মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৫, ০৬:৪৭:১৬

আজ ঘুড়িওয়ালাদের দখলে থাকবে পুরান ঢাকার আকাশ

আজ ঘুড়িওয়ালাদের দখলে থাকবে পুরান ঢাকার আকাশ

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : পুরান ঢাকার আকাশ আজ ঘুড়িওয়ালাদের দখলে। নীল আকাশে শোভা পাচ্ছে নানা রঙ আর বাহারি ঘুড়ি। চলছে ঘুড়ি কাটাকাটি খেলা। ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসবের চিত্র এমনটাই থাকে পুরান ঢাকায়। একে ঘুড়ি উৎসব বা পৌষ সংক্রান্তিও বলে। একটা সময় এ উৎসবটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে পুরান ঢাকায় সাড়ম্বরে পালিত হয় দিনটি। তবে আগের মতো জৌলুশ নেই এবার সাকরাইন উৎসবে। 

মূলত, পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়া, ধূপখোলা, দয়াগঞ্জ, মুরগীটোলা, নারিন্দা, সূত্রাপুর, কাগজিটোলা, বাংলাবাজার, লক্ষ্মীবাজার, কলতাবাজার, ধোলাই খাল, শাঁখারীবাজার, রায়সাহেব বাজার, নবাবপুর, বংশাল, নাজিরাবাজার, তাঁতী বাজার, লালবাগ এবং হাজারীবাগ এলাকার মানুষ এ উৎসবে দিনব্যাপী ঘুড়ি ওড়ান। আয়োজন করেন নানা খাবারের। গত কয়েক বছর ধরে সন্ধ্যায় আতশবাজি ফোটানো, এ উৎসবের অন্যতম অনুসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছিল হালের ডিজে পার্টি। তবে এবারের চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। কারণ স্থানীয় পঞ্চায়েত ও মুুরুব্বিদের অনুরোধে এবার আর সেইরকম ডিজে পার্টি থাকছে না। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে সাকরাইন উৎসবে যোগ হয় হালের ডিজে পার্টি। মূলত, কিছুটা হৈ হুল্লোড় ও গান বাজনার জন্য এসব ডিজে পার্টির আয়োজন করা হতো। এসব কারণে পুরান ঢাকার লোকজন কিছুটা বিব্রতও বটে- এমনটাই অভিযোগ স্থানীয়দের ।

তাদের ভাষ্যমতে, তারা সাকরাইনের বিরুদ্ধে নয়। তাদের দাবি সাকরাইনের নামে যেন ছাদে ছাদে কোনো উচ্ছৃঙ্খলতা না হয়। তাছাড়া অনেক শিশু এবং বৃদ্ধ বা অসুস্থ ব্যক্তি রয়েছেন, যাদের জন্য এসব উচ্চস্বরে গান-বাজনা ও পটকা বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়ায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দুই-তিন ধরে মাইকের মাধ্যমে এসব কথাও তুলে ধরা হয়। জানানো হয়, উৎসবের নামে যে কোনো উচ্ছৃঙ্খলতা না হয়।

পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব কমে গেছে আগের তুলনায়। এখন নানা জটিলতায় তরুণরা সাকরাইন উৎসবে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এছাড়াও আধুনিক যুগের ডিজেপার্টি এবং আতশবাজির কারণে সাকরাইন ঘুড়ি উৎসব তার নিজস্ব ঐতিহ্য হারিয়েছে। এই ডিজে পার্টি সাকরাইন উৎসবের অন্যতম বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন তারা। এমনকি এই ডিজে পার্টিকে কেন্দ্র করে নানা নেতিবাচক ঘটনাও ঘটেছে গত কয়েক বছরে।

সাকরাইন উৎসবের দিনে সকাল থেকেই ছাদে ছাদে শুরু হয়ে যায় ঘুড়ি ওড়ানোর উন্মাদনা। ছোট-বড় সবার অংশগ্রহণে মুখরিত থাকে প্রতিটি ছাদ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে উৎসবের জৌলুস। আর আকাশে বাড়ে ঘুড়ির সংখ্যা। সকালের তুলনায় বিকালে এ উন্মাদনা পরিপূর্ণতা লাভ করে। ছাদের ওপর চলে গানবাজনা আর খাওয়া-দাওয়া। সে সঙ্গে আনন্দের উত্তাপকে আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দেয় ঘুড়ির কাটাকাটি খেলা।

এছাড়া ঘরে ঘরে তৈরি হয় পিঠা বানানোর ধুম। বর্তমানে এ উৎসবে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। সাকরাইনে পুরান ঢাকায় শ্বশুরবাড়ি থেকে জামাইদের নাটাই, বাহারি ঘুড়ি উপহার দেওয়া এবং পিঠার ডালা পাঠানো একটি অবশ্য পালনীয় রীতি। ডালা হিসেবে আসা ঘুড়ি, পিঠা আর অন্যান্য খাবার বিলি করা হয় আত্মীয়-স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে। তবে এ প্রচলন এখন খুব একটা দেখা যায় না। আরও জোর দিয়ে বলা যায়, এটা এখন নেই বললেই চলে। 

এ উৎসবকে মাথায় রেখে গত এক সপ্তাহ পুরান ঢাকার বায়ান্নো বাজার তেপ্পান্ন গলির অধিকাংশ বাড়ির খোলা ছাদে হয়েছে সুতা মাঞ্জা দেওয়ার ধুম। এ উৎসব উপলক্ষে শাঁখারীবাজার, নারিন্দা, ধোলাইখাল, ধূপখোলা, গেন্ডারিয়াসহ অলিগলিতে নানা রঙের ঘুড়ির পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। তবে আগের মতো বেচাকেনা নেই বলে জানান বিক্রেতারা।

সরেজমিনে গিয়ে পুরান ঢাকার দোকানগুলোতে নানা ধরনের ঘুড়ি দেখা যায়। তবে কমেছে বেচাকেনা। আগের মতো জৌলুস নেই ঘুড়ি বেচাকেনায়। পুরনো গৌরব হারিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়ায় পরিবর্তন এসেছে সাকরাইন উৎসবেও। 

শাঁখারি বাজারের ব্যবসায়ী হৃষীকেশ দাস বলেন, সাকরাইন উপলক্ষে আমাদের প্রতিবার ভালো বেচাকেনা হয়। তবে এবারের শুরুর দিকে একটু কম হলেও আজ বাজার জমে উঠেছে পুরোদমে। আমাদের কাছে ঘুড়ি, নাটাই সুতাসহ ঘর সাজানোর যাবতীয় সাজসজ্জা রয়েছে। এছাড়াও এবার বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রং ও আকৃতি সম্বলিত বিভিন্ন ঘুড়ি উঠেছে বাজারে।

পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা ও মৌসুমি ব্যাবসায়ি শাখাওয়াতের দোকান ঘুরে দেখা যায়, বাহারি রঙের ঘুড়ি, সুতা, ও নাটাইয়ের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন তিনি। তবে শেষ মুহূর্তে বেশ ভালো বেচাকেনা করতে দেখা যায় তাঁকে। তার দোকান ঘুরে দেখে যায়, সাকরাইন উৎসব উপলক্ষে নানান ধরনের ঘুড়ি নিয়ে এসেছেন। যার মধ্যে রয়েছে, ভোয়াদার, চক্ষুদার, দাবাদার, রুমালদার, চিলদার, রকেট, স্টার, গুরুদারসহ অসংখ্য ঘুড়ি। সর্বনিম্ন দাম পাঁচ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২৫০ টাকা দামের ঘুড়ি রয়েছে। একই সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের নাটাই, যার দাম সর্বনিম্ন ১০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা এবং সুতার দাম হাঁকানো হচ্ছে আকারভেদে ৫০ থেকে থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত।

আরেক বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম বলেন, এবার আগের মতো সাকরাইন হবে না। কিছুটা পরিবর্তন এসেছে আয়োজনে। সবকিছুর মতো সাকরাইন উৎসবেও ভাটা পড়েছে কিছুটা। তবে ঘুড়ি উৎসবে কোনো কমতি নেই আমাদের। 

তিনি আরও বলেন, সাকরাইন আমাদের বাপ-দাদাদের উৎসব। এইদিনে আমরা পরিবারের সবাই মিলে বাড়ির ছাদে ঘুড়ি উৎসব করি, রাতের বেলায় প্রতিটি বাড়ির ছাদে আতশবাজি, হরেকরকমের লাইটিং, ভালো খানাপিনাসহ গান-বাজনার আয়োজন করা হয়। কিন্তু এবার সাকরাইন উৎসবে অনেক কিছু হবে না। 

উল্লেখ্য, সাকরাইন বাংলাদেশের প্রাচীন উৎসবগুলোর একটি। এটি মূলত ঘুড়ি উৎসব। পৌষ মাসের শেষ দিন জানুয়ারির ১৪ অথবা ১৫ তারিখে এ উৎসব হয়ে থাকে। সাকরাইন মূলত পৌষ সংক্রান্তি ঘুড়ি উৎসব। সংস্কৃত শব্দ ‘সংক্রান্তি’ অপভ্রংশে সাকরাইন হয়েছে। যা এক পর্যায়ে ঢাকাইয়া উৎসবে রূপ নেয়।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে