রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৩:৪০:০৯

খাতুনগঞ্জে হঠাৎ ভোজ্য তেলের দাম কত হলো জানেন?

খাতুনগঞ্জে হঠাৎ ভোজ্য তেলের দাম কত হলো জানেন?

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : আমদানি বাড়লেও খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ভোজ্যতেলের দাম। বিশেষ করে খাদ্যপণ্য তৈরিতে সর্বাধিক ব্যবহৃত পাম অয়েলের দাম সরকার নির্ধারণ করে দিলেও তার কার্যকারিতা নেই।

গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম আট মাসে প্রায় সোয়া দুই লাখ টন পাম অয়েল আমদানি বেড়েছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দাম, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দাম বেড়েছে মণপ্রতি ৮৫০ টাকা।

জানা যায়, দেশে খাদ্যপণ্য হিসেবে বেকারি আইটেম, ফাস্টফুড, কসমেটিকস টয়লেট্রিজ সামগ্রী, ওষুধ ও পশুখাদ্য হিসেবে পাম অয়েলের ব্যবহার হয়। খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের কারখানায় ব্যবহারের জন্য পাম অয়েল সরাসরি আমদানি করে। তবে বেশিরভাগ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পাইকারি বাজারের মাধ্যমে আমদানিকারক থেকে সংগ্রহ করে কারখানায় পাম অয়েল ব্যবহার করেন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের (২০২৫ সালে) জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রথম আট মাসে পাম অয়েল আমদানি হয়েছে ১৮ লাখ ৯৮ হাজার ২২২ টন, যা গত বছরের (২০২৪ সাল) প্রথম আট মাসে আমদানি হয়েছিল ১৬ লাখ ৬৯ হাজার ৬০৪ টন। বছরের তুলনায় চলতি বছর দুই লাখ ২৮ হাজার ৬১৮ টন পাম অয়েল আমদানি বেশি হয়েছে।

এনবিআরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত আট মাসে দেশে সর্বোচ্চ পাম অয়েল আমদানিকারক টিকে গ্রুপ। বে-ফিশিং করপোরেশন লিমিটেড, শবনম ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ, সুপার অয়েল রিফাইনারি লিমিটেড ও সামুদা এডিবল অয়েল লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠান চারটির মাধ্যমে ৭ লাখ ১ হাজার ৯ টন পাম অয়েল আমদানি করে।

গত বছর এই সময়ে পাম অয়েলের বুকিং রেট ছিল ৯৫০ ডলারের মতো। এখন একই পাম অয়েলের বুকিং রেট ১১শ ডলারের কাছাকাছি। যে কারণে বাজারে দাম বেড়েছে।- খাতুনগঞ্জের আর এম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ

পাম অয়েলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমদানিকারক আবুল খায়ের গ্রুপের স্মাইল ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি আট মাসে ৫ লাখ ৫৯ হাজার ২৪২ টন পাম অয়েল আমদানি করেছে। তৃতীয় সর্বোচ্চ দুই লাখ ৫২ হাজার ৭৮৬ টন পাম অয়েল আমদানি করে সিটি গ্রুপের সিটি এডিবল অয়েল লিমিটেড এবং ভুট অয়েল রিফাইনার্স লিমিটেড।

একইভাবে এক লাখ ৭৯ হাজার ৯৯০ টন পাম অয়েল আমদানি করে তালিকার চতুর্থ স্থানে রয়েছে মেঘনা গ্রুপ। সোনারগাঁও সিডস ক্রাশিং মিলস লিমিটেডের নামে তারা এসব পাম অয়েল আমদানি করে।

২০২৪ সালে দেশের আলোচিত-সমালোচিত শিল্প গ্রুপ এস আলম গ্রুপ আমদানি তালিকায় থাকলেও ২০২৫ সালে তারা কোনো পাম অয়েল আমদানি করেনি। তবে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের বেয়াই মীর আবদুছ সালামের মালিকানাধীন মীর বনস্পতি প্রোডাক্টস চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ৩৫ হাজার ৯৯৯ টন পাম অয়েল আমদানি করেছে।

চলতি বছর এ খাতে নতুন করে বিনিয়োগে এসেছে চট্টগ্রামের আরেক শিল্প গ্রুপ সিকম গ্রুপ। সিকম গ্রুপ তাদের দুই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ ও রূপসা এডিবল অয়েল রিফাইনারি লিমিটেডের নামে ৪৫ হাজার ৭০২ টন পাম অয়েল আমদানি করেছে।

একই সঙ্গে প্রাণ গ্রুপ তাদের চারটি প্রতিষ্ঠান হবিগঞ্জ অ্যাগ্রো লিমিটেড, প্রাণ অ্যাগ্রো লিমিটেড, প্রাণ ফুড লিমিটেড ও প্রাণ ডেইরি লিমিটেডের নামে ১৫ হাজার ৯৫৬ টন পাম অয়েল আমদানি করে। প্রাণ পুরোটাই নিজেদের খাদ্যসামগ্রী উৎপাদনে ব্যবহার করে।

পাশপাশি আকিজ ব্রেকার্স লিমিটেড, বম্বে সুইটস অ্যান্ড কোম্পানি, কোকোলা ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড, ডাবর বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড, ইফাদ মাল্টি প্রোডাক্টস লিমিটেড, কাজী ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ম্যাথাডোর ফুড অ্যান্ড অ্যালাইড ইন্ডাস্ট্রিজ, নেসলে বাংলাদেশ পিএলসি, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড তাদের কারখানার প্রয়োজনীয় কাঁচামাল হিসেবে পাম অয়েল আমদানি করেছে।

সরকার দায়সারাভাবে কিছু কিছু পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে। কিন্তু তা কার্যকর হচ্ছে না। এসব নির্ধারিত দাম কার্যকরে সরকারি তদারককারী সংস্থাগুলোর কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ছে না।-ক্যাব চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন

দেশে ভোগ্যপণ্যের দ্বিতীয় বৃহৎ পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ। বড় আমদানিকারকরা ক্রুড পাম অয়েল আমদানি করে নিজেদের কারখানায় পরিশোধন করে বাজারে সরবরাহ দেন। এর মধ্যে টিকে, সিটি, আবুল খায়ের, মেঘনা, মীর গ্রুপ পাইকারি বাজারে পরিশোধিত পাম অয়েল বিক্রি করে। খাদ্যপণ্যসহ বিভিন্ন উৎপাদক প্রতিষ্ঠান নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে এসব পরিশোধিত পাম অয়েল খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজার থেকে সংগ্রহ করে। মণপ্রতি ডিও’র (ডেলিভারি অর্ডার) মাধ্যমে তারা এসব খোলা পাম অয়েল কেনেন।

মানছে না সরকার নির্ধারিত দাম
চলতি বছরের ১২ আগস্ট পাম তেলের দাম লিটারপ্রতি ১৯ টাকা কমিয়ে ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। এর আগে পাম তেলের দাম ছিল লিটারপ্রতি ১৬৯ টাকা। সরকার পাম অয়েলের দাম কমালেও পাইকারি বাজারে উল্টো চিত্র দেখা গেছে। সরকারিভাবে পাম অয়েলের দাম কমানোর পর থেকে খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে উল্টো বেড়েছে।

খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকার নির্ধারিত লিটারপ্রতি ১৫০ টাকা হিসেবে এক মণ (৩৭ দশমিক তিন দুই কেজি) পাম অয়েলের দাম হওয়ার কথা ছিল পাঁচ হাজার ৫৯৮ টাকা। গত মাসের ১২ আগস্ট যখন সরকার দাম নির্ধারণ করে তখন নির্ধারিত দামের কাছাকাছি ছিল বাজার। কিন্তু এক মাসের ব্যবধানে মণপ্রতি ৪০০-৪৫০ টাকা দাম বেড়েছে পাম অয়েলের। সবশেষ শনিবার খাতুনগঞ্জে টিকে, আবুল খায়ের, মীর, সিটি গ্রুপের পাম অয়েল মণপ্রতি ছয় হাজার ৪০ টাকা থেকে ছয় হাজার ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

তবে দাম বাড়ার বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক বুকিংমূল্য বেড়ে যাওয়াকে কারণ হিসেবে দেখছেন খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরা। খাতুনগঞ্জের আর এম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত বছর এই সময়ে পাম অয়েলের বুকিং রেট ছিল ৯৫০ ডলারের মতো। এখন একই পাম অয়েলের বুকিং রেট ১১শ ডলারের কাছাকাছি। যে কারণে বাজারে দাম বেড়েছে।’

সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে পাইকারি বাজারে পাম অয়েলের দাম বেশি হওয়ার বিষয়টি জানেন না বলে জানালেন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের ম্যানেজার জসিম উদ্দিন। তিনি খাতুনগঞ্জে গ্রুপটির তেলের ডিও কেনাবেচা তদারক করেন। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, তার চেয়ে খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে দাম কম থাকে। এখন পাম অয়েলের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত দামের পার্থক্যটা আমাকে পর্যালোচনা করে বলতে হবে।’

তবে সরকারিভাবে দাম নির্ধারণের বিষয়টি যথোপযুক্ত নয় দাবি করেন ভোক্তাদের সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, ‘সরকার দায়সারাভাবে কিছু কিছু পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে। কিন্তু তা কার্যকর হচ্ছে না। এসব নির্ধারিত দাম কার্যকরে সরকারি তদারককারী সংস্থাগুলোর কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ছে না।’

তিনি বলেন, ‘বাজারে গত বছরের চেয়ে এবছর বেশি পাম অয়েল আমদানি হয়েছে। কিন্তু দাম গত বছরের চেয়ে বেড়েছে। আবার সরকার পাম অয়েলের দাম লিটারপ্রতি ১৯ টাকা কমিয়ে ১৫০ টাকা করেছে। সে হিসেবে প্রতি মণ পরিশোধিত পাম অয়েল সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার ৬শ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। যখন দাম কমানো হয় তখন দাম কম ছিল। দাম কমানোর নির্দেশনা দেওয়ার পর এখন শোনা যাচ্ছে প্রতি মণ পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ছয় হাজার টাকার বেশিতে। তার মানে কমে যাওয়ার বদলে উল্টো বেড়েছে। এটি ভোক্তাদের সঙ্গে একধরনের প্রতারণা।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে