শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ০৮:৪৫:২৩

আগের কয়েক বছরের রমজানের তুলনায় উল্টোচিত্র, খুশি ক্রেতার

আগের কয়েক বছরের রমজানের তুলনায় উল্টোচিত্র, খুশি ক্রেতার

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : দরজায় কড়া নাড়ছে পবিত্র মাহে রমজান। এরইমধ্যে শুরু হয়েছে রমজানের বিভিন্ন প্রস্তুতি। রোজাকেন্দ্রীক নিত্যপণ্যগুলো কিনতে বাজারে ভিড় করছেন ক্রেতারা। তবে বাজার করতে গিয়ে আগের কয়েক বছরের রমজানের তুলনায় কিছুটা উল্টোচিত্র দেখছেন তারা। আর তাতে খুশি ক্রেতারা। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখতে শুল্ককর কমানোসহ বেশ কিছু উদ্যোগের ফলে এবার ছোলা, খেজুর, বেসনের দাম বাড়েনি, বরং কিছুটা কমেছে।

শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর বাড্ডা-রামপুরা এলাকার একাধিক বাজার ঘুরে এবং ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এই চিত্র পাওয়া গেছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, বাজারে বুটের ডাল বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা কেজিতে। ছোলা ১১৫ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগেও ছিল ১২০-১২৫ টাকা, মুগডাল ১৭০ টাকা, চিনি ১২৫ টাকা। এছাড়া বুটের বেসন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, অ্যাংকরের বেসন বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। তবে কিছুটা দাম বেড়েছে চিড়া ও মুড়ির। বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট এখনও কাটেনি।

এক লাফে লেবুর পিস ২০ টাকা! 
এদিকে আজকের বাজারে খেজুরের দামেও কিছুটা স্বস্তি মিলছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে মেডজুল খেজুর বিক্রি হচ্ছে ১৪০০ থেকে ১৪৫০ টাকা কেজি (আকারভেদে), মরিয়ম ১১৮০ থেকে ১২৫০ টাকা, আজোয়া ১০৫০ টাকা, মাশারুক ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, সুগাই জাতের খেজুর ৯৫০ টাকা, ডাল খেজুর ৬৫০ টাকা। এছাড়া দাবাস খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৪৬০ থেকে ৪৮০ টাকা, জাহিদি ২০০ থেকে ২৬০ টাকা, বরই খেজুর প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪৮০ টাকা দরে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রমজানকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই সাধারণত ছোলা, মটর, চিনি, তেল, ডাল, খেজুরসহ বেশ কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়ে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে এসব পণ্যের দামও। এ সময় বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারিভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বাস্তবে দেখা যায়, রোজা এলেই যেন কিছু কিছু পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। প্রতিবারের মতো এবারও রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে শুল্ককর কমানোসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে এবার স্বাভাবিক পর্যায়েই আছে ছোলা ও খেজুরের দাম।

খেজুর-ছোলার দাম না বাড়ায় সন্তুষ্ট ক্রেতা
রামপুরা বাজার এলাকায় রোজার পণ্য নিয়ে কথা হয় বেসরকারি একটি আইটি কোম্পানিতে কর্মরত মওদুদ আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাসায় আমরা নিয়মিতই খেজুর খাই। যে কারণে রোজার মাস এলেই খেজুরের দাম নিয়ে বিপাকে পড়ে যেতে হয়। স্বাভাবিক সময়ে যে খেজুর কিনি ৬০০ টাকা কেজিতে, রোজার একমাস আগেই সেই খেজুরের দাম হয়ে যায় ১০০০ টাকা। কিন্তু এই রোজায় সেই চিত্রটা তেমন দেখছি না। যদিও গত কয়েকদিনে কেজিপ্রতি দাম ২০/৫০ টাকা করে বেড়েছে, তারপরও এখন পর্যন্ত আলহামদুলিল্লাহ, নিয়ন্ত্রণেই আছে।

তিনি বলেন, এবার সরকার রোজার আগেই কিছু পণ্যের শুল্ক মওকুফ করে একটা ভালো কাজ করেছে। এর ফলে ব্যবসায়ীরা দাম নিয়ে খুব বেশিকিছু করতে পারেনি। তবে খুচরা পর্যায়ে যতটুকু বাড়ছে, এটা স্থানীয় ব্যবসায়ী আর বাজার সিন্ডিকেট মিলে বাড়িয়েছে। আর বাজারে বেসন-ছোলা দেখলাম আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে।

মধ্যবাড্ডা ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকায় কথা হয় রফিকুল ইসলাম নামের আরেক ক্রেতার সঙ্গে। তিনি বলেন, এক দোকান থেকেই ১১৫ টাকা কেজিতে ছোলা, ১৫০ টাকায় বেসন নিয়েছি। তবে তেল নিতে দুইটা দোকান ঘুরেছি। দাম বাড়তে পারে এমন আশঙ্কায় খেজুর গত সপ্তাহেই কিনে ফেলেছিলাম, তবে আজকে এসে দেখি সে দামেই বিক্রি হচ্ছে। সবমিলিয়ে মনে হচ্ছে অন্যান্য বছরের মতো এবার খেজুর, ছোলা-বুট নিয়ে এতোটা নৈরাজ্য নেই।

পণ্যের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই, বলছেন ব্যবসায়ীরা
রমজানে যেসব নিত্যপণ্যের বাড়তি চাহিদা থাকে সেগুলোর সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, আগের মজুত পণ্যের সঙ্গে যোগ হয়েছে আমদানিপণ্যও। ফলে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, খেজুরসহ বাড়তি চাহিদার এসব পণ্যের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই।

খন্দকার ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কামরুল ইসলাম বলেন, ছোলা, বেসন, ডাল- এগুলোর দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই আছে। আমার কাছে ৯৫ টাকা থেকে শুরু করে মানভেদে ১২০ টাকা পর্যন্ত ছোলা আছে। এগুলো নিয়ে ক্রেতাদের কোনো অনীহা-অসন্তোষ নেই। গত একমাস আগেও ছোলার যে দাম ছিল, আজকেও আমরা সেই দামেই বিক্রি করছি। আশা করছি রোজার আগে দাম আর বাড়বে না।

তিনি বলেন, শুনেছি সরকার কিছু পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে, যে কারণে সামনের দিনে হয়তো দাম কমতেও পারে। তবে এখন পর্যন্ত পাইকারি বাজারে কমার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। যদি কমে কিনতে পারি তাহলে আমরাও কমে বিক্রি করতে পারব। আমরা সর্বোচ্চ কেজি প্রতি এক-দুই টাকা করে লাভ করি, এর বেশি লাভ করার চিন্তাও করা যায় না।

তেল সংকটের কথা উল্লেখ করে এই বিক্রেতা বলেন, বাজারে চাল, ডাল বা ছোলা-বুট নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যাটা হচ্ছে তেল নিয়ে। টাকা-পয়সা অগ্রিম দিয়েও আমরা তেল পাচ্ছি না। বলা হচ্ছে যে, আগামী ১ তারিখ থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, কিন্তু কতটুকু হয় সেটা বলা যাচ্ছে না। তেল না থাকায় দোকানের চার-পাঁচটা গ্যালারি অন্যান্য পণ্য দিয়ে সাজিয়ে রেখেছি।

খেজুরের দামে ওঠানামা, তারপরও স্বস্তি
মদীনা খেজুর অ্যান্ড মধু শপের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন বলেন, রোজা উপলক্ষ্যে খেজুরের দাম আহামরি বাড়েওনি, কমেওনি। জানুয়ারি মাসে খেজুরের দাম অনেকটা কমে এসেছিল, কিন্তু ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে আবারও অল্পস্বল্প করে বেড়েছে। জানুয়ারিতে কার্টন প্রতি খেজুরের দাম ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত কমে গিয়েছিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারির পর থেকে কিছুটা বেড়েছে। তবে এটা রোজার মাস উপলক্ষ্যে ওরকম বেড়েছে বলা যায় না।

তিনি বলেন, আগের দামের সঙ্গে মিলিয়ে হিসেব করলে দেখা যায়, মোটামুটি কমে আসার পর নতুন করে বাড়লেও এখন পর্যন্ত আগের সেই দামে যায়নি খেজুর। গত বছরেও আমরা যেই দামে বিক্রি করেছি, তার থেকে তুলনামূলক অনেকটাই কমে এবছর বিক্রি করতে পারছি।

নাসিরুদ্দিন বলেন, মরিয়ম খেজুর আমরা ৫ হাজার ৬০০ টাকায় কার্টন (৫ কেজি) কিনতাম। সেটি গত ডিসেম্বরেও ৬ হাজার টাকায় কিনেছি। সে মরিয়ম খেজুর এখন ৫ হাজার টাকায় কার্টন কেনা যাচ্ছে। গত কয়েকদিনে ১০০ থেকে ২০০ টাকা বেড়েছে শুনেছি। তবে যেহেতু আমি আগের দামে কিনেছি, যে কারণে বিক্রিও করছি আগের দাম অনুযায়ীই।

কয়েকদিনে দাম বাড়ার পেছনের কারণ প্রসঙ্গে এই ব্যবসায়ী বলেন, দাম অল্পস্বল্প যাই বেড়েছে, এটা পুরোটা বাজার সিন্ডিকেটের কারণে। এখন কেউ বলতে পারবে না আমদানি শুল্কের কারণে বেড়েছে। পাইকারি বাজারগুলোতে যদি সরকার কড়া মনিটরিং চালায়, তাহলে এই বাড়ার অংশটাও কমে আসবে।

চাহিদা অনুপাতে পর্যাপ্ত সরবরাহ, মজুত কেমন?
রমজান সামনে রেখে ছোলার আমদানি বাড়ায় চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে বেড়েছে সরবরাহ। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ছোলার চাহিদা বছরে ১ লাখ ৫০ হাজার টন। এর মধ্যে শুধু রমজান মাসে চাহিদা থাকে প্রায় এক লাখ টন। এই হিসাবে দেশে প্রতি বছর এক লাখ ৮০ হাজার থেকে দুই লাখ টন ছোলা আমদানি হয়। এদিকে ট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের গত সাড়ে সাত মাসে ছোলা আমদানি হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার ৩৭৯ টন। এর মধ্যে শুধু জানুয়ারি মাসে আমদানি হয়েছে এক ১৩ হাজার ৩০৪ টন। এর বাইরে চলতি মাসের (ফেব্রুয়ারি) ১৬ দিনে ছোলা আমদানি হয়েছে ৮২ হাজার ৭১৭ টন। সেই হিসাবে গত দেড় মাসে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে ছোলা আমদানি হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৯৬ হাজার টন, যা রমজানে ছোলার চাহিদার প্রায় দেড়গুণ।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে খেজুরের বার্ষিক চাহিদা ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টন। এর মধ্যে রমজানে খেজুরের চাহিদা থাকে ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টন। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে খেজুর আমদানির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের গত সাড়ে ৭ মাসে ৩৭ হাজার ৫৭০ টন খেজুর আমদানি হয়েছে। যার প্রায় ৮০ শতাংশ আমদানি হয়েছে গত দেড় মাসে। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে আমদানি হয়েছে ১৪ হাজার ৮৪৯ টন। আর ফেব্রুয়ারি মাসের গত ১৬ দিনে আমদানি হয়েছে ১৬ হাজার ৭৯৪ টন।

এদিকে পর্যাপ্ত সরবরাহ এবং মজুত থাকায় রোজাকে কেন্দ্র করে সামনের দিনে খেজুর, ছোলা-বুটসহ প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আর বাড়বে না বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে