উৎপল রায় : ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন্দ্রের নির্দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করেছে আওয়ামী লীগের তৃণমূল। দলীয় প্রতীক ‘নৌকা’ মার্কায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য এরই মধ্যে তৃণমূলের ইউনিয়নগুলোতে শুরু হয়েছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের দৌড়ঝাঁপ। ইতিমধ্যে সরকারি দলের প্রার্থীরা স্ব স্ব এলাকায় নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।
তবে, বেশিরভাগ ইউনিয়নে ২ থেকে ৭ জন প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে থাকায় একক প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিপাকে পড়েছেন আওয়ামী লীগের জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ। এমন পরিস্থিতিতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রার্থিতা নিয়ে তৃণমূলে বিদ্রোহ, সংঘাত ও সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন নেতারা। ঝামেলা এড়াতে কোনো কোনো ইউনিয়নে দলীয় প্রতীক ছাড়াই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন অনেকে। দেশের বেশ কিছু জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, একক প্রার্থী বাছাই করতে গিয়ে গলদঘর্ম অবস্থা তাদের। প্রত্যেকটি ইউনিয়নে প্রার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় সিদ্ধান্তহীনতাসহ যোগ্য ও একক প্রার্থী বাছাই করতে গিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছেন নেতারা। এছাড়া কেন্দ্র থেকে চাপমুক্ত হয়ে প্রার্থী বাছাইয়ের কথা বলা হলেও বিভিন্ন এলাকায় প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দলের কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রী ও এমপিদের প্রভাব থাকায় যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ে সমস্যায় পড়ছে তৃণমূল।
এক্ষেত্রে দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূলের অনেক নেতা। আলাপকালে নেতৃবৃন্দ প্রার্থী বাছাইয়ে জটিলতার বিষয়টি স্বীকার করে বলছেন স্থানীয় মন্ত্রী, এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতারা যদি প্রভাব বিস্তার না করেন তাহলে এ প্রক্রিয়া কিছুটা সহজ হতে পারে। নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবারই প্রথম দলীয় প্রতীক ও পরিচয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সর্বনিম্ন স্তর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আগামী ২২শে মার্চ প্রথম ধাপে দেশের ৭৫২টি ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি।
আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিগত পৌরসভা নির্বাচনের মতো তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের জন্য একক প্রার্থী বাছাই করা হবে। জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা নিজেদের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নে নির্বাচনের জন্য একক প্রার্থী বাছাই করে দলের স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডে পাঠাবেন। প্রার্থীর বিস্তারিত বিবরণ বিচার বিশ্লেষণ করে কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ডই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্তরা একক প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য তৃণমূলের নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রতিটি ইউনিয়নে একক প্রার্থী বাছাই করে দলীয় প্যাডে নাম অন্তর্ভুক্ত করে তা কেন্দ্রে পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাদের।
সোমবার ধানমন্ডিস্থ আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্তদের বৈঠক শেষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এ বিষয়ে তৃণমূলকে নির্দেশনা দিয়েছেন। এমনকি দলীয় প্রার্থী নির্ধারণের পরেও যদি কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী মাঠে থাকেন তাহলে সেই প্রার্থীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেন তিনি।
ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের মজনু বলেন, উপজেলা পর্যায় থেকে প্রার্থীর তালিকা পেয়েছি। কিন্তু যাছাই-বাছাই করতে গিয়ে সমস্যা হচ্ছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি একক প্রার্থী বাছাই করে কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ডে পাঠানোর জন্য। যদি তা না পারি তাহলে কেন্দ্র থেকে যে ধরনের সিদ্ধান্ত দেয়া হবে তাই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। তিনি বলেন, বেশিসংখ্যক প্রার্থীর কারণে দলীয় কোন্দল এড়ানোর জন্য কিছু ইউনিয়নে দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নড়াইলের ৩টি উপজেলার ৩৯টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচনের জন্য ২শ’র বেশি সরকারদলীয় প্রার্থী ইতিমধ্যে মাঠে নেমেছেন। কোনো কোনো ইউনিয়নে প্রার্থী সংখ্যা ৬ থেকে ৭ জন। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের নির্দেশে একক প্রার্থী বাছাই করা কঠিন বলে মনে করছেন জেলা, উপজেলার দায়িত্ব প্রাপ্তরা।
জানতে চাইলে নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নিজামউদ্দিন খান নিলু বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, প্রত্যেকটি ইউনিয়নেই একাধিক প্রার্থী আছে। নৌকা প্রতীকে নির্বাচনের জন্য তারা মাঠে নেমেছেন। নির্বাচনের আগে এদের অনেকেই নির্বাচনী মাঠে থাকবেন না। তবে, শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী দু-একজন হয়তো থাকতে পারেন। আর আমরাও দেখে-শুনে-বুঝে যোগ্য প্রার্থী বাছাই করবো।
ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের অন্তত ৪০ জনের মতো প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে মাঠে নেমেছেন। দলীয় প্রতীক না পেলে অনেকেই বিদ্রোহী হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে একক প্রার্থী বাছাই করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ।
জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়তোষ বিশ্বাস বলেন, আওয়ামী লীগের মতো দলের তৃণমূলে প্রার্থী বাছাইয়ে কিছুটা বেকায়দাতো হবেই। তবে, আমরা যোগ্য ও একক প্রার্থী বাছাই করে কেন্দ্রে পাঠাবো। তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত আওয়ামী মনোনয়ন পেতে যারা দৌড়ঝাঁপ করছেন মনোনয়ন না পেলে তাদের অনেকেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। আর যারা তা করবেন না তাদের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ময়মনসিংহ জেলার একটি উপজেলার সভাপতি আলাপকালে বলেন, যারা প্রার্থী হতে চান তারা সকলেই দলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে, এদের মধ্যেও কেউ কেউ বিদ্রোহী হতে পারে। তারপরও এতে জটিলতা হবে বলে মনে হয় না। তিনি বলেন, দলের জেলা, উপজেলার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকরা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না- দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে এমন কিছু কথা শোনা যাচ্ছে। যদি তাই হয় তাহলে প্রার্থীজট কমতে পারে।
এদিকে দেশের বিভিন্ন ইউনিয়নে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব বিস্তার ফ্যাক্টর হতে পারে বলে মনে করেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তাদের মতে, মন্ত্রী-এমপিরা যদি প্রভাব বিস্তার করেন তাহলে প্রার্থী বাছাইয়ে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
জানতে চাইলে বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীর বলেন, জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের জন্য প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করেছি। কিন্তু এতো প্রার্থীর মধ্যে একক ও যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ে সমস্যা হচ্ছে। তবে, আমরা চেষ্টা করছি। যদি কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রী, এমপিরা প্রভাব বিস্তার না করেন তাহলে তেমন কোনো সমস্যা থাকবে না। খুলনা বিভাগের একটি জেলার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, প্রার্থী বাছাইয়ে কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রী ও এমপিরা যদি প্রভাব বিস্তার না করেন তাহলে তা খুবই ভালো হয়।
এদিকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে বিদ্রোহ, সংঘাত ও বিশৃঙ্খলা হতে পারে- তৃণমূলের এমন আশঙ্কাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। এক্ষেত্রে তৃণমূলের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মানসিকতা না থাকা ও দায়বদ্ধতার বিষয়টিকে উল্লেখ করছেন তারা।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, আওয়ামী লীগ বড় একটি দল। সেই দলের তৃণমূলের প্রার্থী বাছাইয়ে সংশ্লিষ্ট নেতাদের কিছুটা সমস্যাতো হবেই। এর মধ্য দিয়েই যোগ্য ও একক প্রার্থী বাছাই করতে হবে। তবে, তৃণমূলকে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মানসিকতা থাকতে হবে। দল করবো কিন্তু ভুলত্রুটির দায়ভার নেবো না এটা হতে পারে না।
এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী কম হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রার্থী বেশি থাকলেও একক ও যোগ্য প্রার্থীই দলের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেবেন। না হলে পৌরসভা নির্বাচনের মতো দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে এবারও দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে কঠোর মনোভাব দেখানো হবে। -এমজমিন
১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসবি/এসএস