি মোস্তফা কামালের কথা- অবনতিশীল বাংলাদেশকে চূড়ান্ত অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষায় প্রয়াসী হতে এবং গলা উঁচু করে প্রতিবাদ জানানোর জন্য তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে গেছেন। আসুন, সময় থাকতে আমরা সবাই তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই এবং আমাদের দেশ-জাতি ও সমাজকে অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করি।অন্যথা, জাতিকে সামনের দিনে যে আরো বেশি মাসুল গুনতে হবে এতো কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক এবং কলাম লেখক। ই-মেইল:[email protected]

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে