ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : এইত গেল শুক্রবার দেশের তরুণ সমাজের সবচেয়ে কাঙ্খিত প্রতিযোগিতাটি হয়ে গেল। যে কোনো প্রতিযোগিতায় হার জিত আছে এটা সবারই জানা। ফলে এই প্রতিযোগিতায় কে হেরেছে আর কে জিতেছে সেটা নিয়ে কোনো কথা নয়। আলোচনা-সমালোচনা ঝড় বইছে প্রতিযোগিতাটির স্বচ্ছতা নিয়ে।
আমরা জানি, প্রতিটি শিশুর মনেই দেশপ্রেম ও মানবসেবার স্বপ্ন লুকায়িত থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সেটা ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হতে থাকে। তাই শিশুকিশোরদের ‘ভবিষ্যতে কী হবে?’ প্রশ্ন করা হলেই শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগই উত্তর দিয়ে থাকে চিকিৎসক হয়ে দেশ ও মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে । এরপর হয়তো প্রকৌশলী, পাইলট ও শিক্ষক হবার স্বপ্নের কথা বলে। এই যে শতকরা ৯৯ ভাগ শিশুকিশোরের স্বপ্ন, সেটা কিন্তু মাতৃগর্ভ থেকেই নিয়ে আসেনি, কিংবা এমনিতেই জাগ্রত হয়নি। এর পেছনে আমাদের পরিবেশ ও বড়দের একটা প্রভাব রয়েছে। অবশ্য দেশ কিংবা মানবসেবার মতো ভাল স্বপ্ন দেখা দোষের কিছু নয়; কেননা, স্বপ্নই প্রতিটি মানুষকে বড় করে। পরবর্তীতে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করে।
থাক এসব কথা। এবার আসি মূল প্রসঙ্গে- গেল শুক্রবার অনুষ্ঠিত মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিস্তর অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। দু’দিন আগে থেকেই এ গুজব আকাশে-বাতাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল। মঙ্গলবার রাতে একই অভিযোগে মহাখালী ডিওএইচএস থেকে নগদ ৩৮ হাজার ও এক কোটি ২১ লাখ টাকার ১৩টি চেকসহ চারজনকে আটক করে র্যাব। শুক্রবার পরীক্ষার দিন আগারগাও থেকে ইউজিসির কর্মকর্তাসহ চারজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। পরীক্ষার পর মঙ্গলবার রংপুরে শিক্ষক-চিকিৎসকসহ সাতজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। এছাড়াও টেলিভিশনের খবরে দু-একজন ভর্তিচ্ছুর সাক্ষাৎকারেও তারা পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র পাওয়ার কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন।
যদিও সরকারের সংশ্লিষ্টরা প্রথম থেকেই তা অস্বীকার করে আসছেন।এমন কি অভিযোগটি আমলে না নিয়ে পরীক্ষার ফলাফলও ঘোষণা করা হয়েছে।এদিকে পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর গেল ক'দিন থেকে এ নিয়ে গণমাধ্যম বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে সমালোচনার ঝড়। শুধু তাই নয়, ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষা নেয়ার দাবিতে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমে আন্দোলন করে আসছে। তারা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ-সমাবেশ ও মানবন্ধন করে আসছে। ভর্তি ফলাফল বাতিলে তারা সরকারকে আল্টিমেটামও দিয়েছে। দেশের শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্নমহল থেকেও পরীক্ষার ফলাফল বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষার দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্টরা কোনোভাবেই এসব আমলে নেয়নি। তারা এই বিতর্কিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করার চেষ্টা করছে।
তবে এই পরীক্ষা নিয়ে সরকার যাই দাবি করুক না কেন, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগটি একেবারেই অমূলক নয়। কেননা, এই অভিযোগে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনকে প্রমাণাদিসহ আটক করেছে। তারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায়ও স্বীকার করেছে। এছাড়া প্রশ্নপত্র যে ফাঁস হয়েছে তা প্রমাণের জন্য একজন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর টেলিভিশন সাক্ষাৎকারই যথেষ্ট হয় যদি তা আমলে নেয়া হয়।
প্রসঙ্গত, এবার আমারও দুইজন নিকটাত্মীয় মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। কিন্তু ফলাফলে তাদের চান্স হয়নি। এতে গেল ২-৩দিন ধরে তাদের পরিবারে চলছে এক অন্যরকম শোক। খোঁজ নিয়ে যা জানতে পেলাম তাতে, আমার ওই দুই নিকটাত্মীয়া পরীক্ষার্থী চান্স না পেয়ে গেল তিন দিন ধরে খানাপিনা বন্ধ করে দিয়েছেন। তাদের ভাষ্য মতে, তারা পরীক্ষা খারাপ দেয়নি, প্রশ্নের ৭৫ থেকে ৮০ ভাগ উত্তর দিয়েছে। তারা খুবই আশাবাদী ছিল। ছোটকাল থেকেই তাদের মেধাবী হিসেবেই সবাই জানত। এসএসসি ও এএইচসিতেও তারা গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়ে পাস করেছে। তাদের অভিযোগ একটাই, প্রশ্নপত্র ফাঁস না হলে তারা চান্স পেতেন। একথা শুধু আমার নিকটাত্মীয়ারই নয়, অনেক পরীক্ষায় অংশ নেয়া ভতিচ্ছুরই।
ফলে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের এ অভিযোগ একেবারেই অমূলক নয়। কিন্তু এরপরও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে যে ভুমিকা নেয়া হয়েছে তাতে আমাদের উচ্চশিক্ষার তথা মেডিকেল শিক্ষার ভবিষ্যত্ নিয়ে উত্কণ্ঠিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। উন্নত বিশ্বে স্কুল পার হয়ে তরুণ-তরুণীরা যে পেশায় যাবে সেই ধারায় শিক্ষা নেয় অধিকাংশই। উচ্চশিক্ষা খুবই প্রতিযোগিতামূলক। আমাদের দেশে বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে জনপ্রিয় করে তুললে শুধু মেডিকেল তথা সাধারণ উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হাহাকার থাকত না, এ ধরনের প্রশ্নফাঁসের ঘটনাও হয়তো ঘটতো না। দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো হতো।
দুঃখ হয় সেসব শিক্ষার্থীর জন্য, যারা মেডিকেলে পড়ার স্বপ্ন বুনে আসছিল। এই স্বপ্নভঙ্গের দায় শুধু তাদের নয়, দেশের শিক্ষা পদ্ধতি, নীতিনির্ধারক এবং অভিভাবকসহ সবার। তাই সামগ্রিকভাবে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনার প্রয়োজন। এ কাজ পারস্পরিক দোষারোপে নয়, বরং সকল মস্তিষ্ক ও প্রজ্ঞা একত্রিত করে চিন্তা করার বিষয়।
কেননা, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগটি নতুন নয়, গেল কয়েক বছরে এমন কোনো পরীক্ষা নেই যেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। প্রাথমিক সমাপনী থেকে শুরু করে সব পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, বিগত কয়েক সব ধরনের নিয়োগ পরীক্ষা, এমন কী বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছে। কিন্তু বরাবরই সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগটি আমলে নেয়া হয়নি, সেই সাথে এর প্রতিকারে আশাপদ কোন পদক্ষেপও লক্ষ্য করা যায়নি।
সেইসাথে চাকরিক্ষেত্রে বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। এই বৈষম্য এখন প্রকট ।সাম্প্রতিককালে অধিকমাত্রায় সর্বক্ষেত্রে রাজনীতিকরণের ফলে চাকরিক্ষেত্রেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বিসিএস পরীক্ষাও দলীয়করণ হয়েছে। যা সরকারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টার বক্তব্যই তা প্রমাণ করে ‘লিখিত পরীক্ষা ভাল করে এসো, বাকীটুকু আমরা দেখবো’।
বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (বিপিএসসি) অধীনে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পর ক্যাডারে পর্যাপ্ত শূন্যপদ না থাকায় নন-ক্যাডারে উত্তীর্ণ দেখানো হলেও নিয়োগ পাচ্ছেন না চাকরি প্রার্থীরা। উত্তীর্ণ এসব প্রার্থীর অধিকাংশই চাকরির জন্য ওয়েটিং লিস্টে থেকে হারাচ্ছেন চাকরির বয়স। এ ছাড়া এক বিসিএসে উত্তীর্ণ নন-ক্যাডাররা নিয়োগের জন্য ‘অবৈধ’ হয়ে যান পরবর্তী বিসিএসের ফল প্রকাশের পরই।
এতে বর্তমানে লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত মেধাবী তরুণ বেকার মানবেতর জীবন যাপন করছে। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান এবং সম্ভবত তা বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। আর এর পিছনে আমাদের প্রচলিত শিক্ষা-ব্যবস্থার অবদান মোটেই কম নয়। কেননা, 'পশ্চিমা বিশ্ব যখন প্রযুক্তিদক্ষ জনশক্তি তৈরি করছে আমরা তখন তৈরি করছি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত বেকার। এ সংখ্যাটা একেবারেই কম নয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করে বেকারত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ৩০ লাখ তরুণ। জীবনের চরম বাস্তবতা তাদের পিছু ছাড়ছে না। মুহূর্তে তাড়া করছে চাকরি না পাওয়ার হতাশা। এই হতাশার কারণে ঈদে কিংবা অন্য কোনো জাতীয় দিবসেও আমাদের তরুণদের মাঝে নেই কোনো আনন্দ--উচ্ছ্বাস ।
আইএলও, বিশ্বব্যাংক, উন্নয়ন গবেষণাসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনেও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিতের প্রায় অর্ধেকই বেকার এমন তথ্য উঠে এসেছে। ইকোনমিস্ট-এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার বলে জানানো হয়। ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক দশকে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়লেও শিক্ষার গুণগত মান বাড়েনি। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে।
কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিকরণ এবং পরীক্ষার ফল নিয়ে রাজনীতিকরণ তরুণদের কমজোর করে দিয়েছে। এই যে তারুণ্যের স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে, এর দায় কার? রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজ এর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পাড়ে না।
অথচ আমরা সবাই জানি ‘তরুণরাই যে কোনো জাতির উন্নয়নের চাবিকাঠি',। আজকের তরুণরাই দেশ ও জাতীর ভবিষ্যৎ। কাজেই তরুণদের চিন্তাভাবনা, আশা-আকাঙ্খা ও তাদের উদ্যম এবং মেধা নান্দনিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ সমাজের মেধা, শক্তি, সাহস ও প্রতিভাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় একটি জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি তথা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতি। কিন্তু আমাদের খুবই দুর্ভাগ্য, এই তরুণ সমাজকে ক্রমেই হতাশার সাগরে ডুবিয়ে দেয়া হচ্ছে। জাতিকে ধ্বংস করার মত এর চেয়ে আর কি প্রক্রিয়া হতে পারে!
নিবন্ধে এত কিছু উল্লেখ করেছি বলেই আমি হতাশাদের দলে নই। তাই তরুণেদর উদ্দেশ্যে বলবো- ঘুম থেকে জাগতে হবে, নতুন দিনের শুভ সুচনা করতে হবে। আর কতকাল আমরা অসৎ পরায়ন রাজনীতিবিদের উপর নির্ভর করে থাকব? উজ্জীবিত শক্তি ছাড়া কোনো জাতিই অগ্রসর হতে পারে না। দুর্বার গতিতে বিশ্বকে জয় করাই তারুণ্যের ব্রত। তারুণ্য পরিবর্তনকামী। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতে থাকে যেন। জয়ের স্বপ্ন-অভয়কে প্রশ্রয় দেয়ায় যেন তারুণ্যের সার্থকতা।
সবশেষে, তাই নজরুলের ভাষায় বলতে চাই- পথ-পার্শ্বের ধর্ম-অট্টালিকা আজ পড় পড় হইয়াছে, তাহাকে ভাঙিয়া ফেলিয়া দেওয়াই আমাদের ধর্ম, ঐ জীর্ণ অট্টালিকা চাপা পড়িয়া বহু মানবের মৃত্যুর কারণ হইতে পারে। যে-ঘর আমাদের আশ্রয় দান করিয়াছে, তাহা যদি সংস্কারাতীত হইয়া আমাদেরই মাথায় পড়িবার উপক্রম করে, তাহাকে ভাঙিয়া নতুন করিয়া গড়িবার দুঃসাহস আছে একা তরুণেরই। তাই হে তরুণ সমাজ জেগে উঠ, বিজয় তোমাদের হবেই হবে।
লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক এবং কলাম লেখক। ই-মেইল:[email protected]