শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬, ০৪:৩৬:৫৯

সেই ফুটবল তারকা মুন্নার স্মৃতি নিয়েই তাদের জীবন

সেই ফুটবল তারকা মুন্নার স্মৃতি নিয়েই তাদের জীবন

নাইর ইকবাল : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬। দেখতে দেখতে ১১ বছর হয়ে গেল, মোনেম মুন্না নেই। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ফুটবলারের স্মৃতিগুলো আঁকড়ে কেমন জীবন কাটছে তার স্ত্রী ও দুই সন্তানের?

রায়েরবাজারের শেরেবাংলা রোডে প্রয়াত মোনেম মুন্নার ছোট্ট সুন্দর ফ্ল্যাট। মৃত্যুর আগে স্ত্রী ইয়াসমিন মোনেম সুরভী আর দুই সন্তান ইউশরা মোনেম দানিয়া ও আজমান সালিদের জন্য রেখে যাওয়া তার একমাত্র সম্পদ, মাথা গোঁজার ঠাঁই।

ঘরের মধ্যে মোনেম মুন্নার অজস্র স্মৃতির কোলাজ। দেয়ালে বড় বড় ফ্রেমে বাঁধানো মুন্নার খেলোয়াড়ি জীবনের ছবিগুলো টেনে নিয়ে যায় এ দেশের ফুটবল ইতিহাসের উজ্জ্বল এক অধ্যায়ে। আক্রান্ত হতে হয় নস্টালজিয়ায়। মুন্নার ফুটবল-জীবনের নানা গল্পের নীরব সাক্ষী এই স্মারকগুলো যেকোনো ফুটবলপ্রেমীর হৃদয়ে নাড়া দিতে বাধ্য।

সেই হিসাবে মুন্নার ফ্ল্যাটটা বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের একটা ছোটখাটো জাদুঘরই যেন। কী নেই সেখানে! জাতীয় দল কিংবা তার ক্লাব আবাহনীর হয়ে তোলা বিভিন্ন সময়ে ফ্রেমে বাঁধানো ছবিগুলোর কথাই ধরুন।

তার স্ত্রী ইয়াসমিন মোনেম জানালেন, বাংলাদেশের ফুটবলের সর্বকালের অন্যতম সেরা এই তারকার স্মারক জমিয়ে রাখার অভ্যাস ছিল। বিদেশের মাটিতে যেখানেই খেলতে যেতেন, প্রচুর ছবি তুলতেন। ঘরোয়া লিগেও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার ফটো সাংবাদিকদের কাছ থেকে জোগাড় করতেন নিজের ছবি। মুন্না সেই ছবিগুলো থেকেই বেশ কয়েকটি বড় করে বাঁধাতে দিয়েছিলেন মৃত্যুর কয়েক দিন আগে। সেই ছবিগুলো যখন দোকান থেকে তার ঘরে এল, তিনিই আর নেই। মৃত্যুর ডাক শুনতে পেয়েই হয়তো যাওয়ার আগে নিজের স্মৃতি সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখে যেতে চেয়েছিলেন। ফ্ল্যাটের দেয়ালে বাঁধাই করা সেই ছবিগুলো নিয়তই তার কথা বলে।

আবাহনী আর জাতীয় দলে খেলার স্মারক হিসেবে জমিয়েছিলেন বেশ কিছু জার্সি, সেগুলোও এখন স্মৃতিকাতরতার নাম। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে খেলতেন ব্রাদার্স ইউনিয়নে। ব্রাদার্সের সেই সময়কার একটা কমলা রঙের জার্সি আজও সযতনে রাখা আছে আলমারিতে। ১৯৮৬ সালের সিউল এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে খেলেন মুন্না। সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দিতে আলমারিতে ঝুলছে বুকে বাংলাদেশের পতাকা আঁকা সাদা রঙের একটি জার্সি।

১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ লাল দলে খেলেছিলেন যে জার্সিটি গায়ে, সেটিও আছে। ১৯৯০ সালের বেইজিং এশিয়ান গেমসে যে জার্সিটি পরে মুন্না প্রথম নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ দলকে কিংবা ১৯৮৭ সালে যে জার্সি পরে আবাহনীর হয়ে প্রথম খেলতে নামেন, সেই দুটি জার্সিও ন্যাপথালিনের সঙ্গে স্মৃতির সুরভি ছড়ায় আলমারিতে।

আবেগ আর ভালোবাসায় বাবার সব জার্সিগুলো আগলে রাখে আজমান সালিদ—প্রয়াত মুন্নার ‘এ’ লেভেল পড়ুয়া ছেলে। ইয়াসমিন মোনেম বললেন, ‘মুন্নার ফুটবলার জীবনের স্মৃতি তো আজমানই টিকিয়ে রেখেছে। আমি তো অনেক কিছু বুঝি না, তবে আজমান জিনিসগুলো তার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ মনে করে।’

খুব ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে আজমান। তার বাবা আসলে কী ছিলেন, কত বড় ফুটবলার ছিলেন, এত সব বোঝার বয়স তখন তার ছিল না। কিন্তু বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আজমানের মধ্যে বাবাকে নিয়ে উপলব্ধিটা তীব্র হচ্ছে। মাঝেমধ্যে বাবার খেলোয়াড়ি জীবনের কোনো একটা জার্সি পরে সে খেলার মাঠে যায়।

কৌতূহলী বন্ধুদের দেখিয়ে বলে, ‘দেখ্, এটা আমার বাবার জার্সি! তোরা পাওলো মালদিনির কথা বলিস; ফিগো, রোনালদো কিংবা মেসিদের কথা বলিস। আমার বাবাও এই জার্সি পরে, হাতে অধিনায়কের ব্যান্ড নিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশকে।’ মা ইয়াসমিন এই সব জার্সিতে ছেলেকে দেখে চমকে ওঠেন, ছেলেটার চেহারায় যে বাবার আদল।

মেয়ে ইউশরা মোনেম দানিয়ার কাছে বাবাই সবচেয়ে বড় হিরো। ইউশরা এখন দেশে নেই। মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের ছাত্রী মুন্না-তনয়াকে বাবার ফুটবলার সত্তার চাইতে তার ব্যক্তিত্বই বেশি টানত।

অসম্ভব ব্যক্তিত্ববান, চালচলনে সত্যিকারের ‘নায়ক’ বাবাকে খুব ছোটবেলায় হারিয়ে ফেলা দানিয়ার কাছে এখন বড় সম্পদ অ্যালবামের এই ছবিগুলোই। অ্যালবাম উল্টে সে প্রায়ই দেখে তার বাবাকে, অলক্ষ্যে চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে কষ্টের জল।

ইয়াসমিন কিংবা দানিয়া ও আজমান—এই তিনজনের যাপিত জীবনে মোনেম মুন্নার স্মৃতিগুলোই এখন বড় অবলম্বন।

স্মৃতিগুলো বেদনার, স্মৃতিগুলো আনন্দের আর সব সময়ই বাঙ্ময়! -প্রথম আলো
১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে