শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১২:০৭:৪১

সচিবালয়ে ভয়াবহ আগুন: এবার বেরিয়ে আসছে যেসকল দুর্বলতার তথ্য

সচিবালয়ে ভয়াবহ আগুন: এবার বেরিয়ে আসছে যেসকল দুর্বলতার তথ্য

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : ভয়াবহ আগুন লাগার পর প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র হিসাবে পরিচিত বাংলাদেশ সচিবালয়ের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে বেরিয়ে আসছে নানা দুর্বলতার তথ্য। আছে পদে পদে সমন্বয়হীনতার অভিযোগও। 

সচিবালয়ের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই উদ্বেগ জানিয়ে আসছেন দায়িত্বরত পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। চলতি বছরের প্রথমদিকেও পুলিশের পক্ষ থেকে একগুচ্ছ নিরাপত্তা নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু তা অদ্যাবধি বাস্তবায়ন হয়নি।

পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গেট পাশ ছাড়া ঢালাওভাবে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের প্রবেশ করতে না দেওয়া, অটোমেটিক ইলেকট্রিক গেট চালু করা, পর্যটন কর্তৃপক্ষের রেস্টুরেন্ট রেখে সাধারণ হোটেল-রেস্টুরেন্ট বন্ধ করা এবং সচিবালয়ের নিজস্ব পুলিশ ইউনিট গঠনসহ বেশকিছু প্রস্তাবনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু অদ্যাবধি তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।

যত্রতত্র দোকান
সচিবালয়ের অভ্যন্তরে একাধিক জায়গায় পান-সিগারেটের দোকান দেখা যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনসহ পুলিশের বিশেষ শাখার অনুসন্ধানের ভিত্তিতে এসব দোকান স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। রাজনৈতিক তদবিরে ব্যবসার সুযোগ দেওয়া হয়। এতে নামকাওয়াস্তে পুলিশ ভেরিফিকেশন হলেও সংশ্লিষ্টদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উঠে আসে না।

সূত্র বলছে, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট মালিক বা কর্মচারীদের নামে ইস্যুকৃত পাশ ঘোষণা ছাড়াই নিয়মিত হাতবদল হচ্ছে। এছাড়া সম্প্রতি অনলাইন ডেলিভারিম্যানরা গেটে এলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার পক্ষ থেকে লোক পাঠিয়ে তাদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেক সময় পুলিশের সামনেই তারা নিরাপত্তা তল্লাশি এড়িয়ে ভেতরে ঢুকে যান।

সূত্র জানায়, খোদ সচিবালয়ের ভেতরেই সরকারি গাড়ি থেকে তেল চুরির ব্যবস্থা চালু আছে। গাড়িচালকদের যোগসাজশে দীর্ঘদিন এ অনিয়ম চলে আসছে।

কিন্তু এর প্রতিকারে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি গাড়ি থেকে তেল নামিয়ে আবার সচিবালয়েই লুকিয়ে রাখা হয়। এছাড়া রাতে সচিবালয়ের অভ্যন্তরে অবস্থান নিষিদ্ধ হলেও হোটেল কর্মচারী পরিচয়ে অনেকেই সেখানে রাত্রিযাপন করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, রাতে অবৈধ অবস্থানের অভিযোগে ২০১৭ সালে অন্তত ১০ জন হোটেল কর্মচারীকে আটক করে পুলিশ। নিরাপত্তা পাশের মেয়াদ শেষ হলেও তারা নিয়মিত সচিবালয়ে অবস্থান করছিলেন। এ ঘটনায় সচিবালয় নিরাপত্তা বিভাগের পক্ষ থেকে মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী সমিতির হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি পুলিশ।

পাশবিহীন গাড়ি, সোজা ঢুকে যায় সচিবালয়ে
কর্মকর্তাদের আত্মীয়, ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিক পরিচয়ে প্রভাবশালীদের অনেকে যথাযথ পাশ ছাড়াই হরহামেশা গাড়ি নিয়ে সোজা সচিবালয়ে ঢুকে যান। এ সময় গাড়িতে তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা থাকলেও আরোহীদের প্রত্যেকের পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। প্রভাবশালীদের থামাতে গেলে বিপদ হতে পারে-এমন শঙ্কায় এসব নিয়ে কেউ তেমন উচ্চবাচ্য করেন না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সচিবালয়ের পাশ নিয়ে রীতিমতো তুঘলকি ব্যবস্থা চালু আছে। বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের অনেকে ইচ্ছেমতো পাশ ইস্যু করেন। অনেকে তাদের ব্যক্তিগত গাড়িচালক থেকে শুরু পরিবারের সদস্যদের নামে স্থায়ী পাশ দিয়ে রেখেছেন। এছাড়া এনজিওকর্মী, দালাল, তদবিরবাজ এবং ভুঁইফোঁড় গণমাধ্যমের নামেও পাশ ইস্যু করা হয়। এতে সচিবালয়ের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।

সিসি ক্যামেরা অচল, নেই নাইট ভিশন
সচিবালয়ের প্রধান ফটকসহ আশপাশের এলাকায় কয়েকশ সিসি ক্যামেরা রয়েছে। এমনকি প্রতিটি ভবনের প্রবেশমুখে রয়েছে একাধিক ক্যামেরা। কিন্তু এসব ক্যামেরার বেশিরভাগই অচল বা নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন। এছাড়া নিুমানের অনেক ক্যামেরায় নাইট ভিশন (রাতের দৃশ্য দেখার ব্যবস্থা) প্রোগ্রাম পর্যন্ত নেই। ফলে শো-পিসের মতো ক্যামেরা থাকলেও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এগুলোর তেমন কোনো ভূমিকা নেই।

সচিবালয়ে ঢোকার মুখে একটি ভবনের দোতলায় সিসি ক্যামেরা পর্যবেক্ষণের জন্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষ রয়েছে। সেখানে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন। বড় টেলিভিশন পর্দায় ক্যামেরা মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সেখানেও পর্যাপ্ত দায়িত্বশীলতা নেই বলে মনে করেন অনেকে।

সিসি ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে সচিবালয় নিরাপত্তা বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এককভাবে কোনো দায় নিতে নারাজ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার রাতে একটি গণমাধ্যমকে বলেন, শুধু ডিএমপি একা নয়, এখানে এসবি ও এপিবিএন সদস্যরা ক্যামেরা মনিটরিং করে। ফলে ব্যর্থতার দায় কোনো সংস্থার ওপর দায় চাপানো যাবে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বিগত সরকারের আমলে সচিবালয়ে সমন্বিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের জন্য একাধিক প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে ডিজিটাল প্রবেশপথ, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সিসি ক্যামেরা, অভিন্ন ডিজিটাল আইডি কার্ড এবং ইলেকট্রনিক পাশ প্রবর্তনের কথা বলা হয়। এ জন্য প্রকল্পের আওতায় কম্পিউটার থেকে শুরু করে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনাকাটা থেকে শুরু করে বিদেশ সফর সবই হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

সূত্র জানায়, সচিবালয়ের ভেতরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার, তদবির এমনকি সুবিধাজনক অফিস কক্ষের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়েও দলাদলি আছে। চেয়ারে বসেই প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের অনেকে ইচ্ছেমতো অফিস ডেকোরেশন করিয়ে নেন। এদের কেউ কেউ আরাম-আয়েশের জন্য যথেচ্ছ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, গরম পানির গিজার ও রুম হিটার স্থাপন করেন। এতে বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইনের ওপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ পড়ে। এগুলো অগ্নিকাণ্ডের উচ্চ ঝুঁকি তৈরি করে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সচিবালয়ের একাধিক ভবন অনেক পুরোনো। এমনকি বড় ধরনের ভূমিকম্প সহনশীল নয় বলেও বিশেষজ্ঞরা রিপোর্ট দিয়েছেন। অপরদিকে বৈদ্যুতিক লাইনগুলো অনেক ক্ষেত্রে আধুনিকায়ন করা হয়নি।

এ কারণে সচিবালয়ে নিয়মিত বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট হয়। ছোটখাটো আগুনের ঘটনাও ঘটে। এ জন্য পুরোনো বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো দরকার। কিন্তু এসব নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। সচিবালয়ে কর্মরত বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজনেরও দায়িত্ব পালনে গাফিলতি রয়েছে। এমনকি তাদের কেউ কেউ মূল দায়িত্ব ফেলে নানা ধরনের তদ্বিরে নিয়োজিত।

বছরজুড়ে চলে নির্মাণকাজ
সচিবালয়ের ভেতরে বছরজুড়েই নির্মাণকাজ চলে। বর্তমানে অন্তত ৩টি জায়গায় নির্মাণযজ্ঞ চলছে। ফলে নির্মাণসামগ্রী আনা-নেওয়াসহ সংশ্লিষ্টদের যাতায়াত নিত্যদিনের। এছাড়া সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার থেকে শুরু করে নির্মাণকর্মীদের অনেকে যথাযথ পাশ ছাড়াই কেবল মৌখিক অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন। এতে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।

সচিবালয়ের এমন দুর্বল নিরাপত্তা পরিস্থিতি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নগর বিশেষজ্ঞ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, সচিবালয় হচ্ছে বিশেষ গুরুতপূর্ণ স্থাপনা বা কেপিআই (কি-পয়েন্ট ইনস্টলেশন) এলাকা। অথচ আমি অবাক হয়েছি সেখানে কোনো স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা কার্যকর নেই। একটি ভবনে আগুন লেগে ১০ ঘণ্টা ধরে জ্বলতে থাকল। সচিবালয় হচ্ছে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়। যেখান থেকে আইন বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু সেখানকার অবস্থাই যদি এমন হয় তাহলে অন্যদেরকে কীভাবে জবাবদিহিতায় আনবেন।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবিলম্বে সেখানকার প্রতিটি ভবনে অগ্নি ঝুঁকি নিরূপণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন তাদের কয়েকজনকে এখনই বরখাস্ত করতে হবে। তা না হলে দায় নেওয়ার সংস্কৃতি তৈরি হবে না।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে