বুধবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৩:০৮:৫৩

বিচারপতিরও কি গোপনীয়তার অধিকার নেই?

বিচারপতিরও কি গোপনীয়তার অধিকার নেই?

কামাল আহমেদ : সাংবাদিকতার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হচ্ছে আদালত সম্পর্কে কিছু লেখার আগে অন্তত দুটি বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা। এর একটি হচ্ছে আদালতের অবমাননা হয় এমন কিছু না বলা, আর অপরটি হচ্ছে কোনো বিচারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা না করা। আদালতকে বিতর্কিত করা এবং বিচারকে প্রভাবিত করা হলে আইনের শাসন বাধাগ্রস্ত হয়। আর আইনের শাসন ছাড়া কোনো জনগোষ্ঠীতেই শৃঙ্খলা বা নিয়মনীতি বলে কিছু থাকে না। কিন্তু এই আদালতকে ঘিরে সম্প্রতি যেসব খবরাখবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা নতুন করে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত এসব সংবাদের কেন্দ্রে রয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত—সুপ্রিম কোর্ট, প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের একজন বিদায়ী বিচারপতি।

যেসব মাধ্যমে আদালত এবং বিচারপতিদের নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ ও মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে যেমন আছে প্রথাগত মাধ্যম—সংবাদপত্র ও টেলিভিশন, তেমনই আছে অপ্রথাগত নয়া মাধ্যম—সামাজিক যোগাযোগের প্ল্যাটফর্ম ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ও ব্লগ। প্রথাগত মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশে সম্পাদকদের একটা ভূমিকা আছে। কিন্তু ফেসবুক-টুইটারে তার বালাই নেই। পত্রিকা এবং টেলিভিশনের খবর প্রকাশনা বা সম্প্রচারকেন্দ্র দেশের সীমানার মধ্যেই, অর্থাৎ সরকার এবং আদালতের নাগালের মধ্যে। কিন্তু ফেসবুক-টুইটার-ইউটিউবে মতামত প্রকাশ করা হচ্ছে দেশের ভেতরে-বাইরে নানা জায়গা থেকে, যাতে কারও কোনো একক নিয়ন্ত্রণ নেই।
এ মাসের শুরুতে মুম্বাইয়ে সংবাদপত্রশিল্পের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ বিষয়ে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব নিউজপেপারস অ্যান্ড নিউজ পাবলিশার্সের (ডব্লিউএএন-আইএফআরএ) এক সম্মেলনে প্রযুক্তির রূপান্তরের কারণে নয়া মাধ্যম বা নিউমিডিয়া সাংবাদিকতার জন্য যে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, তার অনেকগুলো দিক নিয়ে আলোচনা হলো। সেখানে অন্য অনেকের মধ্যে ওয়ার্ল্ড এডিটরস ফোরামের সভাপতি ব্রাজিলের মার্সেলো রিখ বললেন, সংবাদপত্রে কিছু ছাপার আগে সাংবাদিকদের সম্পাদকীয় নীতি বিবেচনায় নিতে হয়। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো খবর, ছবি বা মন্তব্য প্রকাশের সময় সে রকম কোনো সম্পাদকীয় নীতির বালাই নেই। সেখানে যে কেউ তাঁর ইচ্ছেমতো এই সিদ্ধান্ত নেন। কোনো ছবি বা মন্তব্য অন্য কারও জন্য মনঃপীড়ার কারণ হবে কি না, অথবা তাতে কারও মানহানি ঘটবে কি না, তাঁদের সেসব কিছু ভাবার অবকাশ কই।

আমাদের আদালত এবং বিচারপতিরাও যে এই নয়া মাধ্যমের আঁচড়মুক্ত নন, সম্প্রতি তা আবারও প্রমাণিত হলো। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে রাজনীতিকদের মানহানি হয়—এমন কিছু কেউ বলছেন কি না, তার ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর নজরদারি আছে ষোলো আনা। অনেককে জেলেও যেতে হয়েছে অথবা কেউ কেউ এখনো ফেরার রয়েছেন। তবে আদালত বা বিচারপতিদের অবমাননা হচ্ছে কি না, তার ওপর নজরদারির কোনো আলামত এখনো মেলেনি। আদালতের সেদিকে পা বাড়ানো সম্ভবত বাস্তবসম্মতও নয়।

প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের একজন বিদায়ী বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর মধ্যকার কথাবার্তা এবং চিঠিপত্রের লেনদেন নিয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন মাধ্যমে অনেকগুলো খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের চিঠি যেমন ছাপা হয়েছে, তেমনি প্রকাশিত হয়েছে তাঁদের কথোপকথনের রেকর্ডিং। প্রথম আলো অবশ্য অনুষ্ঠিত প্রকাশ্য শুনানির বাইরের বিষয়গুলো প্রকাশ থেকে বিরত থেকেছে। সর্বোচ্চ আদালতের এই দুজন বিচারপতির একান্ত আলোচনার বিষয়ে কিছু তথ্য প্রথমে প্রকাশিত হয় বাংলা দৈনিক জনকণ্ঠ-এর একটি উপসম্পাদকীয়তে।

পরে বিষয়টি নিয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়া, বিশেষত টিভি এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় চলে তুমুল বিতর্ক। জনকণ্ঠ-এ প্রকাশিত নিবন্ধের বিষয়ে আপিল বিভাগ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পত্রিকাটির সম্পাদক এবং নিবন্ধকার ও নির্বাহী সম্পাদকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে শুনানি করে তাঁদের দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দিয়েছেন। অবশ্য ওই দুজন সম্পাদক এখনো রায়ের কোনো লিখিত কপি পেয়েছেন বলে শুনিনি। ফলে তাঁদের দুজনকে সাজা দেওয়া হলেও আদালত মামলাটিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সময় কী কী প্রশ্নের নিষ্পত্তি করেছেন বা করেননি, তা এখনো আমাদের অজানা। একইভাবে জনকণ্ঠ-এর বিরুদ্ধে মামলাটি নিষ্পত্তির পর একাত্তর টেলিভিশনে এ বিষয়টি নিয়ে যেসব আলোচনা হয়েছে, সেগুলোতেও আদালতের অবমাননা হয়েছে কি না, আপিল বিভাগ তা যাচাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছেন।

মানবতাবিরোধী অপরাধ–বিষয়ক ট্রাইব্যুনালে সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আপিলের শুনানি বিষয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর ওই আলোচিত কথোপকথন ফাঁস হওয়ার বিষয়ে সব প্রশ্নের জবাব না মিলতেই তাঁদের দুজনের মধ্যকার চিঠি চালাচালির বিষয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় একাধিক খবর প্রকাশিত হয়েছে। এসব খবরের বিষয়ে আজ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের দপ্তর থেকে কোনো ব্যাখ্যা বা সংশোধনী আসেনি। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে প্রশাসনিক বিষয়ে একজন
বিদায়ী বিচারপতির মতভিন্নতার এসব তথ্য নজিরবিহীনভাবে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হতে থাকার পালায় সবচেয়ে নাটকীয় সংযোজন হচ্ছে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে লিখিত নালিশের ঘটনা। অবশ্য একে শুধু নালিশও আর বলা চলে না। কেননা, ওই নালিশি চিঠিতে প্রধান বিচারপতির অভিশংসন চাওয়া হয়েছে।

রাষ্ট্রপতির কাছে যেকোনো বিচারপতি চিঠি লিখতেই পারেন। কিন্তু সেই চিঠি গণমাধ্যমে প্রকাশের বিষয়টি কি কিছুটা রহস্যজনক নয়? রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে যেহেতু ওই চিঠি প্রকাশের কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই, সেহেতু প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে তা সংবাদপত্রের কাছে ফাঁস হলো কীভাবে। এ ধরনের প্রিভিলেজড কমিউনিকেশন (দায়িত্বশীল পদে আসীন ব্যক্তিদের মধ্যকার বার্তা বিনিময়) কেউ ইচ্ছা করে ফাঁস না করলে তা জনসমক্ষে আসা মোটেও স্বাভাবিক নয়। অবশ্য আদালতের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের (বিচারপতির ব্যক্তিগত সহকারী, মুদ্রাক্ষরিক, পত্রবাহক অথবা পিয়ন) মধ্যে কেউ এমন গুরুত্বপূর্ণ চিঠি ফাঁস করার ঝুঁকি নিয়েছেন কি না, তা আমরা জানি না।

তবে ধারণা করা যায় যে সে রকমটি হয়েছে কি না, তা রেজিস্ট্রার জেনারেলের দপ্তর তদন্ত করে দেখবে বা দেখছে। আরও ধারণা করা যায় যে চিঠিগুলো এমন কোনো সূত্র থেকে প্রকাশ করা হয়েছে যে সূত্র বা সূত্রগুলো এতই ক্ষমতাবান যে তিনি বা তাঁরা জানেন যে এ জন্য জবাবদিহি করার প্রশ্ন উঠবে না। সে কারণে ধরে নেওয়া যায় যে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর চিঠি কে, কীভাবে ফাঁস করলেন, সেসব প্রশ্নের উত্তর কখনোই হয়তো মিলবে না। তবে তাঁর এই চিঠি ফাঁস হওয়ার ঘটনা নিশ্চিতভাবেই আদালতের জন্য মর্যাদাহানিকর এবং এ ধরনের ঘটনার কোনো নজির শুধু বাংলাদেশেই নয়, অন্য কোনো দেশেও খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ।
জনকণ্ঠ-এর বিরুদ্ধে মামলার রায় যেদিন ঘোষিত হয়, সেদিন থেকেই ওই রায়ে যেসব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি সেগুলো নিয়ে আলোচনার কথা ভেবেছি। কিন্তু তারপর আদালতের বিভিন্ন প্রশাসনিক বিষয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর চিঠি চালাচালির বিবরণ যেভাবে একের পর এক সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে শুরু করে, তাতে শেষ দেখার জন্য অপেক্ষাই ভালো বলে মনে হয়েছিল। তবে রাষ্ট্রপতির কাছে লেখা তাঁর চিঠির পরিণতির বিষয়ে আমাদের কৌতূহল আপাতত মিটবে বলে মনে হয় না।

তবে যে উদ্বেগ নিয়ে এই লেখার অবতারণা, তা হলো ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রশ্ন। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আদালতের অন্য বিচারপতিদের সময়ে সময়ে একান্ত আলোচনা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এসব আলোচনা টেলিফোনেও হতে পারে, সামনাসামনিও হতে পারে। জনকণ্ঠ-এ যে কথোপকথনের কথা ছাপা হয়েছে, তার রেকর্ডিংয়ের সূত্র কী? ওই আলোচনা কি টেলিফোনে হয়েছিল? জনকণ্ঠ ওই কথোপকথনের রেকর্ডিং আদালতে বাজাতে চেয়েছিল, কিন্তু তার প্রয়োজন পড়েনি। টেলিভিশনে প্রচারিত খবরে যেভাবে কথোপকথন শোনানো হয়েছে, তাতে তা টেলিফোনের সংলাপ কি না, বোঝা যায়নি। তাহলে কি তাঁদের দুজনের সামনাসামনি আলোচনা কেউ রেকর্ডে ধারণ করেছেন? কে এমনটি করতে পারেন? তাহলে কি প্রধান বিচারপতির দপ্তর বা বাসভবন, যেখানে ওই আলোচনা হয়েছে, সেখানে আড়ি পাতা ছিল?

আর আলোচনা যদি টেলিফোনে হয়ে থাকে, তাহলে তো বুঝতে হবে প্রধান বিচারপতির টেলিফোনেও আড়ি পাতা হয়। এর আগে আমরা রাজনীতিক ও সাংবাদিকদের টেলিফোনের রেকর্ড শুনে জেনেছি যে সাধারণভাবে আমাদের অনেকেরই ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বালাই নেই। ওই কথোপকথনের রেকর্ডিং জনকণ্ঠ-এর হাতে আসায় তাঁরা তাঁদের সম্পাদকীয় বিবেচনায় তা প্রকাশ করেছেন। সে জন্য আদালত তাঁদের দোষী সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু ওই আড়ি পাতা রহস্যের তো কোনো সমাধান হলো না। বিচারপতিদের নিজেদের মধ্যকার আলোচনা বা কথোপকথনও তো প্রিভিলেজড কমিউনিকেশন। সেগুলো ফাঁস হওয়ার রহস্যের সমাধান না হলে ভবিষ্যতে আরও গুরুতর কোনো পরিস্থিতি যে তৈরি হবে না, তার নিশ্চয়তা কী? নানা অজানা কথা প্রকাশ হয়ে পড়ায় এখন যেসব সাংবিধানিক এবং নৈতিক বিতর্কের জন্ম হয়েছে, সেগুলোর কথা নাহয় আজ আলোচনা না-ই করলাম।-প্রথমআলো
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর পরামর্শক সম্পাদক।
২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে