মঙ্গলবার, ০৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬, ০১:৩২:২২

পিতার কবরে

পিতার কবরে

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম : টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনের উপনির্বাচনের প্রথম তফসিল ঘোষণা হয়েছিল ১৫ সেপ্টেম্বর। সেদিন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের রামপুরে এক জনসভা ছিল। রামপুরের লোকজনের চাপাচাপিতে প্রার্থী হব ঘোষণা করেছিলাম। জানতাম না, আমার ঘোষণায়ই কিনা পরদিন ১৬ সেপ্টেম্বর নির্বাচন পুনঃতফসিল করা হয়।

প্রথম ছিল জমার শেষ তারিখ ৩০ সেপ্টেম্বর, বাছাই ৩ অক্টোবর, ভোট ২৮ অক্টোবর। পরে পুনঃতফসিল করা হয় মনোনয়নপত্র জমার শেষ তারিখ ১১ অক্টোবর, যাচাই-বাছাই ১৩ অক্টোবর, ভোট ১০ নভেম্বর। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের পক্ষে আমরা চারজন মনোনয়নপত্র দাখিল করি। বাছাইয়ের সময় হাসমত নেতা ও ইকবাল সিদ্দিকীর মনোনয়নপত্র গ্রহণ করে সোনার বাংলা প্রকৌশলী সংস্থার নামে ব্যাংকে পাওনা আছে বলে আমার এবং আমার স্ত্রীরটা বাতিল করে।

আমরা নির্বাচন কমিশনে আপিল করি। তারা আপিল খারিজ করলে হাইকোর্টে যাই। হাইকোর্ট মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করলে ২২ অক্টোবর রিটার্নিং অফিসার আমার নামে মার্কা বরাদ্দ করেন। এযাবৎ দেখে এসেছি প্রার্থীর নামে মার্কা বরাদ্দ হয়ে গেলে নির্বাচনের আগে আর কারও তেমন কিছু করার থাকে না। কিন্তু কেন যেন নির্বাচন কমিশন মহামান্য চেম্বার জজকোর্টে আপিল করে। বিজ্ঞ মাননীয় চেম্বার জজ ২ নভেম্বর মামলাটি শোনার জন্য সুপ্রিমকোর্টের ফুল বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন।

২ নভেম্বর মাননীয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিমকোর্টের ফুল বেঞ্চ মামলাটি আবার ৩১ জানুয়ারির মধ্যে নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টে পাঠান।  নির্বাচন কমিশন ১২ অক্টোবরের ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের এক চিঠির বলে আমার মনোনয়ন অবৈধ ঘোষণা করলে আমি আদালতের শরণাপন্ন হই। ১১ অক্টোবর সম্পূর্ণ বৈধভাবে আমি মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলাম। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সেটা মানতে চায়নি। তাই হাইকোর্টে যাওয়া এবং হাইকোর্ট আমার যুক্তি গ্রহণ করে নির্বাচনের সুযোগ দিয়েছিল। নভেম্বর থেকে জানুয়ারির আধাআধি মামলাটি ওভাবেই পড়ে ছিল।

আমরা ভেবেছিলাম সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশমতো মামলাটি আপনাআপনিই কার্যতালিকায় আসবে। কিন্তু তা আসেনি। পরে ১৩ জানুয়ারি বুধবার মামলাটি প্রথম আলোচনায় আসে। ১৩ থেকে গত ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আটবার দীর্ঘ সময় কোর্ট উভয় পক্ষের কথা শোনেন। মামলা ছিল প্রার্থী ব্যাংকের যেসব কাগজপাতি কোর্টে দাখিল করেছেন তাতে তিনি ঋণখেলাপি, নাকি ঋণখেলাপি নন— এটাই ছিল বিবেচ্য। মহামান্য কোর্ট সেটা বিচার করেননি। শুধু বলেছেন রিট পিটিশনটি যথানিয়মে হয়নি।

তাই খারিজ করা হলো। যদি আমরা আপিল না করতাম তাহলে এটুকুও লিখতাম না। আমার বাবা ৬০-৬৫ বছর জেলা কোর্টে আইন ব্যবসা করেছেন। বিচারক এ দুনিয়ায় আল্লাহর প্রতিনিধি। তার রায় মেনে নেওয়ার ধৈর্য এবং সাহস দুটোই আমার আছে। আমার বাবা একসময় এক জেলা জজকে বলেছিলেন, ‘মাই লর্ড, এখানে আসামি বাঙালি, বাদী বাঙালি, বিচারক বাঙালি, সাক্ষী বাঙালি, আইনজীবী বাঙালি। কিন্তু রায় শোনানো হয় ইংরেজিতে। যার বিরুদ্ধে রায় সে বুঝল না তার কী অপরাধ আর তাকে কী শাস্তি দেওয়া হলো। অন্যের মুখে শুনে তাকে রায় বুঝতে হচ্ছে।’

বৃহস্পতিবারে মহামান্য হাইকোর্টে নির্বাচনী মামলার রায় আমার কাছে অনেকটা তেমনই মনে হয়েছে। মহামান্য আদালত কোনো প্রতিকার না দিয়ে বলেছেন নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে যেতে। আমরা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি যে, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয় নির্বাচনের পর। আমরা প্রতিকার চাই নির্বাচনের আগে। ঠিক আছে নির্বাচন কমিশনের কোনো আদেশের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে যদি কোনো বিচার চাওয়া না যায় আইন যদি তেমনই হয় আমি আপত্তি করতে যাব কেন? আমার কাছে এমপি হওয়া বড় কথা নয়, নির্বাচনী পদ্ধতিকে স্বাভাবিক রাখাই আমার কাছে বড় কথা। মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে সে জন্যই আমার লড়াই করা।

সেদিন কয়েকটি পত্রিকায় শিরোনামে দেখলাম কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর কবরে কাঁদলেন। গত রবিবার যখন মহামান্য হাইকোর্টে গিয়েছিলাম আমার ধারণা ছিল ওই দিনই রায় হবে। কারণ জজ সাহেবরা দু-একবার বলেছিলেন আমরা রায় মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছি। কিন্তু উভয় পক্ষের আড়াই ঘণ্টা শুনানির পর যখন বললেন চার তারিখ রায় দেব তখন ঠিক করেছিলাম পরদিন শুক্রবার টুঙ্গিপাড়া পিতার কবরে যাব।

রায় পক্ষে, বিপক্ষের কোনো কথা ছিল না। মন কাঁদছিল তাই টুঙ্গিপাড়া যাওয়া স্থির করেছিলাম। আমাদের মতো মানুষের তেমন কাঁদার সুযোগ কোথায়? মুক্তিযুদ্ধের সময় ৭০-৮০ জন যোদ্ধা হাতের ওপর দম ছেড়েছে। তা ছাড়া অনেক মানুষের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সময় কাছে থেকেছি।

বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনটেনসিভ কেয়ারে আমার মা যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তখনো তার দু-পা বুকে চেপে ছিলাম। ওইদিন দুপুরেও মা আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সেদিন মোস্তফা মহসীন মন্টুর আমন্ত্রণে জিঞ্জিরা গিয়েছিলাম ’৭১-এর গণহত্যা দিবস পালন উপলক্ষে। ৭টায় হাসপাতালে ফিরেছিলাম। মার অবস্থা ক্ষণে ক্ষণে খারাপ হচ্ছিল। ৯টার দিকে তাকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়েছিল। ডি ব্লকের তিন বা চার তলায় বারান্দায় পড়ে ছিলাম। ১২-সাড়ে ১২টার দিকে ডাক্তাররা ছুটে এসে ডেকে নেন। গিয়ে মার পা বুকে চেপে দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। মনে হয় রাত ১টা কয়েক মিনিট।

একসময় এক অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর বললেন আর কোনো আশা নেই। অনুমতি দিলে সাপোর্ট খুলে ফেলতে চাই। সেদিন কেন যেন চোখে পানির জোয়ার বইছিল। বুক ভিজে মার পা ভিজে যাচ্ছিল। ১টা ৪০ মিনিটের দিকে রাজি হয়েছিলাম। তখন আমার তেমন কোনো বোধ ছিল না। কত জনকে শেষ যাত্রায় আল্লাহর কালাম শুনিয়েছি। কিন্তু আমি সেদিন আমার জন্মদাত্রী মাকে আল্লাহর কালাম শোনাতে পারিনি। সে আফসোস কোনো দিন ভুলতে পারি না। সাপোর্ট ছেড়ে দিলে কী এক শূন্যতা মার পা থেকেই অনুভব করেছিলাম।

বাবা চলে গিয়েছিলেন তিন বছর আগে, মা-ও চলে গেলেন। জীবনটা শুষ্ক মরুভূমির মতো হয়ে গিয়েছিল। ছোট্ট একটা শিশু মায়ের জায়গা দখল করে কিছুটা তরতাজা রেখেছে। তাই মা-বাবার কবরে গেলে চোখে পানি আসে, বুক হালকা হয়। মা-বাবার পর যাকে পিতা বলে জেনেছি, নেতা বলে জেনেছি তার কবরে রাজনীতি করতে যাই না, ছবি তুলতেও না। ভারী বুক হালকা করতে যাই। টুঙ্গিপাড়ায় সাধারণ লোকজনের কাছে আদর-যত্ন-ভালোবাসার কমতি কোনো দিন হয়নি, সেদিনও না।

ইচ্ছা ছিল জুমার নামাজ পিতার কবরের পাশে মসজিদে পড়ব। কিন্তু ফেরি দেরি করায় তা আর সম্ভব হয়নি। জুমার নামাজ আদায় করেছিলাম ভাটিয়াপাড়া বায়তুল মামুর জামে মসজিদে। যাওয়ার পথে আগেই ফেরির খোঁজ নিয়েছিলাম। ৯টা ১০-১৫ মিনিটে আমাদের গাড়ি ফেরিতে ওঠে। শ্রমিকনেতা শুকুর মাহমুদের কল্যাণে ফেরির অনেকেই চেনে, জানে। গাড়ি থেকে নেমে পা বাড়াতেই ফেরির এক কর্মকর্তা বলছিলেন সাবেক মন্ত্রী শামসুল হক টুকু আসছেন তার জন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে। শামসুল হক টুকু খুব সাদাসিধা মানুষ। আমি তাকে খুবই ভালোবাসি।

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী থাকতে দু-তিন বার তার কাছে গেছি। অসম্ভব যত্ন করেছেন। ’৬৯-এর গণআন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটামুটি একজন ভালো মাপের নেতা ছিলেন। ’৬৯ থেকে আজ অবধি সব ক্ষেত্রে কম-বেশি ভূমিকা আছে তার। আগে থেকেই কাকুলী ফেরির ভিআইপি কেবিনে সাবেক ডেপুটি স্পিকার আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি কর্নেল শওকত আলী সস্ত্রীক বসে ছিলেন। কর্নেল শওকত, সাবেক মন্ত্রী শামসুল হক টুকু, গোপালগঞ্জের মহিলা এমপি উম্মে রাজিয়া কাজলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে খুব সহজেই সময় কেটে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত করতে শামসুল হক টুকুর একদল কর্মী রাজবাড়ী হয়ে টুঙ্গিপাড়ার পথে ছিল।

তারা তিন থেকে চার শতাধিকের কম হবে না। টুকু যাচ্ছিলেন ঢাকা থেকে। বিদ্যুৎ, পানি, যানজট এসব নানা কিছু নিয়ে আলোচনার এক ফাঁকে হঠাৎ শামসুল হক টুকু বলছিলেন, ‘আমরা আগে যখন ঢাকা আসতাম দুই সেট কাপড় বেশি আনতাম ঢাকা থেকে ধুয়ে নিয়ে যাব বলে। তখন ঢাকার পানি যেন ডিস্টিল ওয়াটার। কী দুর্ভাগ্য, সেই ঢাকার পানি এখন মুখে দেওয়া যায় না, পান করা যায় না।’

৩টা কয়েক মিনিটে টুঙ্গিপাড়া পিতার কবরে পৌঁছেছিলাম। শামসুল হক টুকুর লোকজন আর কুষ্টিয়া, ঝিকরগাছা ওইসব এলাকার কিছু লোক বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স ভরে রেখেছিল। প্রায় সবাই ছিল ছবি তোলায় ব্যস্ত। নামাজের জন্য অজু করতে বসেছিলাম। দেখি কলে পানি নেই। ছোট বাচ্চারা ছুটে গিয়ে মোটর চালিয়ে দিল। কী যে ভালো লেগেছিল লিখে বোঝাতে পারব না। কিন্তু ও রকমই বিরক্ত লাগছিল যখন অজু করছি তখনো কেউ কেউ ছবি তুলছে। যখন নাকে মুখে পানি দিচ্ছিলাম তখনো কেউ কেউ বলছিল এদিকে তাকান, ওদিকে তাকান। শুনতে চাইনি তবুও কানে গেছে। আল্লাহ কেন যে কানটা এত পরিষ্কার রেখেছেন ভেবে পাই না।

নামাজ পড়ে কবরের কাছে যেতে বুক হু হু করছিল। চোখ জুড়ে পানি আসছিল। পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে যখন ফাতিহা পাঠ করছিলাম তখনো কতজন ছবি তোলায় ব্যস্ত, ধাক্কাধাক্কি করে ছবি তুলছে কোরআন পাঠ করতে দিচ্ছিল না। একজন যায়, আরেকজন আসে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির লোকজনই বলছিল জিয়ারত শেষে বাইরে গেলে আপনারা ছবি তুলবেন। কে শোনে কার কথা। বড় কষ্ট করে চোখে পানি নিয়ে ফাতিহা পাঠ করে রেলিংয়ের ভিতর পিতার পায়ের কাছে বসেছিলাম। দোয়া-দরুদ পড়ছিলাম। চোখের পানি বাঁধ মানছিল না।

এখন পিতার কবর অনেকটা পয়-পরিষ্কার। কিন্তু আমি যখন নির্বাসন থেকে ফিরেছিলাম তখন এমন ছিল না। প্রায় সময় কাঁধের গামছা দিয়ে কবর মুছতাম। শোকের মাসে সাত-আট দিন সকাল-বিকাল-দুপুর পানি দিয়ে ধুয়েমুছে গামছা দিয়ে পরিষ্কার করতাম। প্রতিবারের মতো গত শুক্রবার বাদ জুমা পিতার পায়ের কাছে বসে চোখের পানি ফেলে অনেকটাই হালকা হয়েছি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি তাকে যেন তিনি বেহেশতবাসী করেন। পিতার কোনো ভুলত্রুটি থাকলে তা-ও যেন দয়াময় প্রভু ক্ষমা করে দেন।

চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে যখন কাঁদছিলাম তখন বার বার মনে হচ্ছিল, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তিনি চিরস্থায়ী। তন্দ্রা, নিদ্রা, ক্লান্তি তাকে স্পর্শ করতে পারে না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যা কিছু আছে সবই তার অধীন। কে এমন আছে তার অনুমতি ছাড়া তার কাছে সুপারিশ করতে পারে। আসমান-জমিন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডব্যাপী তার মহান আসন।

বর্তমান-ভবিষ্যৎ সবই তিনি জ্ঞাত। এ মহাবিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরিচালনা করতে তাকে বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন বা কষ্ট করতে হয় না। তিনি অতি মহৎ। যতবার কথাগুলো মনে হচ্ছিল ততবারই একজন মুসলমান কতটা অসহায় আল্লাহ ছাড়া কতটা অস্তিত্বহীন ভাবছিলাম আর কাঁদছিলাম। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিলাম, হে আল্লাহ! তুমি আমার রাজনৈতিক পিতা বাংলাদেশের জনক শেখ লুত্ফর রহমানের পুত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য দোয়া করার, সুপারিশ করার শক্তি দাও— আমিন। -বিডি প্রতিদিন

লেখক : রাজনীতিক

৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে