সোমবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৫, ০৬:২১:২৫

এবার বিএনপির যে বার্তা সুযোগসন্ধানী, সুবিধাবাদী ও হাইব্রিড নেতাদের প্রতি

এবার বিএনপির যে বার্তা সুযোগসন্ধানী, সুবিধাবাদী ও হাইব্রিড নেতাদের প্রতি

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : বিএনপিতে দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় ও সুবিধাবাদী হাইব্রিড নেতাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অন্যদিকে বিগত সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা সুবিধাবাদীদের ষড়যন্ত্র-তত্ত্বে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। এমনকি দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ন্যূনতম মূল্যায়ন থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। এতে অসন্তোষ বাড়ছে দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে।

দুঃসময়ে মামলা-হামলার ভয়ে যারা নিজেদের গুটিয়ে রেখেছিলেন, তারা এখন খোলস পালটে নানা কর্মে লিপ্ত; আবির্ভাব ঘটছে হাইব্রিডদেরও। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান, এমনকি প্রশাসনিক দপ্তরে বিএনপির দাপুটে ‘হর্তাকর্তা’ হিসাবেও জাহির করছেন। এসব ব্যক্তির নানা কর্মকাণ্ডের দায় বিএনপির ওপর চাপছে। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দলের ওপর। 

এদিকে দলে দুঃসময়ে অনেক নেতাই বিদেশে চলে যান। ছিলেন আরাম-আয়েশে। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর দেশে ফিরে দলে ভিড়তে নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন। নিজেদের ‘নির্যাতিত’ নেতা প্রমাণে মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন কেউ কেউ।

এমনকি আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাদের অনেকই মনোনয়ন পেতে লবিং ও তদবিরে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। 

যদিও সুযোগসন্ধানী, সুবিধাবাদী ও হাইব্রিড নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমেছে দলটির কেন্দ্রে। এ বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাচ্ছে বিএনপি। অভিযোগ পেলেই তাৎক্ষণিকভাবে সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নিচ্ছে দলটি। 

অভিযুক্ত সুবিধাবাদীদের ‘বসন্তের কোকিল’ উল্লেখ করে তাদের থেকে সতর্ক থাকতে ইতোমধ্যে দলীয় নেতাকর্মীদের বার্তা দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তবে প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার ছত্রছায়ায় লবিং-তদবিরসহ অপরাধের পাল্লা ভারি করছেন তারা (সুবিধাবাদীরা)। 

এদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে উজ্জীবিত বিএনপি। কেন্দ্রসহ সারা দেশের দলীয় কার্যালয়গুলো নেতাকর্মীদের পদচারণায় মুখর। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দলীয় কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত আন্দোলন-সংগ্রামের ত্যাগী নেতারা। পিছিয়ে নেই সুবিধাবাদীরাও। আবার যারা আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন-তারাই এখন তৃণমূলের ত্যাগীদের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। দলীয় কার্যালয় ছাড়াও বিভিন্ন সড়কের অলিগলিতে এখন তাদের ব্যানার, পোস্টার শোভা পাচ্ছে। বিভিন্ন নেতার বাসাবাড়ি কিংবা অফিসে এসব নেতার পদচারণাও বাড়ছে। ভিড় করছেন বিভিন্ন লবিং-তদবির নিয়ে। 

অন্যদিকে দীর্ঘ ১৭ বছর যেসব নেতাকর্মী রাজপথে ছিলেন, মামলা-হামলায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন, পঙ্গুত্ববরণ করেছেন, এমনকি ঘরছাড়া হয়েছেন-তারা এখন কার্যত ‘অসহায়’।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৫ আগস্টের পর বিতর্কিত ব্যক্তি ও সুবিধাবাদীরা নানা কৌশলে বিএনপিতে সক্রিয় হচ্ছেন। থাকছেন মিছিল-মিটিংয়ের সামনের সারিতে। পাশাপাশি নানা সুবিধা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরও তারা দলে ভেড়াচ্ছেন। তাদের দিয়েই বিএনপির নাম ভাঙিয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে দলটির ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছেন। বিভিন্ন কমিটিতে তারা আওয়ামী লীগের দোসরদের সুযোগ করে দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রে এ নিয়ে দলটির ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের অনেকেই লিখিত অভিযোগও করছেন।

চলতি বছরের ১৪ জুন গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলা বিএনপির ৪১ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা করা হয়। ২৬ জুন ওই কমিটির ত্রুটি-বিচ্যুতির বিষয়ে অভিযোগ পড়ে দলটির কেন্দ্রীয় দপ্তরে। সেখানে আওয়ামী সংশ্লিষ্টতার ডিজিটাল রেকর্ডসহ পর্যাপ্ত তথ্য জমা দেওয়া হয়। অভিযোগে বলা হয়, উপজেলা কমিটির বেশির ভাগ সদস্য বিগত ১৬ বছর সরকারবিরোধী আন্দোলনে নিষ্ক্রিয় ছিল। ফ্যাসিস্ট সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছে। তারা এলাকায় সর্বমহলে বিতর্কিত। অভিযোগপত্রে এও বলা হয়, কালিয়াকৈর উপজেলা বিএনপির কমিটিতে আন্দোলন-সংগ্রামে ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতাকর্মীদের স্থান দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে স্থানীয় ত্যাগী নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ বিরাজ করছে। ত্যাগীরা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সরাসরি হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।

৪ অক্টোবর ময়মনসিংহের এক উপজেলা বিএনপির আহ্বায়কের বিরুদ্ধে নয়াপল্টনে অভিযোগ করেন মো. সাইদুর রহমান নামের বিএনপি নেতা। 

সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে যারা রাতে ভোট কাটার জন্য সহযোগিতা করেছে, সেসব দোসরকে নিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন ওই উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক। যারা আওয়ামী লীগের অবৈধ সংসদ-সদস্যকে ফুল দিয়ে বরণ করেছেন, তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করছেন। এতে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল যুগান্তরকে বলেন, আমরা মনে করি, এই শ্রেণিটা চিহ্নিত। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাহেবও এদের ব্যাপারে বারবার সতর্ক করেছেন। ব্যবস্থা নিয়ে দেখিয়েছেনও। অনেক পুরোনো নেতারও অনেক অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি কিন্তু সাংগঠনিক শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন। বিভিন্ন জায়গায় আমরা অভিযোগ পাচ্ছি। ছাঁকনি দিয়ে এসব আবর্জনা হিসাবে দূরে সরিয়ে দিতে হবে।

সম্প্রতি সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিতে দুই আওয়ামী লীগ নেতা পদ পেয়েছেন। এ নিয়ে এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হলে পরে ওই দুই নেতাকে বাদ দেওয়া হয়। কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার বড়কান্দা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক আব্দুল মান্নান মিয়াকে একই ওয়ার্ডে বিএনপির সভাপতি হিসাবে ঘোষণা করা হয়। চলতি বছরের প্রথমদিকে লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে বিএনপিদলীয় এক অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসাবে মঞ্চে আসন পেয়েছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও আলেকজান্ডার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শমীম আব্বাস সুমন। ওই নেতার ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলছেন, কিছুসংখ্যক সুবিধাভোগী ব্যক্তির কারণে হাইব্রিড দলের অনুপ্রবেশের সুযোগ খুঁজছে। এ বিষয়ে দলীয় কঠোর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের এক শীর্ষ নেতা বলেন, সংগঠন থেকে কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। যার জন্য তারা দলীয় কর্মসূচির বাইরে কোথাও যান না। তবে কিছু নেতা যারা বিগত দিনে দলের দুঃসময়ে কোথাও ছিলেন না, তারা এখন সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হয়েছেন। দলের নেতাদের শেলটারে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মী আগের মতোই ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। আর বিএনপির নেতাকর্মীরা আগের মতোই আর্থিক কষ্টে আছেন, মানবেতর জীবনে আছেন। ভোলা জেলা বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা জানান, পট পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের একটি অংশ ভোল পালটে এখন বিএনপি সেজেছে। তাদের দাপটে একসময় বিএনপি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত না। এখন তারাই আবার বিএনপি হয়ে দাপট দেখাচ্ছে। এরই মধ্যে দখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মও শুরু করেছে তারা। এতে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন দীর্ঘ ১৭ বছরের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা মামলা-হামলার শিকার স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ত্যাগী নেতাকর্মী।

বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরে অনেক বিএনপি নেতা দলের দুর্দিনে বিদেশে পাড়ি জমান। বিগত দেড় দশকে তাদের অনেকেই নিজেদের রাজনীতি থেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। বিদেশে পাড়ি জমালেও ভালো ছিলেন। কখনো দেশের কর্মীদের খোঁজখবর নেননি। ৫ আগস্টের পর তারা দেশে ফিরে নির্যাতিত নেতা হিসাবে জাহির করছেন। অনেকেই পদ-পদবি বাগিয়ে নিতে লবিং-তদবির শুরু করেছেন। উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো অবস্থা। অন্যদিকে যারা ১৭ বছর দলের জন্য রক্ত-মাংস পানি করেছেন, আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, স্বজন হারিয়েছেন, তাদের বঞ্চিত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন বিদেশ ফেরতদের কেউ কেউ।

রাজধানীর নয়াপল্টনে সুবিধাবাদীদের আনাগোনা বেড়েছে। অনেক ত্যাগী নেতাকর্মীর অভিযোগ, সুবিধাবাদীদের কারণে তারা মাঝেমধ্যে নয়াপল্টনে যেতে পারছেন না। এ কারণে দলের দায়িত্বশীল কেন্দ্রীয় অনেক নেতা বিরক্ত হচ্ছেন বলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে