রবিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৬, ০১:৫৭:৪৬

শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা জমজমাট

শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা জমজমাট

আকতারুজ্জামান :  রাজধানীর কাঁটাবনে অবস্থিত ওয়েস্টার্ন কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসমিনা আকতার (ছদ্মনাম)। কলেজটির বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন তিনি। নির্বাচনী (টেস্ট) পরীক্ষায় দুটি বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ায় কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করে। পরে দুই বিষয়ে ফেল করায় জরিমানা হিসেবে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাসমিনার কাছে ২০ হাজার টাকা দাবি করে। ২০ হাজার টাকা মিটিয়ে দিয়ে এবার পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন তিনি। একই অভিযোগ করে আরেক অভিভাবক বলেন, কলেজ কর্তৃপক্ষকে ১৫ হাজার টাকা জমা দিয়ে তার সন্তান উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। ফরম ফিলাপের জন্য কলেজটি বিজ্ঞানে পড়া শিক্ষার্থীদের কাছে আদায় করেছে আট হাজার টাকা করে। এ ক্ষেত্রে কলেজটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো নির্দেশনাই মানেনি।

তবে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, শিক্ষার্থীরা কৃতকার্য হতে পারলে গৃহীত টাকা ফেরত দেওয়া হবে। অভিযোগ রয়েছে, শুধু ওয়েস্টার্ন কলেজই নয়, রাজধানীর অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই কৌশলে টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করিয়ে পরে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতির মাধ্যমে মোটা অঙ্কের বাণিজ্য করেছে। এভাবেই রাজধানীর বেসরকারি প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা জিম্মি হয়ে আছে। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে কলেজগুলো আদায় করছে গলাকাটা ভর্তি ফি, সেশন চার্জসহ নানা ভুতুড়ে ফি। শিক্ষার নামে রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্ডার গার্টেন থেকে শুরু করে বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়।

যদিও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলছেন, শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা কাম্য নয়। শিক্ষায় বিনিয়োগ সমাজসেবার অংশ। মাইলস্টোন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী তানিশা (ছদ্মনাম)। তাকে প্রতি মাসে বেতন পরিশোধ করতে হয় এক হাজার ৬৫০ টাকা। ভর্তিতে তানিশার কাছে (বাংলা মাধ্যমে) সাড়ে ১৩ হাজার টাকা আদায় করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষা সমাপনীকে কেন্দ্র করে কোচিং ব্যবসায় মেতে উঠেছে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। মার্চ থেকে শুরু করা কোচিংয়ে প্রতি মাসের জন্য হাতিয়ে নিচ্ছে এক হাজার ২০০ টাকা। বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েও অভিভাবকরা কোচিংয়ের রাহু থেকে মুক্ত করতে পারছেন না শিক্ষার্থীদের। এ ছাড়া উদয়ন স্কুল, ধানমন্ডির স্কলার্স স্কুল, উইল্স লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল, বিয়াম স্কুল, মণিপুর উচ্চবিদ্যালয়, খিলগাঁও ন্যাশনাল আইডিয়াল হাইস্কুলে আদায় করা হচ্ছে গলাকাটা ভর্তি ফি ও মাসিক বেতন। তবে ইংরেজি মিডিয়ামের জন্য যেন কোনো বাঁধাধরা নিয়মই নেই। তাই ইচ্ছামতো ভর্তি ফি, সেশন চার্জ ও মাসিক বেতন আদায় করছে তারা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে কোচিংয়ের মাধ্যমে স্কুলগুলো হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। বেসরকারি কলেজগুলোও শিক্ষার নামে রীতিমতো মেতে উঠেছে বাণিজ্যে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে পাঠদানের নামে রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এটি শুধু অনৈতিকতাই নয়, পাপও। এসব মেনে নেওয়া যায় না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে কঠোরভাবে এর ওপর নজর রাখা উচিত। নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে অর্থ আদায় করতে না পারে, একই সঙ্গে যাতে সঠিক পদ্ধতিতে পাঠদান করানো হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে মনিটর করতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। এদিকে ভুয়া সার্টিফিকেট বিক্রিসহ শিক্ষা নিয়ে রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে ভুয়া ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে তারা। নামমাত্র শিক্ষার মাধ্যমে সার্টিফিকেট বাণিজ্য করছে কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর মালিবাগে অবস্থিত আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির অবৈধ ক্যাম্পাস থেকে বিপুল পরিমাণ ভুয়া সার্টিফিকেটসহ দুজনকে আটক করে র‌্যাব।

অভিযোগ রয়েছে, রাজধানীতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এসব ক্যাম্পাসে ভুয়া সার্টিফিকেট ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন শিক্ষা ব্যবসায়ীরা। এতে একদিকে যেমন শিক্ষার মান কমছে, পাশাপাশি নামমাত্র সনদ কাজে লাগাতে না পেরে দেশে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা।

এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির নিয়ম-নীতি মেনে চলছে না। এসব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়াই যুক্তিযুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ট্রাস্টের মাধ্যমে চললেও এটি দিনের আলোর মতো পরিষ্কার, মালিকরা ট্রাস্ট থেকে প্রফিট নেন। এটি অনুচিত।

তিনি বলেন, শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা মেনে নেওয়া যায় না। কেউ ব্যবসা করতে চাইলে অন্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করুন।

ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠিত হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রেটিংয়ের আওতাভুক্ত হবে। তখন শিক্ষার নামে ব্যবসা করা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে শিক্ষার্থীরা। এ জন্য অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল জরুরি।

ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ও ইবাইস ইউনিভার্সিটি। এ তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি অননুমোদিত ক্যাম্পাস রয়েছে। এ ছাড়া অননুমোদিত ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি ও সোনারগাঁ ইউনিভার্সিটি। নর্দান ইউনিভার্সিটির রাজশাহী ও খুলনা ক্যাম্পাস এবং ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেসে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রেখেছে ইউজিসি। এ ছাড়া আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির ১৬টি ক্যাম্পাস চিহ্নিত করে এসব অবৈধ ক্যাম্পাস বন্ধ করতে জেলা প্রশাসকদের পত্র মারফত অনুরোধ জানানো হয়েছে। বোর্ড অব ট্রাস্টিজ নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও কুমিল্লার ব্রিটানিয়া ইউনিভার্সিটির।

উপরিউক্ত তথ্য দিয়ে ইউজিসি একটি গণবিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সঠিক তথ্যাদি যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অনুমোদনহীন কোনো ক্যাম্পাসে ভর্তি হলে এর দায় ইউজিসি নেবে না।

এসব বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সম্প্রতি এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বলেন, নিয়ম অমান্য করে ক্যাম্পাস পরিচালনার চেষ্টা করলে সেটি টিকবে না। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে শর্ত পূরণ করতে না পারলে ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেওয়া হবে।-বিডিপ্রতিদিন
১৭এপ্রিল২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/এএম

 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে