তাওসিফ মাইমুন : সরকারের দাবি মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্থানীয় উৎপাদন দিয়েই কোরবানির চাহিদা মেটানো যাবে। আমদানি করতে হবে না।
সরকারি তথ্যানুযায়ী, চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি থাকলেও জনসাধারণকে উচ্চমূল্যে মাংস কিনে খেতে হচ্ছে। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে দেশে গরুর মাংসের দাম ৪২ শতাংশের বেশি বেড়ে প্রতি কেজি ঠেকেছে প্রায় ৮০০ টাকায়। কোনোভাবে দামের লাগাম টানা যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় কয়েক মাস ধরে পশুখাদ্যের দাম বাড়তে থাকায় এবারের কোরবানিতে অস্বাভাবিক দামে কিনতে হবে গরু।
কয়েক বছর ধরেই সরকার দাবি করে আসছে, কোরবানির পশু উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ ও দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কিন্তু পশুখাদ্য, ওষুধসহ প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লে কোরবানির বাজারে বাড়ে পশুর দাম। প্রতিবারের মতো এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। এখনো কোরবানির বাকি দুই মাসেরও কম সময়। খাদ্যসহ অন্যান্য ব্যয় বাড়ায় ইতিমধ্যে খামারিদের মধ্যে দাম বৃদ্ধির আলোচনা শুরু হয়েছে। তারা নিজেদের মতো করেই পশুর বাড়তি দাম নির্ধারণ করতে শুরু করেছেন।
গত রবিবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আবদুর রহমান জানিয়েছেন, আসন্ন ঈদুল আজহায় পশু যাতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, সেই পরিকল্পনা করে এবার ১ কোটি ৩০ লাখ গবাদি পশুর জোগান নিশ্চিত করা হবে। তবে গত এক বছরে গবাদি পশু পালনে ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ খরচ বাড়ায় কোরবানির পশু বেশি দামে কিনতে হবে বলে জানান খামারিরা।
তারা বলছেন, গবাদি পশুর খামার গড়ে তোলা দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রতিবছর গো-খাদ্যের দাম নাগালের বাইরে যাচ্ছে। বিশেষ করে গত এক বছরের ব্যবধানে পশুখাদ্য, ভুসি, খড়, ঘাসসহ অন্যান্য খাদ্যের দাম বেড়েছে। সব মিলিয়ে গড়ে প্রতি গরুতে খরচ বেড়েছে অন্তত ৩০ শতাংশের বেশি।
গত আট বছরের বেশি সময় গরু পালন করেন বগুড়ার খামারি সিয়াম রাব্বানি। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, পশু পালন পেশা বড্ড চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে খামারিদের খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। শুধু গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত হিসাব করলে দেখা যায়, গো-খাদ্যের দাম গড়ে ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এর মধ্যে কর্মচারীর খরচ ছাড়া ফিডে ১৪ দশমিক ৮১, ভুসিতে বেড়েছে ৩৮, খড়ে ৬০, ঘাসে ৪২ এবং ধান, ভুট্টা ও গমমিশ্রিত খাবারের দাম বেড়েছে ২৭ শতাংশ।
পশু পালনের খরচ বৃদ্ধি নিয়ে এ খামারি আরও বলেন, হিসাব করে দেখা গেছে, গড়ে প্রতি গরুতে প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি খরচ বেড়েছে। তার প্রভাব বাজারেও আছে। তাদের মতো খামারিরা খরচের ওপর ভিত্তি করে গরুর দাম নির্ধারণ করেন বলে তিনি জানান।
একই এলাকার সাজিদুল হক নামের আরেক খামারিও দেশ রূপান্তরকে একই কথা জানান। তিনি বলেন, গত চার মাসে পশু পালনে যে হারে খরচ বেড়েছে, তাতে এবারের ঈদের বাজারে এর একটা প্রভাব দেখা যাবে। সরকার যতই বলুক উৎপাদন বেশি হয়েছে। গো-খাদ্যসহ আনুষঙ্গিক খরচ বাড়ায় আসন্ন কোরবানিতেও বাড়তি দামেই কোরবানির পশু কিনতে হবে সাধারণ মানুষকে।
এদিকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে প্রাণী উৎপাদন বেড়েছে ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ১ লাখ ৫৬ হাজার বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে গরু উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ৪৮ লাখ ৫৬ হাজার। একইভাবে ৮ হাজার বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মহিষ উৎপাদন হয়েছে ১৫ লাখ ১৬ হাজার, ৫৩ হাজার বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভেড়া উৎপাদন হয়েছে ৩৮ লাখ ২৭ হাজার ও ২ লাখের কিছু বেড়ে ছাগল উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ৬৯ লাখ ৪৩ হাজার।
সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত ৪ বছরে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ৪২ শতাংশ। অর্থাৎ, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে ৫৬০ টাকায়, যা ৩ বছরের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ২৪০ টাকা বেড়ে বর্তমানে (২০২৩-২৪ অর্থবছর) বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, পুরো বছরের মাংসের চাহিদার ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ শুধু কোরবানিতেই থাকে। এবারও অন্য বছরের তুলনায় উৎপাদন অনেক বেশি। তবু জনসাধারণের মনে কোরবানির পশুর দাম বাড়ার শঙ্কা থেকে যায়।
জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উৎপাদন বিভাগের পরিচালক ড. এ বি এম খালেদুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের যে উৎপাদন হচ্ছে, সেটি নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন হলো, প্রতি কেজিতে উৎপাদন খরচ কত হচ্ছে।’ অবশ্য খাবারের দামের সঙ্গে উৎপাদন ব্যয় বাড়ে এবং তাতে বাজারে অস্থিরতা হয় বলেও এই কর্মকর্তা দাবি করেন।
তিনি বলেন, উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে যতই প্রাপ্যতা থাকুক না কেন, মানুষ তার চাহিদা অনুযায়ী কিনতে পারে না। একটা সময় মানুষ শস্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল, সেখান থেকে তারা আমিষের দিকে আসছে। দাম বাড়ার কারণে মানুষ আবার আগের অবস্থাতেই ফিরে যাবে।
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রাণিজ খাদ্য নিয়ে কথা হয়। কারণ এগুলো আমাদের নিয়মিত টেবিলে থাকে। ডিম, ব্রয়লার মুরগি নিয়মিত খাদ্য। কিন্তু খামারিরা কিছুতেই এখন উৎপাদন খরচ কমাতে পারছেন না। শ্রমিকের খরচও বাড়ছে। খাদ্যপণ্যের দাম যখন বেশি থাকে, তখন মানুষ স্বাভাবিকভাবেই খাবার বাছাইয়ে সচেতন হবে।’ সূত্র : দেশ রুপান্তর