এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক: ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর র্যাবকে দিয়ে সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক কিলিং মিশন শুরু করে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার মানুষ ‘বন্দুকযুদ্ধে’র নামে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের পর রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দমনে র্যাবকে ব্যবহার শুরু করে সরকার। ক্রমে এর মাত্রা বাড়তে থাকে।
পরে ক্রসফায়ারের পাশাপাশি শুরু করা হয় গুম। গুম কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী জানিয়েছেন, গুম কমিশনে জমা পড়া এক হাজার ৬০০টি গুমের অভিযোগের মধ্যে ৩৮৩টি অভিযোগ যাচাই-বাছাই করছে কমিশন। এসব অভিযোগের মধ্যে র্যাবের বিরুদ্ধেই রয়েছে ১৭২টি। আর সিটিটিসির বিরুদ্ধে ৩৭টি, ডিবির বিরুদ্ধে ৫৫টি, ডিজিএফআইয়ের বিরুদ্ধে ২৬টি, পুলিশের বিরুদ্ধে ২৫টি এবং অন্য সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে ৬৮টি গুমের অভিযোগ রয়েছে।
এসব অভিযোগের ঘটনায় এরই মধ্যে গুম কমিশন জানতে পেরেছে গ্রেপ্তার সাবেক র্যাব কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান, পুলিশের এসপি মহিউদ্দিন ফারুকী, অতিরিক্ত এসপি আলেপ উদ্দিনসহ আরো অনেকের নাম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্রসফায়ার করতে অনেক পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তাকে রাজি করানো যেত না। এ নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অভ্যন্তরে এক ধরনের অসন্তোষ ছিল। ফলে ক্রসফায়ারের জন্য র্যাব ও ডিবিতে আলাদা টিম গঠন করা হয়। টিমটি অলিখিত হলেও ক্রসফায়ারে পারদর্শীদের আলাদা নামের তালিকা ছিল। কোথাও ক্রসফায়ারের প্রয়োজন হলে ডাক পড়ত ওই কর্মকর্তা ও সদস্যদের। এদের অনেকে বিপিএম, পিপিএম পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ক্রসফায়ারের প্রয়োজনে ডেকে পাঠানো হতো ঢাকার টিমকে। আর ক্রসফায়ারের পর সাজানো হতো একই গল্প—আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে সন্ত্রাসীদের ‘বন্দুকযুদ্ধ’।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছরে আন্তর্জাতিক মহলে ক্রসফায়ার বা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পর র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর ২০২১ সালে নিষেধাজ্ঞা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ক্রসফায়ার কখনো কোনো কিছুর সমাধান হতে পারে না। কেউ অপরাধী হলে তার বিচার হবে আদালতের মাধ্যমে। তাহলেই শৃঙ্খলা থাকবে। অবাধে ক্রসফায়ার করে হাত পাকানোর ফলে ছাত্রদের ওপর গুলি করতেও পুলিশের হাত কাঁপেনি।’
পুলিশের এই অবস্থা হলো কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে এ অবস্থাটা ছিল না। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেখেছি সরকারপ্রধানের প্রতি তোয়াজের রেওয়াজটা বেড়ে গেছে। অনেককে সালাম করতেও দেখেছি। যদি সবাই এভাবে নুয়ে পড়ে তাহলে তো সরকারও সেই সুযোগটা নেবে।’
পুলিশও অন্য পেশার মতো বেতনভুক্ত কর্মচারী উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তাকে কেন মানুষকে হত্যার মতো কাজ করতে হবে? হত্যা না করলে কি তার বেতন আটকে থাকবে?’
নূর মোহাম্মদের মতে, এবারের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের বেপরোয়া গুলি করার পেছনে গত ১৯-২০ বছরের গুলি করার অভ্যস্ততা কাজ করেছে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে ‘ক্রসফায়ার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’র নামে এক হাজার ৯২৬ জন মানুষ হত্যার শিকার হয়েছে।
আর পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে এক হাজার ১০১ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে কক্সবাজার জেলায়। এ সময়ে শুধু ওই জেলায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে ২০৬ জন।
কক্সবাজার জেলা ছাড়াও এ তালিকায় ওপরের দিকে থাকা অন্য জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, খুলনা ও যশোর। সারা দেশে বন্দুকযুদ্ধে মোট নিহতের ৬০ শতাংশ নিহত হয়েছে এ কয়েকটি জেলায়।