বুধবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০২:৪৩:৪১

বৈষম্যে হতাশা বাড়ছে নন ক্যাডার চাকরিপ্রার্থীদের

বৈষম্যে হতাশা বাড়ছে নন ক্যাডার চাকরিপ্রার্থীদের

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : চাকরিক্ষেত্রে বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। সব ধরনের চাকরিক্ষেত্রেই এই বৈষম্য এখন ।সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে অধিকমাত্রায় সর্বক্ষেত্রে রাজনীতিকরণের ফলে চাকরিক্ষেত্রেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।যতদূর জানা যায়, বিগত বিসিএসগুলোয় কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে শূন্যপদ পূরণের জন্য প্রার্থী নিয়োগ দেয়া হতো মেধা কোটা থেকে। এমনকি বিসিএসে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত পদসংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি পদে মেধা কোটা থেকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল ।কিন্তু ৩৩ ও ৩৪তম বিসিএসের ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটেছে।

এ প্রেক্ষিতে ৩৪তম বিসিএসের ফল পুনর্মূল্যায়ন এবং মেধা ও প্রাধিকার কোটার ফল আলাদাভাবে প্রকাশের দাবি জানিয়ে আন্দোলন করে আসছেন ক্যাডারবঞ্চিতরা। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত মানববন্ধন ও সমাবেশ থেকেও এ দাবি জানিয়েছে চাকরি প্রার্থীরা।

তাদের অভিযোগ, ৩৪তম বিসিএসে পদ খালি থাকলেও যোগ্য প্রার্থীদের নন-ক্যাডার তালিকায় রেখে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। সাধারণ মেধা কোটার বাইরে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ও অন্যান্য কোটার প্রার্থীরাও এ বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।

৩৪তম বিসিএস ক্যাডারবঞ্চিতরা বর্তমানে সারা দেশে ছয় দফা দাবিতে আন্দোলন করছেন। দাবিতে উল্লিখিত দফাগুলো হলো— উত্তীর্ণদের দিয়ে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ৪০৪টি শূন্যপদ পূরণ, গত বছরের মতো একই পদ্ধতিতে ৩৪তম বিসিএসের ফলাফল প্রকাশ, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য বিসিএসের চূড়ান্ত কোটাভিত্তিক ফলাফল আলাদাভাবে প্রকাশ, উত্তীর্ণদের বিবেচনায় বৈষম্য দূরীকরণ, ভবিষ্যতে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের স্বচ্ছতা নিশ্চিত ও বৈষম্য দূরীকরণের জন্য মেধার ভিত্তিতে তালিকা প্রকাশ এবং প্রথম প্রকাশিত ফল বাতিল ঘোষণা।

চাকরিপ্রার্থীদের সাথে কথা বলে যা জানতে পেলাম তাতে, এসব দাবী আদায়ে তারা দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলন করে আসলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া নেই।

এদিকে চাকুরির দাবিতে ৩৩তম বিসিএসের দ্বিতীয় শ্রেনীর নন-ক্যাডার পদে আবেদনকারি প্রার্থীরাও আন্দোলন করছেন। এ নিয়ে তারা একাধিকবার রাজধানীর আগারগাঁওস্থ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সামনে ‘৩৩তম বিসিএস নন ক্যাডার গ্রুপে’র ব্যানারে এ মানববন্ধন করেন  করেন। এক্ষেত্রে তারা জানান, প্রধান মন্ত্রীর নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও ৩৩তম বিসিএসের নন ক্যাডারদের ১ম ও ২য় শ্রেণীর চাকুরীতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। দ্বিতীয় শ্রেনীর পদের জন্য দুই হাজার ৯০৬ জন প্রার্থী আবেদন করেছেন।

এছাড়া এব্যাপারে জানা যায়,  সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে বর্তমানে হাজার হাজার দ্বিতীয় শ্রেণীর পদ খালি রয়েছে। অথচ বিসিএসের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ন হওয়ার পরও নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না চাকরিপ্রার্থীদের । নন ক্যাডারদের চাকরিতে নিয়োগ না দিয়েই তথা  পিএসসি বিসিএস থেকে না নিয়ে নতুন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দানের চেষ্টা করা হচ্ছে। চাকরি প্রার্থীরা জানান, পিএসসির চেয়ারম্যান বরাবর ইতোপূর্বে তারা একাধিকবার স্মারকলিপি দিলেওএখনও তেমন কোনো আশার বাণী শুনতে পায়নি তারা। দ্রুত নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহন না করলে বৃহত্তর কর্মসূচি দেয়ার হুমকিও দিয়ে আসছে তারা।

খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (বিপিএসসি) অধীনে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পর ক্যাডারে পর্যাপ্ত শূন্যপদ না থাকায় নন-ক্যাডারে উত্তীর্ণ দেখানো হয় চাকরি প্রার্থীদের। পরে শূন্যপদ অনুযায়ী এসব প্রার্থীকে নন-ক্যাডার প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু চাকরির অপেক্ষায় থাকা উত্তীর্ণ এসব প্রার্থীর অধিকাংশই চাকরির জন্য ওয়েটিং লিস্টে থেকে হারান চাকরির বয়স। এ ছাড়া এক বিসিএসে উত্তীর্ণ নন-ক্যাডাররা নিয়োগের জন্য ‘অবৈধ’ হয়ে যান পরবর্তী বিসিএসের ফল প্রকাশের পরই। কারণ তখন নতুন উত্তীর্ণ প্রার্থীদের দেখানো হয় নন-ক্যাডার হিসেবে। আর চাপা পড়ে যায় আগের উত্তীর্ণরা।
পদ স্বল্পতার কারণে ক্যাডার পদে সুপারিশপ্রাপ্ত নন এমন প্রার্থীদের নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের ঘোষণা দেয় সরকার। এ লক্ষ্যে ২০১০ সালের ১০ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ‘নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্য (বিশেষ) বিধিমালা ২০১০’ জারি করে। ২৮তম বিসিএস পরীক্ষা থেকে এ বিধিমালা কার্যকর হয়।

এ ছাড়া ২০১৪ সালে আরেক বিধিমালার মাধ্যমে নন-ক্যাডারদের দ্বিতীয় শ্রেণিতে নিয়োগের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ৩৩তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয় ২১ নভেম্বর ২০১৩। পদ স্বল্পতার কারণে এতে নন-ক্যাডার হিসেবে উত্তীর্ণ ঘোষণা করা হয় ৭ হাজার ৪৬২ জন প্রার্থীকে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন এদের মধ্যে পাঁচ ধাপে প্রায় সাত শতাধিক চাকরিপ্রার্থীকে নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু বৃহৎ অংশই এখন পর্যন্ত নিয়োগ পাননি। তাদের অনেকেই চাকরির বয়সও হারিয়ে ফেলেছেন। এরই মধ্যে ৩৪তম বিসিএসের ফল ঘোষণা করা হয়। তাই এর পরে আর ৩৩ এর নন-ক্যাডারে উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থীরা চাকরি পাবেন না। এসব প্রার্থী চাকরি না পেয়ে হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন। নন-ক্যাডারে উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থীদের অভিযোগ, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রায় ১৯ হাজার চাকরির শূন্যপদ রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি মাধ্যমিক স্কুলগুলোতেও প্রায় দুই হাজার সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। এসব শূন্যপদের ৫০ শতাংশ নন-ক্যাডার থেকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু এসব নিয়োগের কোনো প্রক্রিয়া দৃশ্যমান নয়।

 নন-ক্যাডারে উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থী এক  বলেন, দ্বিতীয় শ্রেণির সব পদে বিপিএসসির বিধান অনুযায়ী ৫০ শতাংশ নন-ক্যাডার হতে নিয়োগ দিলে অনেকেই বেকারত্বের গ্লানি থেকে মুক্তি পেত । ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে বিপিএসসি চেয়ারম্যানের কাছে কয়েক দফা স্মারকলিপিও দিলেও কোন কাজ হয়নি।   বাংলাদেশ কর্মকমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যানের ভাষ্য, বিসিএসে উত্তীর্ণদের যদি সবার চাকরি নিশ্চিত হয় তবে  তিনি বেশি খুশি হবেন। কিন্তু পর্যাপ্ত পদ না থাকায় নন-ক্যাডারে রেখে দেওয়া হয়। এদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রথম শ্রেণির নন-ক্যাডার ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে নিয়োগ দেওয়ার বিধি কার্যকর করা হয়। কিন্তু সরকার ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে শূন্যপদের তালিকা দিলে এসব চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে থেকে সুপারিশ করতে পারে পিএসসি। পর্যাপ্ত শূন্যপদ না থাকায় তাদের সবাইকে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয় না। এটি শূন্য পদের ওপর নির্ভর করে। সংশ্লিষ্ট বিভাগ জনবলের চাহিদা দিলে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। অনেক ক্ষেত্রে শূন্য পদের চাহিদা চেয়ে চিঠি দেয় পিএসসি।

এছাড়া সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে অনগ্রসর ৫৬ শতাংশ কোটা (মুক্তিযোদ্ধা, নারী, জেলা, উপজাতি ও প্রতিবন্ধী) মেধাকে শেষ করে দিচ্ছে। দুর্নীতি, দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, প্রশ্ন ফাঁস ও পরীক্ষা পদ্ধতির অবস্থাপনাও মেধা ধ্বংসে কম দায়ী নয়। এতে সরকারের আমলাতন্ত্র এবং এমনকি নামিদামি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও ক্রমেই মেধাহীন হয়ে পড়ছে। দেখা গেছে, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় বিশেষ সুবিধা দেয়ার পরও যোগ্যপ্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না বলে পূরণ হয় না প্রাধিকার কোটা। ফলে কোটায় নিয়োগ আরও উদারীকরণ করে এখন বিশেষ নিয়োগ দিচ্ছে বর্তমান সরকার। বিসিএস ও প্রথম শ্রেণীর চাকরির নিয়োগে ৫০ শতাংশ কিংবা তার কম নম্বর পেয়েও অনায়াসেই কোটায় চাকরি মিলছে। অথচ ৬০ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েও মেধাবীরা চাকরি পাচ্ছে না। এতে এখন চরম হতাশ মেধাবীরা।

রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রশাসনে মেধাবী ও যোগ্য আমলা নিয়োগের হর্তাকর্তা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। এই প্রতিষ্ঠান থেকে সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) স্থান পাচ্ছেন না মেধাবী ও যোগ্যরা। ৫৬ শতাংশ কোটার ভারে, দলীয় ও আত্মীয়করণ, দুর্নীতি, মৌখিক পরীক্ষা, প্রশ্নপত্র ফাঁস, পরীক্ষা পদ্ধতির অবস্থাপনার কারণে এই প্রতিষ্ঠান থেকে সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) স্থান পাচ্ছেন না মেধাবীরা। সরকারের খড়্গ নেমে এসেছে প্রতিষ্ঠানটিতে। দলীয় ও মেধাহীনদের নিয়োগে নানা কৌশল গ্রহণ করেছে সরকার। এ জন্য পুরো পিএসসি দলীয় ও আত্মীয়করণ করা হয়েছে। একই অবস্থা পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, অডিট, খাদ্য, কর, রাজস্ব, রেল, বিআইডব্লিউটিএ, শিক্ষা সেক্টরেও।
লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক এবং কলাম লেখক। ই-মেইল:[email protected]
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএম/ডিআরএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে